হানাফীদের মতে রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় উভয় হাত তোলা সুন্নাতের পরিপন্থী ও নিষেধ। কিন্তু মাযহাব অমান্যকারী ওয়াহাবীরা এ দু’সময়ে উভয় হাত তোলে এবং এর উপর খুবই জোর দেয়।
প্রথম পরিচ্ছেদ
নামাযে রুকূতে যেতে এবং রুকূ হতে উঠতে উভয় হাত তোলা মাকরূহ এবং সুন্নাতের পরিপন্থী। এ প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস এবং মুজতাহিদ গণের ক্বিয়াস বর্ণিত আছে। আমরা ঐ সব বর্ণনা থেকে কিছু উপস্থাপন করছি।
হাদীস নং- ১-৪: ইমাম তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী, ইবনে আবি শায়বাহ হযরত আলক্বামা (রাদ্বি.) থেকে বর্ণনা করেন:
‘তিনি বলেন, একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাদ্বি:) আমাদেরকে বললেন, আমি কি তোমাদের সামনে রাসূলুল্লাহু (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর (পদ্ধতিতে) নামায আদায় করবো না? অতঃপর তিনি (হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাদ্বি:) নামায পড়লেন এবং তিনি তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া আর কখনো উভয় হাত তোলেননি। ইমাম তিরমিযী বলেন, ইবনে মাসঊদ (রাদ্বি.) এর হাদীসটি হাসান। এবং হাত না তোলার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের ওলামায়ে কেরামের আমল রয়েছে।
স্মর্তব্য যে, এ হাদীসটি কয়েকটি কারণে খুবই শক্তিশালী।
প্রথমতঃ এর রাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাদ্বি:) যিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বড় ফক্বীহ আলিম ।
দ্বিতীয়ঃ তিনি একদল সাহাবীর সামনে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নামায পেশ করেছেন, আর কোন সাহাবী তা অস্বীকার করেননি । বুঝা গেলো, সকলেই তাঁকে সমর্থন করেছেন। যদি হাত উত্তোলন সুন্নাত হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম এর উপর অবশ্যই আপত্তি করতেন। কেননা তাঁরা সকলেই হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলা ইহি ওয়াসাল্লাম)এর নামায দেখেছিলেন ।
তৃতীয়তঃ ইমাম তিরমিযী এ হাদীসকে ‘যঈফ’ তথা দুর্বল বলেননি। বরং হাসান বলেছেন ।
চতুর্থতঃ ইমাম তিরমীযি বলেন, অনেক ওলামায়ে সাহাবা ও তাবেয়ীন উভয় হাত তুলতেন না। তাদের আমলের দ্বারা এ হাদিছের সর্মথন হলো ।
পঞ্চমতঃ ইমাম আবু হানিফা (রাদিঃ) যিনি যুগের জলীলুল কদর এবং আযীমুশশান মুজতাহিদ ছিলেন- তিনি এ হাদিসকে কবুল করেছেন এবং এর উপর আমল করেছেন।
ষষ্ঠতঃ সমস্ত উম্মতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এ হাদিসের উপর আমল রয়েছে।
সপ্তমত: এ হাদীসটি ক্বিয়াস ও বিবেকের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ, যা আমরা সামনে আরজ করবো ইনশাআল্লাহ। এ সব কারণে ‘যঈফ’ তথা দুর্বল হাদীসও শক্তিশালী হয়ে যায়। এ হাদীসতো নিজেই হাসান।
হাদীস নং- ৫: হযরত ইবনে আবী শায়বাহ হযরত বারা বিন আযিব (রাদ্বি) থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ كَانَ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَا اِقْتَتَحَ الصَّلوةَ رَفَعَ يَدَيْهِ ثُمَّ لَايَرْفَعَهَا حَتَّى يَفْرَغَ
অর্থাৎ,‘হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন নামায আরম্ভ করতেন, তখন স্বীয় উভয় হাত উত্তোলন করতেন। অতঃপর নামায থেকে অবসর হওয়ার পূর্বে হাত তুলতেন না।
স্মর্তব্য যে, বারা ইবনে আযিব (রাদ্বি.) এর হাদিছটি ইমাম তিরমিযী এভাবে বর্ণনা করেছেন- فِى الْبَابِ عَنِ البَرَاءِ
হাদীস নং ৬-: ইমাম আবু দাউদ হযরত বারা ইবনে আযিব(রাদ্বি.) থেকে বর্ণনা বরেনঃ
قَالَ رَأيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَفَعَ يَدَيْهِ حِيْنَ اِفْتَتَحَ الصَّلَوةَ ثُمَّ لَمْ يَرْفَعُهُمَا حَتَّى اِنْصَرَفَ
অর্থাৎ,‘তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দেখেছি যখন তিনি নামায আরম্ভ করেছেন, তখন উভয় হাত উত্তোলন করেছেন। পুনরায় নামায থেকে অবসর হওয়ার পূর্বে হাত তোলেননি।
হাদীস নং- ৭ তাহাবী সাইয়িদুনা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদ্বি.) থেকে বর্ণনা করেছেন:
عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّهُ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِىْ أَوَّلِ تَكْبِيْرَةٍ ثُمَّ لَايَعُوْد
অর্থাৎ, ‘হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে রেওয়ায়াত করেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম তাকবীরে উভয় হাত তুলতেন অতঃপর তা আর কখনো করতেন না।
হদীস নং ৮-১৪: হাকিম ও বায়হাক্বী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বণর্না করেন-
‘হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, সাত জায়গায় হাত উঠাতে হবে- নামায শুরু করার সময়, কা’বার দিকে মুখ করার সময়, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে, দুইমাওকিফ তথা মিনা ও মুযদালিফায় এবং দু’জুমরা’র সামনে।
এ হাদীসটি বাযার হযরত ইবনে ওমর (রাদিঃ) থেকে, ইবনে আবি শায়বাহ হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বি) থেকে, বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বি.) থেকে, তাবরানী এবং বুখারী কিতাবুল মুফরাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিঃ) থেকে কিছুটা পার্থক্যের সাথে উল্লেখ করেছেন।
কোন কোন রেওয়ায়াতে” দু’ঈদের নামাযেরও উল্লেখ রয়েছে ।
হাদিছ নং-১৫: ইমাম তাহাবী হযরত মুগিরাহ (রাদিঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমি ইবরাহীম নাখঈ (রাদ্বি) এর কাছে আরজ করলাম যে, হযরত ওয়াইল (রাদি) হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে দেখেছেন যে, তিনি নামাযের প্রারম্ভে রুকুর সময় এবং রুকূ থেকে উঠার সময় হাত উত্তোলন করতেন। তখন তিনি (ইবরাহীম নাখঈ ) উত্তর দিলেন-
اِنْ كَانَ وَائِلَّ رَاهُ مَرَّةً يَفْعَلُ ذلِكَ فَقَدْ رَاهُ عَبْدُ اللهِ خَمْسِيْنَ مَرَّةً لَا يَفْعَلُ ذلِكَ
অর্থাৎ ‘যদি হযরত ওয়াইল (রা:) হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে একবার হাত উত্তোলন করতে দেখেন, তো হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাদ্বি.) হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে পঞ্চাশ বার হাত উত্তোলন না করতে দেখেছেন।
এর দ্বারা বুঝা গেল যে, সাইয়িদুনা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) এর হাদিস অনেক শক্তিশালী। কেননা তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ফকীহ (ইসলামী আইন শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ) এবং আলিম। তিনি হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাহচর্য বেশী লাভ করেছেন। নামাযে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছেই দন্ডায়মানকারী। কেননা হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে তিনিই দাঁড়াতেন, যিনি আলিম ও প্রাজ্ঞ ব্যাক্তি ছিলেন। যা বিভিন্ন রেওয়াতে বর্ণিত।
হাদিছ নং- ১৬-১৭: তাহারীও ইবনে আবি শায়বাহ হযরত মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন-
قَالَ صَلَّيْتُ خَلْفَ اِبْنِ عُمَرَ فَلَمْ يَكُنْ يَرْفَعُ يَدَيْهِ اِلَّافِى التَّكْبِيْرَةِ الْاُوْلَى مِنَ اصَّلوةِ
অর্থাৎ,‘তিনি বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদ্বি.) এর পিছে নামায পড়েছি। তিনি নামাযে প্রথম তাকবীর ছাড়া কখনো উভয় হাত উত্তোলন করতেন না।
হাদিস নং১৮: বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার বদরুদ্দীন আইনী (রাদ্বি.) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাদ্বি.) থেকে বর্ণনা করেন-
তিনি এক ব্যাক্তিকে রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে মাথা তোলার সময় উভয় হাত তুলতে দেখলেন। অতঃপর তাকে বললেন এরূপ করো না, কেননা এমন কাজ যা হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রথমে করেছিলেন এরপর ছেড়ে দিয়েছেন ।
এ হাদিছ থেকে বুঝা গেল যে, রুকুর আগে ও পরে উভয় হাত উত্তোলন করা ‘মানসুখ’ তথা রহিত। যে সব সাহাবী থেকে কিংবা হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে উভয় হাত উত্তোলন প্রমানিত, ওটা প্রথম আমল পরবর্তীতে রহিত হয়েছে।
