১.ইমাম বুখারী (রহ) সহিহ বুখারীতে হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে অতীতকালের ঘটনা বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন- একলোক কোন এক ব্যক্তি থেকে একটি জমি ক্রয় করল। তখন যে ব্যক্তি জমি ক্রয় করল, সে তার জমিতে (মাটির নীচে) একটি স্বর্ণের থলি পেল। তখন সে জমির পূর্বের মালিককে বলল, তুমি তোমার স্বর্ণের থলি আমার থেকে নিয়ে যাও। আমি তোমার থেকে শুধু জমি ক্রয় করছি তোমার থেকে স্বর্ণ ক্রয় করিনি। তখন যে মালিক জমি বিক্রি করেছে সে বলল, আমি তোমার নিকট জমি ও জমিতে যা কিছু আছে সবই বিক্রি করেছি। তারা উভয়ে স্বর্ণের থলিটি গ্রহণ করা হতে বিরত থাকে। কেউ গ্রহণ করতে রাজি হয় না।
তারপর তারা উভয়ে অপর এক ব্যক্তির নিকট বিচারের জন্য গেল। তখন লোকটি তাদের উভয়কে জিজ্ঞাসা করে বলল, তোমাদের উভয়ের ছেলে মেয়ে আছে কি? তখন তাদের একজন বলল, আমার একজন ছেলে আছে। আর অপরজন বলল, আমার একজন মেয়ে আছে। তখন লোকটি বলল, তোমরা তোমাদের ছেলে মেয়েদের একে অপরের নিকট বিবাহ দিয়ে দাও। আর এ স্বর্ণ হতে তোমরা তোমাদের জন্য খরচ কর এবং তাদের বিবাহের মোহরানা পরিশোধ কর।
গরীব বটে
২.বুখারী মুসলিম তিরমিযীসহ কয়েকটি হাদীস গ্রন্থে হযরত আবূ হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নাবী (সা) এর নিকট এসে বললো, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন, কিসে তোমাকে ধ্বংস করলো। লোকটি বললো, আমি রমযানের রোযা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছি। নবী (সা) বললেন, তুমি কি একটি গোলাম আযাদ করতে সক্ষম? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি লাগাতার দুই মাস রোযা রাখতে সক্ষম? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি ষাটজন মিসকিনকে আহার করাতে সক্ষম? সে বলল, না।
তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি বসো। অতএব সে বসে থাকলো। ইতোমধ্যে এক ঝুড়ি খেজুর এলো। তিনি বললেন, যাও এটা দান করে দাও। সে বললো, হে আল্লাহর রসূল! সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন! মদিনার দুই প্রান্তের মাঝে আমাদের চাইতে অভাবগ্রস্ত আর কেউ নেই। বর্ণনাকারী বলেন, এতে রাসূলুল্লাহ (সা) এমনভাবে হেসে উঠেন যে, তার সামনের দন্তরাজি প্রকাশ হয়ে পড়ে। তখন তিনি তাকে বলেন, তবে তোমরাই তা ভক্ষন কর।
আজীবন মিশকের সুগন্ধি
৩.শায়খ সালিহ মুনজিদ তার ‘আসক্তি’ নামক রিসালায় আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহ) এর বরাতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবু বকর আল মিসকি (রহ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, আমরা সব সময় তোমার শরীর থেকে মিশকের সুঘ্রাণ অনুভব করি এর কারণ কি? তখন সে বলল, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শপথ করে বলছি, সুদীর্ঘ অনেক বছর পর্যন্ত আমি কোন মিশক ব্যবহার করিনি। কিন্তু এর কারণ হল, একজন নারী আমার সাথে ধোঁকাবাজি করে, আমাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। আমাকে তার ঘরে প্রবেশ করিয়ে সে তার ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। তারপর সে আমাকে তার সাথে অপকর্ম করার জন্য প্রলোভন দেয়। আমি তার অবস্থা দেখে কি করব, তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ি।
তারপর আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আমি মহিলার সব ষড়যন্ত্র বানচাল করে দেই। আমি তাকে বললাম, আমি একটু বাথরুমে যাব। তারপর সে তার এক বাঁদিকে নির্দেশ দিলে সে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেল। আমি বাথ রুমে প্রবেশ করে, সেখান থেকে কিছু পায়খানা ও ময়লা আবর্জনা নিয়ে আমার পুরো শরীরে মাখাই। তারপর আমি এ অবস্থায় মহিলাটির নিকট ফিরে আসি। আমার অবস্থা দেখে মহিলাটি অবাক হয়ে গেল। তারপর সে আমাকে ঘর থেকে বাহির করে দেয়ার নির্দেশ দিল। আমি সেখান থেকে চলে আসলাম এবং গোসল করে নিলাম।
