আল্লাহ্তায়ালা রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র ও পূর্ণ সত্তার মধ্যে উজ্জ্বল মোজেজা, সুস্পষ্ট নিদর্শন, এলেম ও মারেফতের ভাণ্ডার জমা করেছেন এবং ওই সকল বৈশিষ্ট্য ও পরিপূর্ণ আদর্শ দ্বারা তাঁকে বিশেষিত করেছেন। দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণ ও মারেফতে এলাহী দ্বারা যা সমৃদ্ধ, যাকে শরীয়তের আহকাম, দ্বীনের ভিত্তি, রাষ্ট্রীয় শাসন এবং আপামর মানুষের কল্যাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে অবহিত করেছেন পূর্ববর্তী উম্মতগণের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে, তাদের শরীয়ত, কিতাব, জীবনচরিত, ব্যক্তিগত কর্মধারা, তাদের মাযহাব ও মারেফত সম্পর্কে। দীর্ঘায়ু লাভকারী ব্যক্তিবর্গের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথাবার্তা সম্পর্কে, প্রত্যেক উম্মত কাফেরদের উপর যে
দলীল প্রমাণ ও যুক্তি উপস্থাপন করেছে, আহলে কিতাবদের বিভিন্ন দল যে মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে সে সমস্ত বিষয়ে। যারা এলেম এবং রহস্যের কথা ও খবরসমূহ গোপন করেছে,
যে সমস্ত জিনিস তারা পরিবর্তন করে ফেলেছে সে সমস্ত ব্যাপারেও আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আরও এলেম দান করেছেন আরবদের ভাষা সম্পর্কে, দু®প্রাপ্য শব্দ ও তার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে, ফাসাহাত বালাগত সম্পর্কে, উপমা উদাহরণ দেয়া, বিশুদ্ধ প্রবাদ বলা ও তার মর্মার্থ উদ্ধার করা এবং প্রজ্ঞাময় বাণী চয়ন ইত্যাদি বিষয়ে। তাঁর পবিত্র শরীয়তে সুন্দর আখলাক, আদব, শালীনতা ও সৌজন্য, আত্মসংযমের নীতিমালা এসবের বর্ণনা রয়েছে, যা জ্ঞানীদের নিকট প্রশংসনীয়। এমনকি এসব বিষয় ওই সকল কাফের ও জাহেলদের নিকটও প্রশংসনীয়, যাদের মধ্যে রয়েছে সুস্থ চিন্তা ও ন্যায়পরায়ণতা। রসুলেপাক (ﷺ) এর মধ্যে ছিলো জামেউল কালামের বিশেষত্ব। আবার সে জামে কালামও ছিলো বিভিন্ন বিষয়ের উপর। যেমন চিকিৎসা, ব্যবসা, ফারায়েয বা বণ্টন ব্যবস্থা ও হিসাব নিকাশ।
যে বিষয়গুলো সম্পর্কে বলা হলো, সেগুলোর জ্ঞান তো এমন একজন ব্যক্তির মধ্যেই থাকা স্বাভাবিক, যিনি শিক্ষার মধ্যে আত্মনিমগ্ন এবং যার রয়েছে বিভিন্ন পুস্তকাদি অধ্যয়নের অভ্যাস। অথবা যিনি শিক্ষিত লোকদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট চেষ্টা সাধনা করেছেন। কিন্তু উল্লিখিত বিষয়াবলীর আলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি তো লিখতে বা পড়তে জানতেন না। লেখা পড়া জানা লোকদের সঙ্গে ওঠা বসাও করেননি। তিনি আপন কওম থেকে বাইরে কোথাও যানওনি যে, সে সুবাদে লেখাপড়া শিখে নিতে পারেন। আর আরবদের বিদ্যার দৌড় তো ছিলো সামান্যই। বংশধারা জানা, কিছু অতীত কাহিনী জানা এবং অতীত লোকদের কিছু কবিতার পঙ্ক্তি আওড়ানো পর্যন্তই ছিলো তাদের বিদ্যাবৃত্ত। এর বাইরে তারা তেমন কিছু জানতোও না। রসুলেপাক (ﷺ) এর পরিপূর্ণ বিশাল জ্ঞানের তুলনায় সেগুলো কিছুই নয়।