হাদিস নং ১৯-২০: ইমাম বায়হাকী ও তাহাবী হযরত আলী (রাদ্বি.) থেকে বর্ণনা করেন –
أَنَّهُ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِى التَّكْبِيْرَةِ الْاُوْلى مِنَ الصَّلوةِ ثُمَّ لَايَرْفَعُ فِى شَىْئٍ مِنْهَا
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাযের প্রথম তাকবীরে তার উভয় হাত উত্তোলন করতেন। এরপর আর কোন অবস্থায়ই হাত উঠাতেন না।
হাদিস নং ২১: ইমাম তাহাবী হযরত আসওয়াদ (রাদি.) থেকে বর্ণনা করেন –
قَالَ رَايْتُ عُمَرَ اِبْنَ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ رَفَعَ يَدَيْهِ فِىْ اَوَّلِ تَكْبِيْرَةٍ ثُمَّ لَا يَعُوْدُ وَقَالَ حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ
অর্থাৎ, তিনি বলেন, আমি হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাদিঃ) কে দেখেছি, তিনি প্রথম তাকবীরে উভয় হাত উত্তোলন করতেন। এরপর আর উঠাতেন না। ইমাম তাহাবী বলেছেন এ হাদিসটি সহীহ।
হাদিস নং ২২: আবূ দাঊদ হযরত সুফয়ান থেকে বর্ণনা করেছেন –
حَدَّثَنَا سُفْيَانُ اِسْنَادُهُ بِهَذَا قَالَ رَفَعَ يَدَيْهِ فِىْ اَوَّلِ مَرَّةٍ وَقَالَ بَعْضُهُمْ مَرَّةً وَاحِدَة
অর্থাৎ হযরত সুফয়ান এ সনদে বলেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদ্বি.) প্রথমবার হাত তুলেছেন। কোন কোন রাবী বলেন একবারই হাত তুলেছেন।
হাদিস নং: ২৩: দারে কুত্বনী হযরত বারা ইবনে আযিব (রাদ্বি.) থেকে বর্ণনা করেছেন-
অর্থাৎ, ‘তিনি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে দেখেছেন, যখন হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামায শুরু করেন উভয় হাত এ পরিমাণ তুললেন যে, তা কানদ্বয়ের সমান্তরাল হয়ে গেলে। অতঃপর নামায থেকে অবসর হওয়ার পূর্বে আর কোন ক্ষেত্রেই হাত উত্তোলন করেননি ।
হাদীস নং-২৪: ইমাম মুহাম্মদ ‘কিতাবুল আছারে’ ইমাম আবু হানিফা (রাদি.) হাম্মাদ থেকে তিনি ইবরাহীম নাখঈ থেকে এ ভাবে বর্ণনা করেন-
اِنَّهُ قَالَ لَاتَرْفَعُ الْاَيْدِىْ فِيْ شَىْئٍ مِنْ صَلوتِكَ بَعْدَ الْمَرَّةِ الْاُوْلى
অর্থাৎ, তিনি বলেন, নামাযের মধ্যে প্রথমবার ছাড়া হাত উত্তোলন করো না।
হাদিস নং ২৫- আবু দাউদ হযরত বারা ইবনে আযিব (রাদিঃ) থেকে বর্ণনা করেন।
اَنَّرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ اِذَا اِفْتَتَحَ الصَّلوةَ رَفَعَ يَدَيْهِ اِلى قَرِيْبِ مِنْ اُذْنَيْهِ ثُمَّ لَايَعُوْدُ
অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন নামায আরম্ভ করতেন, তখন উভয় হাত দু’কানের কাছে তুলতেন। এরপর আর পুনরাবৃত্তি করতেন না। উভয় হাত তোলার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আরো অনেক হাদীস রয়েছে। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে শুধুমাত্র পঁচিশটি রেওয়ায়াত উপস্থাপন করেছি। আরও অধিক জানতে ইচ্ছা হলে, মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, তাহাবী শরীফ, সহীহ বোখারী পাঠ করতে পারেন।
পরিশেষে আমরা ইমামে আযম আবু হানীফার )রাদ্বি.( ঐ বিতর্ক উপস্থাপন করেছি, যা উভয় হাত উত্তোলন এর ব্যাপারে মক্কা মুয়াযযামায় ইমাম আওযাঈ (রাদ্বি.( এর সাথে হয়েছিল। দর্শকগণ দেখেছেন যে, ইমামে আযম কোন স্তরের মুহাদ্দিস এবং কতো শক্তিশালী সহীহ সনদের হাদীস উপস্থাপন করেন।
ইমাম আবু মুহাম্মদ বোখারী মুহাদ্দিস )রাহ.( হযরত সুফয়ান ইবনে উয়াইনা (রাদ্বি.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একবার হযরত ইমামে আযম (রাদ্বি.) এবং ইমাম আওযাঈ (রাদ্বি) এর সাক্ষাত হলো মক্কা মুয়াযযামার ‘দারুল হানাতীন’ নামক স্থানে। এ দ’জন বুর্যুগের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হলো। এ বিতর্ক ফতহুল ক্বাদীর এবং মিরক্বাত শরহে মিশকাত’ ইত্যাদিতে উল্লেখিত রয়েছে। বির্তকটি হুবহু নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।
ইমাম আওযাঈঃ আপনি রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় উভয় হাত উত্তোলন করেন না কেন?