তারপর ঐ দিন রাতে আমি যখন ঘুমালাম তখন স্বপ্নে দেখতে পেলাম এক লোক আমাকে বলছে, তুমি এমন একটি কাজ করছ, যা তুমি ছাড়া আর কেউ কোন দিন করে নি। আমি তোমার দেহকে মিশকের ঘ্রাণ দ্বারা সুগন্ধযুক্ত করে দেব| দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানে তোমার সুঘ্রাণ মানুষ পেতে থাকবে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমার শরীর থেকে মিশকের ঘ্রাণ বের হতে থাকে।
তিন দিরহাম দ্বারা জান্নাত ক্রয়
৪.হাকীমুল ইসলাম কারী তাইয়িব (রহ) খুতবাতে হাকীমুল ইসলামে ইমাম আবু দাউদ (রহ) এর ঘটনা বর্ণনা করেন। একদিন ইমাম আবু দাউদ (রহ) নদীর পার দিয়ে যাওয়ার সময় নদীর অনতিদূরে দাড়িয়ে থাকা জাহাজ থেকে জৗনৈক ব্যক্তির হাঁচির জওয়াব আলহামদুলিল্লাহ বলার আওয়ায ভেসে আসে। তিনি আদব রক্ষার্থে তার প্রতিউত্তর দেয়া সমিচীন মনে করলেন। যদিও এক মজলিস ভিন্ন দূরের হাঁচির জবাবের প্রতিউত্তর দেয়া জরুরী নয়। অতএব তিনি তিন দিরহাম দিয়ে একটি নৌকা ভাড়া করে জাহাজের সামনে গিয়ে হাঁচির জবাবের প্রতিউত্তরে ইয়ারহামকুল্লাহ বললেন। তার এই ঘটনা বর্ণনাকারীগণ বলেন- তখন গায়েব থেকে আওয়ায আসল, ‘হে আবু দাউদ! আজ তুমি তিন দিরহামের বিনিময়ে জান্নাত খরিদ করে নিলে।’
হাকীমুল ইসলাম কারী তাইয়িব (রহ) বলেন- অথচ তিনি বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। তার সেসব বড় আমলের তুলনায় আল্লাহর নিকট এই ছোট আমলটিই পছন্দ হলো। এর কারণ আমলটি ছোট হলেও এর মধ্যে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ইখলাস ছিল।
এক ব্যক্তির জ্ঞানের পরিধী
৫.নওয়াব হাবীবুর রহমান খান শেরওয়ানী তার উলামায়ে সালফ গ্রন্থে ইবনে হিব্বানের বরাতে ইমাম দাউদ যাহিরী (রহ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন- একবার আমার দরসে আবু ইয়াকুব বসরী নামক এক ব্যক্তি দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় উপস্থি হলো। কারো কোন ইঙ্গিত ছাড়াই সবার সামনে এসে বসল। তারপর গর্বভরা স্বরে বলল- হে যুবক! তোমার মনে যা চায় তা-ই জিজ্ঞাসা কর (আমি তার উত্তর দিব)। আমি তার এই অবস্থা দেখে রাগান্বিত হলাম এবং তিরষ্কারস্বরুপ বললাম- (আচ্ছা! প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতী) শিঙ্গা লাগানো সম্পর্কে কিছু বল।
আবু ইয়াকুব বলল- বারাকাল্লাহ- আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন। তারপর শিঙ্গা লাগানো সম্পর্কে মুহাদ্দিস ও ফকীহর মতামত আলোচনা করলেন। أَفْطَرَ الحَاجِمُ وَالمَحْجُومُ ‘যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় এবং যাকে শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের রোযা বিনষ্ট হয়ে গেল’ হাদীসটি আলোচনা করলেন। তারপর কে এই হাদীসটি মুসনাদ, মাওকুফ, আর মুরসালরুপে বর্ণনা করেছেন তা বর্ণনা করলেন। ফকীহগণের মধ্যে কে কে এই হাদীসের মর্ম অনুযায়ী আমল করেন তাও বর্ণনা করলেন। তারপর বর্ণনা করলেন রাসূলুল্লাহ (সা) কতভাবে শিঙ্গা লাগিয়েছেন এবং শিঙ্গা লাগানোর পর যে পারিশ্রমিক প্রদান করেছেন তাও বর্ণনা করলেন। প্রমাণ করলেন যে, যদি শিঙ্গা লাগানোর পর পারিশ্রমিক নেয়া হারাম হত তবে রাসূলুল্লাহ (সা) তা দিতেন না। তারপর এ সম্পর্কে বর্ণিত সহিহ, যয়ীফ ইত্যাদি সর্বপ্রকার হাদীস ফিকহের উসুল অনুযায়ী বিস্তারিত আলোচনা করলেন। শিঙ্গা লাগানো সম্পর্কে বিভিন্ন চিকিৎসকের যেসব বক্তব্য বিভিন্ন ভাষায় আছে, তা তিনি বর্ণনা করলেন এবং ব্যাখ্যা করেও শোনালেন। তারপর তিনি ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলেন। সবশেষে তিনি প্রমাণ করলেন যে, সর্বপ্রথম ইস্পাহানে এই প্রচলন শুরু হয়।
ইমাম দাউদ যাহিরী (রহ) বলেন, আমি তার এই বক্তব্যের বিস্তৃতি দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম এবং তাকে সম্বোধন করে বললাম-
والله ما حقرت بعد احدا ابدا
আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তোমার পর আর কাউকে তুচ্ছ মনে করব না।
কামার যেভাবে আলিম হলেন– ইমাম সাক্কাকী (রহ) এর ঘটনা
৬.আবু বকর সিরাজী তার অধ্যয়ন ও জ্ঞান সাধনা গ্রন্থে ইমাম সাক্কাকী (রহ) এর ঘটনা উল্লেখ করেন যে, ইমাম সাক্কাকী (রহ) ইসলামী ইতিহাসের একজন বিরল ও অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনিই বিখ্যাত ‘মিফতাহুল উলুম’ গ্রন্থের মুসান্নিফ। গ্রন্থটিতে তিনি বারোটি আরবী ইলম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অথচ তিনি নিজে আরবী ছিলেন না! জীবনের প্রথমযাত্রায় সাধারণ একজন কামার ছিলেন। সুন্দর ও আকর্ষণীয় তৈজসপত্র ও শিল্পসামগ্রী বানাতে পারতেন।