নবী করীম (ﷺ) এর নবুওয়াত ও রেসালতের দলীল ও আলামতসমূহের মধ্যে রয়েছে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ রাহেব ও পাদ্রীদের স্বীকারোক্তি, তাদের ধারাবাহিক খবর, আহলে কিতাব আলেমদের নবী (ﷺ) এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত বর্ণনা, তাঁর উম্মতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত বর্ণনা, তাঁর আলামত ও নিশানাসমূহের বর্ণনা। এসব ব্যাপারে হুলিয়া মোবারকের আলোচনায় আলোকপাত করা হয়েছে।
মহরে নবুওয়াত ও অন্যান্য আলামত সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন পূর্ববর্তী কতিপয় তৌহিদবাদী কবি। যেমন কবি তুব্বা, সায়েম ইবনে সায়েদা এবং সায়েফ ইবনে এযীন প্রমুখ। কবি যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল তাঁর কবিতায় রসুলেপাক (ﷺ) এর নবুওয়াতের প্রশংসা করেছেন। এই কবিগণকে মুআহহেদায়ে জাহেলিয়াত অর্থাৎ জাহেলী যুগের তৌহিদবাদী বলা হয়। কবি ওয়ারাকা ইবনে নওফেলতো পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে নবী করীম (ﷺ) এর খবর পেয়ে নির্জন ইবাদতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে রসুলেপাক (ﷺ) এর আলোচনা, ইহুদী আলেমদের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও তাদের হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার পথ বেছে নেয়া সম্পর্কে পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। জ্বীনদের কাছ থেকে কথা শোনা গিয়েছিলো, মূর্তির মুখে কথা ফুটেছিলো, যবেহকৃত প্রাণীর মধ্যে এবং পাখির পেটের ভিতর তাঁর নাম মোবারক দেখা গিয়েছিলো, কবর ও পাথরের মধ্যে তাঁর রেসালতের সাক্ষ্যযুক্ত প্রাচীন লেখা পাওয়া গিয়েছিলো। এসব দেখার পর কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এসব ঘটনা দালায়েলুন নবুওয়াতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাছাড়াও তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সময় এবং বিভিন্ন সফর ও যুদ্ধের সময় যে সমস্ত আলামত ও নিশানা প্রকাশিত হয়েছিলো, তার বর্ণনা যথাস্থানে করা হবে ইনশাআল্লাহ্।
নবী করীম (ﷺ) এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হচ্ছে, জ্বীন ও ফেরেশতাদের দ্বারা তাঁকে সাহায্য প্রদান। জ্বীনেরা তাঁর আনুগত্য করেছে, বহু সাহাবী তা স্বচক্ষে দেখেছেন, যেমন বদর ইত্যাদি যুদ্ধে এরকম হয়েছে। এসবকিছু সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য।
যেমন একটি ঘটনা, জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) এর কাছে এলেন, ইমান, ইসলাম ও এহসানের অর্থ শিখানোর জন্য। জিব্রাইল (عليه السلام) আকৃতি পরিবর্তন করে এসেছিলেন। সাহাবা কেরাম তাঁকে চাক্ষুষ দেখেছেন। তাছাড়া এক দিন হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও হজরত ওছমান (رضي الله عنه) হজরত জিব্রাইল (عليه السلام)কে নবী করীম (ﷺ) এর পাশে হজরত দাহিয়াতুল কালবী (رضي الله عنه) এর আকৃতিতে বসে থাকতে দেখেছিলেন। তাঁর দেহের পোশাক ছিলো শাদা। কতিপয় সাহাবী দেখেছিলেন, ফেরেশতারা ঘোড়া তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কতিপয় সাহাবী