ইমাম আবু হানিফা : এ জন্যই যে, এ সব জায়গায় উভয় হাত উত্তোলন হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দ্বারা প্রমাণিত নয়।
ইমাম আওযাঈ : আপনি এটা কিভাবে বললেন? আমি আপনাকে উভয় হাত তোলার ব্যাপারে সহীহ হাদিস শুনাচ্ছি-
‘আমাকে যুহরী হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি সালিম থেকে, সালিম নিজ পিতা থেকে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উভয় হাত তুলতেন, যখন নামায শুরু করতেন এবং রুকুর সময় আর রুকু থেকে উঠার সময়।
ইমামে আযম : আমার কাছে এর চেয়ে বেশী শক্তিশালী হাদিস এর বিপরীতে বিদ্যমান।
ইমাম আওযাঈ : আচ্ছা! জলদি পেশ করুন।
ইমামে আযম : নিন। শুনুন ।
* আমার কাছে হযরত হাম্মাদ হাদীস বণর্না করেছেন, তিনি ইব্রাহিম নাখঈ থেকে, তিনি হযরত আলক্বামা এবং আসওয়াদ থেকে, তাঁরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাদি:) থেকে বর্ণনা করেন- নিশ্চিয়ই নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুধু মাত্র নামাযের শুরুতে উভয় হাত উত্তোলন করতেন। এরপর আর কখনো পুনরাবৃত্তি করতেন না।
ইমাম আওযাঈ: আমার পেশ কৃত হাদীসের উপর আপনার উপস্থাপিত হাদীসের শ্রেষ্ঠত্ব কি? যার কারণে এটা গ্রহন করলেন, আর আমার পেশকৃত হাদিস ছেড়ে দিলেন।
ইমামে আযম : এ, জন্যই যে, ‘হাম্মদ’ ‘যুহরী’র চেয়ে বড় আলিম ও ফক্বীহ। আর ইব্রাহিম নাখঈ সালিম এর চেয়ে বড় আলিম ও ফক্বীহ। আলক্বামা ‘সালিমে’র পিতা অর্থাৎ, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের’ চেয়ে ইলমের ক্ষেত্রে কম নন।
‘আসওয়াদ’ অনেক বড় খোদা ভিরু ফক্বীহ এবং উত্তম। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) হলেন ফক্বীহ। কিরাআতের ক্ষেত্রে এবং হুযুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহচর্যের ক্ষেত্রে হযরত ইবনে ওমর (রাদি.) থেকে অনেক বড় ছিলেন। শৈশব থেকে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে থাকতেন। সুতরাং আমার হাদিসখানার রাবী আপনার হাদীসের রাবীদের চেয়ে ইলম ও মর্যাদার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ। এ জন্যই আমার পেশকৃত হাদীস বেশী শক্তিশালী এবং গ্রহনযোগ্য। ইমাম আওযাঈ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
গায়রে মুকাল্লিদ লা-মাজহাব ইমামে আযম সাহেবের এ সনদ দেখুন এবং এতে কোন ত্রুটি বের করুন। ইমাম আওযাঈর নীরবতার কোন হেতু খুঁজে পাবেন না। এটাই ইমাম আযমের হাদীসজ্ঞান এবং এটাই তাঁর হাদিসের সনদ তথা বর্ণনা সূত্র। আল্লাহ তায়ালা হক্বকে কবূল করার তাওফীক দান করুন। জেদের কোন প্রতিষেধক নেই। এসব লম্বা লম্বা সনদগুলো এবং তাঁদের মধ্যে দুর্বল রাবীদের অন্তর্ভুক্তী হযরত ইমামে আযম (রাদি:) এর পরে উদ্ভব হয়েছে। ইমামে আযম (রাদি:) যে হাদীসই গ্রহন করেছেন তা, সম্পূর্ন সহীহ ছিল।