একদিন তিনি সুন্দর আকৃতির একটি লোহার সিন্দুক বানালেন। এতে বিস্ময়কর একটি তালা লাগালেন। অথচ সিন্দুকের ওজন ছিল মাত্র এক রতল এবং তালার ওজন ছিল এক কিরাত! এরপর তিনি সিন্দুকটা ওই যুগের বাদশাকে উপঢৌকন হিসেবে দিলেন। বাদশা ও রাজন্যবর্গ সিন্দুকটি দেখে বিস্মিত হয়ে প্রস্তুতকারীকে উপহার দিলেন এবং তার উপস্থিতিতে তার পরম প্রশংসা করতে লাগলেন।
পুরো মজলিসজুড়ে যখন তার কীর্তির প্রশংসা চলছিল ঠিক সে সময় একজন আগন্তুকের আগমন ঘটল। বাদশা আগন্তুকের সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নিজ আসনে তাকে বসতে দিলেন। সাক্কাকী (রহ) ঘটনাটি দেখে অবাক হলেন এবং জানতে পারলেন, আগন্তুক একজন বিশিষ্ট আলেম। এটা জেনে সাক্কাকী (রহ) ভাবলেন, তিনিও যদি আলেম হন তবে সিন্দুক বানিয়ে যে বাহবা কুড়িয়েছেন এরচেয়ে ঢের বেশি সম্মান, মর্যাদা ও মূল্য পাবেন।
ফলে সিদ্ধান্ত নিয়ে তখনই মাদরাসার দিকে রওয়ানা হলেন। যখন এই কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি, তখন তার বয়স ছিল ত্রিশ বছর! তাই মাদরাসার শিক্ষক বললেন, তোমার যে বয়স তাতে সম্ভবত তুমি ইলম হাসিল করতে পারবে না! আর তোমার মেধা ও মনমানসিকতার যে অবস্থা, আমি অনুমান করতে পারছি তাতে তুমি ঠিকভাবে ইলম হাসিল করতে সক্ষম হবে না এবং এই বয়সের ইলম তোমার কাজেও আসবে না।
অতএব আগে একটা পরীক্ষা নেওয়া যাক। একথা বলে ওই মুদাররিস তার মাযহাব অনুযায়ী তাকে একটি দরস দিলেন এবং বললেন-
قال الشيخ: جلد الكلب يطهر بالدباغة
‘শায়খ বলেছেন, কুকুরের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ (দাবাগাত) করলে তা পবিত্র হয়।’
উস্তাদ কথাটা তাকে বারবার আওড়াতে বললেন। পরেরদিন সাক্কাকী (রহ) দরসে হাযির হলে উস্তাদ গতকালের সবক শুনতে চাইলে সাক্কাকী (রহ) সবক শোনাতে গিয়ে বললেন-
قال الكلب: جلد الشيخ يطهر بالدباغة
‘কুকুর বলেছে, শায়খের চামড়া দাবাগাত করার দ্বারা তা পবিত্র হয়!’
তার কথায় মজলিসে হাস্যরোলের সৃষ্টি হলো। যাহোক, এরপর উস্তাদ তাকে আরেকটি সবক দিলেন। এভাবে পারা না পারার মধ্য দিয়ে তার অক্লান্ত জ্ঞানসাধনা চলতে থাকল এবং দীর্ঘ দশ বছর এই সাধনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। কিন্তু তবু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে এবং উস্তাদের ভষিদ্বাণী সত্য হতে দেখে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়লেন সাক্কাকী (রহ)। গোটাজগত যেন তার কাছে সংকুচিত হয়ে আসে।
সেই হতাশার মধ্যে একদিন তিনি পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে একটি বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন, একটা শক্ত পাথরে ওপর থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে এবং পানি পড়ার স্থানে জায়গায় জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। এই দৃশ্য তাকে দারুণভাবে নাড়া দিল। তিনি ভাবলেন এবং মনে মনে বললেন- ‘তোমার অন্তর এই পাথরের চেয়ে শক্ত নয় এবং চিন্তাশক্তি এরচেয়ে দুর্ভেদ্য নয় যে, তুমি তালিম দ্বারা প্রভাবিত হবে না।’
একথা বলে তিনি আবার সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাদরাসায় ছুটে গেলেন। মজবুতভাবে ইলম হাসিলে লেগে রইলেন। আল্লাহ তা‘আলা এই মুজাহাদা ও ত্যাগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। ফলে ত্যাগের নজরানা পেশ করতে পারায় তিনি তার জন্য ইলম ও মারেফাতের দ্বার খুলে দিলেন। যার ফলে তিনি নিজ যমানার অনেক মনীষীকে ইলম-কামালে ছাড়িয়ে গেলেন।
অত্যাচারের প্রতিফল ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়
৭.আল্লামা দামিরী (রহ) হায়াতুল হায়াওয়ানে মাজালিসাহ নামক গ্রন্থের বরাতে হযরত যায়দ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একবার আমার পাশে এক ব্যক্তি বসা ছিল যার ডান হাত ছিল পুরোটাই কাটা। হঠাৎ সে বলে উঠল, আমার এই অবস্থা যে দেখতে পাচ্ছ, সে যেন কারো উপর অত্যাচার না করে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ঘটনা কি?