দেখেছেন, কাফেরদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে।
হজরত আবু সুফিয়ান ইবনে হারেছ (رضي الله عنه) একদিন দেখতে পেলেন, শাদা পোশাক পরিহিত কিছু লোক শাদা কালো রঙের ঘোড়ার উপর বসে আছে। ঘোড়াগুলো রয়েছে আকাশ পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানে ঝুলন্ত অবস্থায়। ইমরান ইবনুল হুসাইন একজন বিখ্যাত সাহাবী ছিলেন। তাঁর সাথে ফেরেশতারা মুসাফেহা করেছিলেন। হজরত হামযা (رضي الله عنه) রসুলেপাক (ﷺ) এবং জিব্রাইল (عليه السلام) কে কাবা শরীফের নিকট দেখেছিলেন। দেখে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) লাইলাতুল জ্বীনে এক জ্বীনকে দেখেছিলেন। জ্বীনদের কথাও শুনেছিলেন। এটাও রসুলেপাক (ﷺ) এর মোজেজা। কথিত আছে, হজরত মাসআব ইবনে ওমায়র (رضي الله عنه) উহুদযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তখন এক ফেরেশতা তাঁর আকৃতি ধারণ করে ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রেখেছিলেন। রসুলেপাক (ﷺ) ডাক দিলেন, হে মাসআব! সামনে এসো। ফেরেশতা বললো, আমি মাসআব নই। নবী করীম
(ﷺ) তখন বুঝতে পারলেন, ইনি ফেরেশতা।
হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, একদা আমি রসুল করীম (ﷺ) এর খেদমতে হাজির ছিলাম। এক বৃদ্ধ এসে রসুলেপাক (ﷺ) কে সালাম করলো। রসুলেপাক (ﷺ) সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, জ্বীনের আওয়াজ মনে হচ্ছে। সালামের জবাব দেয়ার পর লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? সে বললো, আমি হাযা ইবনুল ইয়াম ইবনুল আকইয়াম ইবনে ইবলীস। হজরত নূহ (عليه السلام) এর সঙ্গেও আমি সাক্ষাৎ করেছি। তারপর থেকে সমস্ত নবীগণের সঙ্গে মোলাকাত করে আসছি। রসুলেপাক (ﷺ) তাকে কোরআনের সুরা শিক্ষা দিয়েছিলেন।
হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) একবার শয়তানকে দেখেছিলেন। ফেতরার কিছু মাল তাঁর দায়িত্বে দেয়া হয়েছিলো বণ্টনের জন্য। তিনি শয়তানকে তিন দিন দেখলেন সেই মালের কাছে। দৈনিকই সে কিছু কিছু মাল সেখান থেকে চুরি করে নিয়ে যেতো। রসুলেপাক (ﷺ) তখন হজরত আবু হুরায়রাকে আয়তুল কুরসী শিখিয়ে দিলেন। আল্লামা ওয়াকেদী (رحمة الله) বলেন, হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদ (رضي الله عنه) উয্যা মূর্তিটি ভেঙেছিলেন, তখন তার ভিতর থেকে কালো বর্ণের এক উলঙ্গ রমণী বেরিয়ে এসেছিলো। তার মাথার চুল অগোছালো ছিলো। হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদ (رضي الله عنه) তরবারী দিয়ে তাকে দু’ টুকরো করে ফেললেন। রসুলেপাক (ﷺ) বলেছেন, এটাই হচ্ছে উয্যা শয়তান। এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রসুলেপাক (ﷺ) এর নামাজ নষ্ট করার জন্য এক শয়তান দৌড়াদৌড়ি করেছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) তাকে মসজিদের খুঁটিতে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন এবং জ্বীন বশীকরণের সুলায়মানী দোয়া স্মরণ করেছিলেন। পরে অবশ্য শয়তানকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]