বিবেকের চাহিদাও এটা যে, রুকূতে উভয় হাত উত্তোলন না হওয়া। কেননা সবার ঐকমত্য এটার উপর যে তাকবীরে তাহরীমায় উভয় হাত উত্তোলন হবে। আর সবার ঐকমত্য এটার উপর যে সিজদা এবং বসার তাকবীরগুলোতে উভয় হাত উত্তোলন না হওয়া। রুকুর তাকবীরে মতানৈক্য রয়েছে।
দেখতে হবে রুকুর তাকবীর, তাকবীরে তাহরীমার মতো, না সিজদা ও আত্তাহিয়াত এর তাকবীরের মতো। চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, রুকুর তাকবীর, তাকবীরে তাহরীমার মতো নয়। বরং সিজদা ও আত্তাহিয়্যাতের তাকবীরগুলোর মতো।
কেননা, তাকবীরে তাহরীমা হলো ফরজ, যা ছাড়া নামায হয় না এবং রুকু ও সিজদার তাকবীরগুলো সুন্নাত, ওগুলো ছাড়াও নামায হয়ে যায়। তাকবীরে তাহরীমা নামাযে একবার হয়। রুকু ও সিজদার তাকবীরগুলো বার বার হয়। তাকবীরে তাহরীমা দ্বারা মুল নামায আরম্ভ হয়। রুকু সিজদার তাকবীরগুলো দ্বারা নামাযের রুকন শুরু হয়, মূল নামায নয়।
তাকবীরে তাহরীমা নামাযীর উপর পার্থিব কাজ খাওয়া পান করা ইত্যাদি হারাম করে দেয়। কিন্ত রুকু সিজদার তাকবীরে এ অবস্থা নেই। এ গুলোর আগেই নিষেধাজ্ঞা এসে গিয়েছে।
যখন রুকুর তাকবীর সিজদার তাকবীরের মত, তাকবীরে তাহরীমার মত নয়, তাহলে উচিত হবে রুকুর তাকবীরেরও ঐ অবস্থাই হবে, যা সিজদার তাকবীরে অবস্থা। অর্থাৎ হাত না তোলা। এজন্য সত্য এটাই যে, রুকুতে কখনো উভয় হাত তুলবে না। (তাহাবী শরীফ)
সারকথা এটাই যে, রুকুর সময় উভয় হাত তোলা হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত ও হযরাতে সাহাবা বিশেষতঃ খোলাফায়ে রাশেদীন এর আমলের পরিপন্থী এবং শরয়ী জ্ঞানের ও বিরোধী। যে সব রেওয়ায়াতে উভয় হাত তোলার কথা এসেছে, সব গুলোই মানসূখ তথা রহিত। যেমন হাদিস নং- (১৮) এ বর্নিত আছে। অথবা ঐ সব হাদীস ‘মারজুহ’ (দু’টি হাদীসের দ্বন্দ্বের সময় যেটি গ্রহনযোগ্য হয় না) এবং আমল যোগ্য নয়। নইলে হাদিস গুলোর মধ্যে কঠির দ্বন্দ্ব এসে যাবে।
এটাও স্মর্তব্য যে, নামাযে নীরবতা ও প্রশান্তী প্রয়োজন। কোন কারন ছাড়া নড়া-চড়া ও অঙ্গ-ভঙ্গি করা দোষণীয় এবং সুন্নাতের পরিপন্থী। এজন্যই নামাযে অপ্রয়োজনে পা দোলানো ও অঙ্গুলি নড়া-চড়া করা নিষিদ্ধ। উভয় হাত উত্তোলন অপ্রয়োজনীয় নড়া-চড়া। সুতরাং উভয় হাত উত্তোলনের হাদীসগুলো নামাযের প্রশান্তির বিরোধী এবং হাত না তোলার ব্যাপারে হাদীসগুলো নামাযের প্রশান্তির সমর্থনকারী। তাই বিবেকেরও চাহিদা হলো হাত উত্তোলন না করার হাদিসগুলোর উপর আমল হওয়া। -সুত্রঃ জা’আল হক ৩য় খন্ড-