সে বলতে লাগল, একবার আমি এক সমুদ্রোপকলে এক হাবশীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যে মাছ ধরছিল। সে তখন সাতটি মাছ ধরেছিল। আমি তাকে সেখান থেকে আমাকে একটি মাছ দিতে বললে সে তা অস্বীকার করল। অতএব আমি জোড় করে তার থেকে একটি মাছ ছিনিয়ে নিলাম।
যে মাছটি নিয়ে ছিলাম তা ছিল জ্যান্ত। হঠাৎ মাছটি আমার আঙ্গুলে কামড় বসিয়ে দিল। এতে আমার আঙ্গুলে সামান্য একটু খুঁজলি হলো, তবে তেমন কোন কষ্ট হলো না। মাছটি নিয়ে আমি বাড়িতে পৗছলাম। গৃহিনী মাছটি রান্না করলে আমরা সবাই তা খেলাম। তারপর (পরে) আমার আঙ্গুলে পোঁকা হয়ে গেল। সমস্ত ডাক্তারদের সিদ্ধান্ত মতে আমার সেই আঙ্গুলটি কেটে ফেলা হলো।
ভাবলাম, মনে হয় সুস্থ হয়ে গেছি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার আমার হাতে পোঁকা হয়ে গেল। তারপর আবার অপারেশন করে সামান্য কাটা হলো। এভাবে কাটতে কাটতে পুরো হাতটিই কেটে ফেলা হলো। অতএব যে কেউ আমার এই অবস্থা দেখবে, তবে সে যেন কারো উপর অত্যাচার না করে।
চলবে ইনশাআল্লাহ
নেককাজ বিপদে কাজে আসে
৮.সহিহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের পূর্বে (বনী ইসরাঈলের যুগে) তিন ব্যক্তি একদা সফরে বের হল। চলতে চলতে রাত এসে গেল। সুতরাং তারা রাত কাটানোর জন্য একটি পর্বত-গুহায় প্রবেশ করল। অল্পক্ষণ পরেই একটা বড় পাথর উপর থেকে গড়িয়ে নীচে এসে গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। এ দেখে তারা বলল যে, ‘এহেন বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে এই যে, তোমরা তোমাদের নেক আমলসমূহকে অসীলা বানিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ কর।’ সুতরাং তারা সবাই নিজ নিজ আমলের উসীলায় দুআ করতে লাগল।
তাদের মধ্যে একজন বলল- হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার অত্যন্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিল এবং (এটাও জান যে,) আমি সন্ধ্যা বেলায় সবার আগে তাদেরকে দুধ পান করাতাম। তাদের পূর্বে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও দাস-দাসী কাউকে পান করাতাম না। একদিন আমি জ্বালানী কাঠের সন্ধানে অনেক দূরে চলে গেলাম এবং বাড়ী ফিরে দেখতে পেলাম যে পিতা-মাতা ঘুমিয়ে গেছে। আমি সন্ধ্যায় দুধ দোহন করে তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, তারা ঘুমিয়ে আছে। আমি তাদেরকে জাগানো পছন্দ করলাম না এবং এও পছন্দ করলাম না যে, তাদের পূর্বে সন্তান-সন্ততি এবং দাস-দাসীকে দুধ পান করাই। তাই আমি দুধের বাটি নিয়ে তাদের ঘুম থেকে জাগার অপেক্ষায় তাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অথচ শিশুরা ক্ষুধার তাড়নায় আমার পায়ের কাছে চেঁচামেচি করছিল। এভাবে ফজর উদয় হয়ে গেল এবং তারা জেগে উঠল। তারপর তারা দুধ পান করল। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে পাথরের কারণে আমরা যে গুহায় বন্দী হয়ে আছি এ থেকে তুমি আমাদেরকে উদ্ধার কর।’’
এই দো‘আর ফলস্বরূপ পাথর একটু সরে গেল। কিন্তু তাতে তারা বের হতে সক্ষম হলো না।
দ্বিতীয়জন দুআ করল- হে আল্লাহ! আমার একটি চাচাতো বোন ছিল। সে আমার নিকট সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়তমা ছিল। (অন্য বর্ণনা অনুযায়ী) আমি তাকে এত বেশী ভালবাসতাম, পুরুষ নারীকে যত বেশী ভালবাসতে পারে। একবার আমি তার সঙ্গে যৌন মিলন করার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু সে অস্বীকার করল। পরিশেষে সে যখন এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ল, তখন সে আমার কাছে এল। আমি তাকে এই শর্তে ১২০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিলাম, যেন সে আমার সঙ্গে যৌন-মিলন করে। সুতরাং সে (অভাবের তাড়নায়) রাজী হয়ে গেল। অতঃপর যখন আমি তাকে আয়ত্তে পেলাম। (অন্য বর্ণনা অনুযায়ী) যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম, তখন সে বলল, তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং অবৈধভাবে (বিনা বিবাহে) আমার পবিত্রতা নষ্ট করো না। সুতরাং আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম, যদিও সে আমার একান্ত প্রিয়তমা ছিল এবং যে স্বর্ণমুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম তাও পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে তুমি আমাদের উপর পতিত মুসীবতকে দূরীভূত কর।’
সুতরাং পাথর আরো কিছুটা সরে গেল। কিন্তু তাতে তারা বের হতে সক্ষম হলো না।
তৃতীয়জন দুআ করল- হে আল্লাহ! আমি কিছু লোককে মজুর রেখেছিলাম। (কাজ সুসম্পন্ন হলে) আমি তাদের সকলকে মজুরী দিয়ে দিলাম। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন মজুরী না নিয়ে চলে গেল। আমি তার মজুরীর টাকা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করলাম। (কিছুদিন পর) তা থেকে প্রচুর অর্থ জমে গেল। কিছুকাল পর একদিন সে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমার মজুরী দিয়ে দাও।’ আমি বললাম, ‘এসব উঁট, গাভী, ছাগল এবং গোলাম (বাঁদি) যা তুমি দেখছ তা সবই তোমার মজুরীর ফল।’ সে বলল, ‘হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমার সঙ্গে উপহাস করবে না।’ আমি বললাম, ‘আমি তোমার সঙ্গে উপহাস করিনি (সত্য ঘটনাই বর্ণনা করছি)।’ সুতরাং আমার কথা শুনে সে তার সমস্ত মাল নিয়ে চলে গেল এবং কিছুই ছেড়ে গেল না। হে আল্লাহ! যদি আমি এ কাজ একমাত্র তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি, তাহলে যে বিপদে আমরা পড়েছি তা তুমি দূরীভূত কর।’’ এর ফলে পাথর সম্পূর্ণ সরে গেল এবং সকলেই (গুহা থেকে) বের হয়ে চলতে লাগল।
অকৃতজ্ঞতার ফল
৯.সহিহ বুখারীতে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেন- বনী ইসরাঈলের মধ্যে তিন জন লোক ছিল। একজন শ্বেতরোগী, একজন মাথায় টাকওয়ালা আর একজন অন্ধ । মহান আল্লহ তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। কাজেই তিনি তাদের কাছে একজন ফেরেশতা পাঠালেন । ফেরেশতা প্রথমে শ্বেত রোগীটির নিকট আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কাছে কোন জিনিস বেশী প্রিয় ? সে জবাব দিল, সুন্দর রং ও সুন্দর চামড়া। কেননা, মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। ফেরেশতা তার শরীরের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন। ফলে তার রোগ সেরে গেল। তাকে সুন্দর রং এবং সুন্দর চামড়া দান করা হল। তারপর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন ধরণের সম্পদ তোমার কাছ বেশী প্রিয় ? সে জবাব দিল, ‘উট’। অতএব তাকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী উটনী দেয়া হল। তখন ফেরেশতা বললেন, “এতে তোমার জন্য বরকত হোক ।”
এরপর ফেরেশতা টাকওয়ালার কাছে গেলেন এবং বললেন, তোমার কাছে কি জিনিস পছন্দনীয়? সে বলল, সুন্দর চুল এবং আমার থেকে যেন এ রোগ চলে যায় । মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। বর্ণনাকারী বলেন, ফেরেশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ মাথার টাক চলে গেল। তাকে (তার মাথায়) সুন্দর চুল দেয়া হল। ফেরেশতা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয় ? সে জবাব দিল, ‘গরু’ । তারপর তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দান করলেন এবং ফেরেশতা দু’আ করলেন, এতে তোমাকে বরকত দান করা হোক। তারপর ফেরেশতা অন্ধের নিকট আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস তোমার কাছে বেশী প্রিয় ? সে বলল, আল্লাহ যেন আমার চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দেন, যাতে আমি মানুষকে দেখতে পারি। নবী (সা) বললেন, তখন ফেরেশতা তার চোখের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন, তৎক্ষনাৎ আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। ফেরেশতা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন সম্পদ তোমার কাছে অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল ‘ছাগল’। তখন তিনি তাকে একটি গর্ভবতী ছাগী দিলেন ।
উপরে উল্লিখিত লোকদের পশুগুলো বাচ্চা দিল । ফলে একজনের উটে ময়দান ভরে গেল, অপরজনের গরুতে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেল এবং আর একজনের ছাগলে উপত্যকা ভরে গেল । এরপর ঐ ফেরেশতা তাঁর পূর্ববর্তী আকৃতি ধারণ করে শ্বেতরোগীর কাছে এসে বললেন, আমি একজন নিঃস্ব ব্যক্তি। আমার সফরের সকল (সম্বল) শেষ হয়ে গেছে। আজ আমার গন্তব্য স্থানে পৌছার আল্লাহ ছাড়া কোন উপায় নেই। আমি তোমার কাছে ঐ সত্তার নামে একটি উট চাচ্ছি, যিনি তোমাকে সুন্দর রং কোমল চামড়া এবং সম্পদ দান করেছেন। আমি এর উপর সওয়ার হয়ে আমার গন্তব্যে পৌছব। তখন লোকটি তাকে বলল, আমার উপর বহু দায় দায়িত্ব রয়েছে (কাজেই আমার পক্ষে দান করা সম্ভব নয়)। তখন ফেরেশতা তাকে বললেন, সম্ভবত আমি তোমাকে চিনি। তুমি কি এক সময় শ্বেতরোগী ছিলে না? মানুষ তোমাকে ঘৃণা করত। তুমি কি ফকীর ছিলে না? এরপর আল্লাহ তা’আলা তোমাকে (প্রচুর সম্পদ) দান করেছেন । তখন সে বলল, আমি তো এ সম্পদ আমার পূর্বপুরুষ থেকে ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছি । ফেরেশতা বললেন, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ্ তোমাকে সেরূপ করে দিন, যেমন তুমি ছিলে।
তারপর ফেরেশতা মাথায় টাকওয়ালার কাছে তাঁর সেই বেশভূষা ও আকৃতিতে গেলেন এবং তাকে ঠিক তদ্রূপই বললেন, যেরূপ তিনি শ্বেত রোগীকে বলেছিলেন । এও তাকে ঠিক অনুরূপ জবাব দিল যেমন জবাব দিয়েছিল শ্বেতরোগী। তখন ফেরেশতা বললেন, যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ তোমাকে তেমন অবস্থায় করে দিন, যেমন তুমি ছিলে ।
শেষে ফেরেশতা অন্ধ লোকটির কাছে তাঁর আকৃতিতে আসলেন এবং বললেন, আমি একজন নিঃস্ব লোক, মুসাফির মানুষ। আমার সফরের সকল সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আজ বাড়ি পৌঁছার ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কোন গতি নেই। তাই আমি তোমার কাছে সেই সত্তার নামে একটি ছাগী প্রার্থনা করছি যিনি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন আর আমি এ ছাগীটি নিয়ে আমার এ সফরে বাড়ি পৌছতে পারব। সে বলল, বাস্তবিকই আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি ফকীর ছিলাম। আল্লাহ আমাকে ধনী করেছেন। এখন তুমি যা চাও নিয়ে যাও। আল্লাহ্র কসম! আল্লাহ্র ওয়াস্তে তুমি যা কিছু নিবে, তার জন্য আমি তোমার নিকট কোন প্রশংসাই দাবী করব না। তখন ফেরেশতা বললেন, তোমার মাল তুমি রেখে দাও। তোমাদের তিনজনকে পরীক্ষা করা হল মাত্র। আল্লাহ তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তোমার সাথী দু’জনের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন ।
জান্নাতী নিআমতের অপূর্ব দৃষ্টান্ত
১০.ইমাম ইমাম সুয়ূতী (রহ) তাফসীর আদ দুররে মানসূরে ইবনে আসাকির এর বরাতে হযরত মুআবিয়া ইবনে সুফিয়ান (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি জাযিরা ভূমিতে সফর করছিলাম। আমি কতক সন্ন্যাসী ও আলিমদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, তখন তাদেরকে সালাম দিলাম আর তারা সালামের উত্তর দিল। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? তারা বলল, আমরা ঐ গির্জার সন্ন্যাসীর নিকট যাচ্ছি। আমরা প্রতি বৎসর এখানে আসি আর সে আমাদের পরবর্তী এক বছরের সংবাদ প্রদান করে। তখন আমি বললাম, আমিও সেখানে যাব। আর দেখব তার নিকট কি আছে। আমার উদ্দেশ্য হলো, হয়ত তার কাছে কোন আসমানী কিতাব আছে।
আমি যখন তার নিকট গেলাম তখন সে দরজার সামনে দাড়ান ছিল। আমি সালাম দিলাম, সে তার উত্তর দিল। তখন সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে? আমি বললাম, মুসলমান। সে বলল, মুহাম্মদ (সা) এর উম্মত? আম বললাম, হ্যাঁ। সে বলল, তার উম্মতের আলিমদের মধ্য হতে না জাহিলদের মধ্য হতে? আমি বললাম, না আলিমদের মধ্য হতে না জাহিলদের মধ্য হতে।
সে বলল, তোমরা কি বল যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার খাদ্য ও পানীয় উপভোগ করবে আর মল-মূত্র পরিত্যাগ করবে না? আমি বললাম, হ্যাঁ আমরা এমনই বলে থাকি আর ব্যাপার ঠিক এমনই। সে বলল, দুনিয়া থেকে এর কোন উদাহরণ পেশ কর। আমি বললাম, এর উদাহরণ মাতৃ উদরে থাকা বাচ্চার মত। যে মায়ের পেটে থাকে, আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক পায় অথচ পেশাব পায়খানা করে না। এই উত্তর শুনে সন্ন্যাসীর মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অতঃপর বলল, তুমি না বললে যে তুমি তার উম্মতের আলিমদের মধ্য হতে নয়। আমি বললাম, আমি তোমাকে মিথ্যা বলিনি।
সে বলল, তোমাদের ধারণা যে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার খাদ্য ও পানীয় উপভোগ করবে অথচ তা হ্রাস পাবে না। আমি বললাম, হ্যাঁ আমরা এমনই বলে থাকি আর ব্যাপার ঠিক এমনই। সে বলল, দুনিয়াতে এর কোন উদাহরণ? আমি বললাম, এর উদাহরণ হলো হিকমত ও প্রজ্ঞা। যদি দুনিয়ার সব মানুষও তার অধিকারী হয়ে যায় তথাপি তার কিঞ্চিৎ হ্রাস পাবে না। এটা শুনে সন্ন্যাসীর মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অতঃপর বলল- তুমি না বললে যে, তুমি তার উম্মতের আলিমদের মধ্য হতে নয়। আমি বললাম, আমি তোমাকে মিথ্যা বলিনি। বাস্তবিকই আমি না তার আলিমদের মধ্য হতে না জাহিলদের মধ্য হতে।
চলবে ইনশাআল্লাহ
কোন কিছুর প্রকৃত অবস্থা আল্লাহই ভাল জানেন
১১.আবু হুরায়ারা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্(সা)-কে বলতে শুনেছি যে, একদা একজন মহিলা তার কোলের শিশুকে স্তন্য পান করাচ্ছিল । এমন সময় একজন অশ্বারোহীর তাদের নিকট দিয়ে গমন করে । মহিলাটি বলল, হে আল্লাহ্! আমার পুত্রকে এই অশ্বারোহীর মতো না বানিয়ে মৃত্যু দিও না। তখন কোলের শিশুটি বলে উঠল- হে আল্লাহ্! আমাকে ঐ অশ্বারোহীর মত করো না, এই বলে পুনরায় সে স্তন্য পানে মনোনিবেশ করল । তারপর একজন মহিলাকে কতিপয় লোক অপমানজনক ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে করতে টেনে টেনে নিয়ে চলছিল । ঐ মহিলাকে দেখে শিশুর মা বলে উঠল- হে আল্লাহ্! আমার পুত্রকে ঐ মহিলার মত করো না । শিশুটি বলে উঠল, হে আল্লাহ্! আমাকে ঐ মহিলার ন্যায় কর । নবী (সা) বলেন, ঐ অশ্বারোহী ব্যক্তি কাফির ছিল আর ঐ মহিলাকে লক্ষ্য করে লোকজন বলছিল, তুই ব্যাভিচারিণী, সে বলছিল হাসবিআল্লাহ- আল্লাহ্ই আমার জন্য যথেষ্ট । তারা বলছিল তুই চোর আর সে বলছিল হাসবিআল্লাহ- আল্লাহ্ই আমার জন্য যথেষ্ট ।
যাদু ও ইমান এক হয় না -বাবেল শহরের যাদু
১২.হযরত আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এর মৃত্যুর কয়েকদিন পর ‘দাওমাতুল জানদাল’ থেকে একজন স্ত্রীলোক নবী (সা) এর খোঁজে আগমন করে। নবী (সা) এর মৃত্যুর সংবাদ শুনেই সে উদ্বিগ্ন হয়ে কাঁদতে শুরু করে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, ব্যাপার কি? সে বলল, আমার ও আমার স্বামীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ প্রায়ই লেগে থাকত। একবার সে আমাকে ছেড়ে কোন অজানা স্থানে চলে যায়। আমি এক বৃদ্ধার নিকট সব বর্ণনা করি। সে আমাকে বলল, আমি তোমাকে যা বলি তা কর। তাহলে সে তোমার নিকট নিজে নিজেই চলে আসবে। আমি প্রস্তুত হয়ে গেলাম।
রাতে সে দুটি কুকুর নিয়ে আমার নিকট আসে। একটিতে সে আরোহণ করে আরেকটিতে আমি আরোহণ করি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বাবেল শহরে চলে যাই। সেখানে দেখলাম দুটি লোক শৃঙ্খলে আবদ্ধ অবস্থায় আছে। ঐ বৃদ্ধা আমাকে বলল, তাদের নিকট গিয়ে বল, আমি যাদু শিখতে এসেছি। আমি তাদেরকে এ কথা বলি। তারা বলে জেনে রাখ! আমরা তো পরীক্ষার মধ্যে আছি। তুমি যাদু শিক্ষা করো না (বরং চলে যাও), যাদু শিক্ষা করা কুফরী। আমি বললাম, আমি শিখব। তারা বলল, তাহলে যাও, ঐ চুল্লির মধ্যে প্রস্রাব করে আস।
আমি গিয়ে প্রস্রাবের ইচ্ছা করি, কিন্তু আমার মনে ভয়ের সঞ্চার হয় এবং গা ছমছম করতে লাগল। সুতরাং আমি ফিরে এসে বলি যে, কাজ সেরে এসেছি। তারা আমাকে বলল, তুমি কি দেখলে? আমি বলি কিছই না। তারা বলল, (তাহলে) তুমি ভুল বলছ। এখন পর্যন্ত তুমি বিপথে চালিত হওনি। তোমার ইমান ঠিক আছে। এখনও সময় আছে তুমি ফিরে যাও এবং কুফরী করো না। আমি বললাম, আমাকে যে, যাদু শিখতেই হবে।
তারা পূণরায় আমাকে বলে, ঐ চুল্লিতে প্রস্রাব করে আস। আমি আবার যাই। কিন্তু এবারও মন চায় না, সুতরাং ফিরে আসি। আবার এভাবেই প্রশ্ন ও উত্তর হয়। পুনরায় আমি চুল্লির নিকট যাই এবং মনকে শক্ত করে প্রস্রাব করতে বসে পড়ি। আমি দেখলাম যে, (অপর বর্ণনায় আছে- আমার ভিতর থেকে) একজন ঘোড়সওয়ার মুখের উপর পর্দা ফেলে আকাশের উপর উঠে গেল। আমি ফিরে এসে তাদের নিকট তা বর্ণনা করি। তারা বলে, হ্যাঁ এবার তুমি সত্য বলেছ। ওটা তোমার ইমান ছিল যা তোমার মধ্য হতে বেরিয়ে গেল। এখন চলে যাও।
আমি এসে ঐ বৃদ্ধাকে বলি তারা আমাকে কিছুই শিখায়নি। সে বলল, যথেষ্ট হয়েছে। তোমার নিকট (যাদুবিদ্যার) সবই চলে এসেছে। এখন তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি পরীক্ষামূলকভাবে একটি গমের দানা নিয়ে মাটিতে ফেলে দেই। অতঃপর বললাম গাছ হও, ওটা গাছ হয়ে গেল। আমি বললাম তোমাতে ডাল পাতা গজিয়ে যাক, তাই হয়ে গেল। অতঃপর বললাম, শুকিয়ে যাও আর তা শুকিয়ে গেল। অতঃপর বললাম আটা হয়ে যাও, আর তা আটা হয়ে গেল। আমি বললাম, রুটি হয়ে যাও অতঃপর তা রুটি হয়ে গেল। এসব দেখে আমি লজ্জিত হই এবং ইমান হারানোর কারণে আমার খুব দুঃখ হয়।
হে উম্মুল মুমিনীন আল্লাহর শপথ! আমি যাদুর দ্বারা কোন কাজ নেইনি এবং কারও উপর এটা প্রয়োগও করিনি। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর খিদমতে হাজির হওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকে পেলাম না। এখন আমি কি করি?
এ কথা বলেই সে পুনরায় কাঁদতে অরম্ভ করল আর এত কাঁদল যে, সবার মনেই দয়ার সঞ্চার হলো। তাকে এর কি ফাতওয়া বা সমাধান দেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে সাহাবীগণও খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। অবশেষে তারা বললেন, এখন এ ছাড়া আর কি হবে যে, তুমি এই কাজ করবে না, তওবা করবে এবং মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে আর মা বাবার সেবা করবে।- তাফসীর ইবনে কাসীর, সহিহ হাকীম
ইবলিসের তওবা
১৩.ইমাম ইবনুল মুনযির হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। হযরত নূহ (আ) যখন তার নৌকায় আরোহণ করে তখন ইবলিস এসে হাজির হয়। নূহ (আ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুমি! সে বলল, ইবলিস। তিনি জিজ্ঞাসা করল, কেন এসেছো? সে বলতে লাগল, আমি এজন্য এসেছি যে, আপনি আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করুন আমার তওবার কোন উপায় আছে কি? আল্লাহ তাআলা হযরত নূহ (আ) এর প্রতি ওহী পাঠালেন- তাকে বল যে, তার তওবার উপায় আছে একটাই। তা হলো আদমের কবরে সিজদা করা। তখন ইবলিস বলল, আমি যাকে তার জীবনকালে সিজদা করিনি, এখন তার মৃত্যুর পর আমি তাকে সিজদা করব? অতএব সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।- তাফসীর আদ দুররে মানসূর
আল্লাহ যখন ক্ষমা করতে চান
১৪.আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত । নবী করীম (সা) বলেছেন, বনী ইসরাঈলের মাঝে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে নিরানব্বইটি নর হত্যা করেছিল । তারপর (অনুতপ্ত হয় এবং তওবার জন্য) বের হয়ে একজন পাদরীকে জিজ্ঞাসা করল, আমার তওবা কবুল হওয়ার আশা আছে কি? পাদরী বলল, না। তখন সে পাদরীকেও হত্যা করল । এরপর পুনরায় সে (লোকদের নিকট) জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল । তখন এক ব্যক্তি তাকে বলল, তুমি অমুক স্থানে চলে যাও । সে রওয়ানা হোল এবং পথিমধ্যে তার মৃত্যু এসে গেল । সে তার বক্ষদেশ দ্বারা সে স্থানটির দিকে ঘুরে গেল । মৃত্যুর পর রহমত ও আযাবের ফেরেশতাগন তার রূহকে নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলেন । আল্লাহ তাআলা সম্মুখের ভূমিকে (যেখানে সে তওবার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল) আদেশ করলেন, তুমি মৃত ব্যক্তির নিকটবর্তী হয়ে যাও এবং পশ্চাতে ফেলে আসে স্থানকে আদেশ দিলেন, তুমি দূরে সরে যাও। তারপর ফেরেশতাদের উভয় দলকে আদেশ দিলেন- তোমরা এখান থেকে উভয় দিকের দূরত্ব পরিমাপ কর । পরিমাপ করা হল, দেখা গেল যে, মৃত লোকটি সম্মুখের দিকে এক বিঘত অধিক অগ্রসরমান। আল্লাহর রহমতে সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হলো ।-বুখারী