আবু মুসা জাবির ইবন হাইয়ান (আল-বারিজি / আল-আযদি / আল-কুফি / আল-তুসি / আল-সুফি, আরবি: جابر بن حیان, ফার্সি: جابرحیان) (জন্ম:৭২১ – মৃত্যু:৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ)[৩] বিখ্যাত শিয়া মুসলিম বহুশাস্ত্রজ্ঞ। পাশ্চাত্য বিশ্বে তিনি জেবার নামে পরিচিত যা তার নামের লাতিন সংস্করণ। তিনি ছিলেন একাধারে রসায়নবিদ ও আলকেমিবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষী, প্রকৌশলী, দার্শনিক, পদার্থবিজ্ঞানী এবং ঔষধ বিশারদ ও চিকিৎসক। তার প্রকৃত জাতীয়তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। অনেকে বলেন তিনি আরব, অনেকে আবার বলেন তিনি পারস্যের নাগরিক ছিলেন। তাকে “রসায়নের জনক” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জাবির ইবন হাইয়ান আলকেমিতে পরীক্ষণমূলক পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেছিলেন।[৪]
১০ম শতাব্দীর প্রাথমিক দিকে, জাবিরের কাজের পরিচয় এবং সঠিক রচনাসমূহের সংগ্রহ ইসলামী চক্রের মধ্যে বিতর্ক ছিল।[৫] তিনি ১৩শ শতাব্দীতে ইউরোপে একজন বেনামী লেখক ছিলেন এবং পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা লাতিন অনুযায়ী তার নাম “জেবার” দেন। সাধারণত তাকে ছদ্ম-জেবার হিসাবে উল্লেখ করে। তিনি কলম-নাম জেবার অধীনে আল-কেমি ও ধাতুবিদ লিখেন।[৬]
তিনি রসায়নের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন যার অনেকগুলো এখনও ব্যবহৃত হয়। যেমন: হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক এসিড সংশ্লেষণ, পাতন এবং কেলাসীকরণ। তার অধিকাংশ রচনায় দুর্বোধ্য এবং বিভিন্নভাবে সংকেতায়িত। বিশেষজ্ঞ ছাড়া তার রচনা কেউ খুব একটা বোঝেন না, বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও কেউ জানেন না ঠিক কি সংকেতের মাধ্যমে লিখেছিলেন তিনি। তাক্বিনের ধারণা এবং সে সময় আরবে প্রচলিত বিভিন্ন পদার্থের নামের মাধ্যমে তিনি বিস্তৃত রাসায়নিক সংখ্যায়ন পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। তার আলকেমি ক্যারিয়ার এই পদ্ধতিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। তাক্বিন বলতে আলকেমি গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে জীবন সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বোঝায়। বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে যে, জাবিরের প্রাথমিক গবেষণামূলক রচনাগুলো পারস্যের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির পটভূমিতে রচিত হয়েছে। কৌশলগত শব্দভাণ্ডারে ব্যবহৃত ফার্সি ভাষা এবং মধ্য পারস্য দেশীয় শব্দের মাধ্যমে তার অভিসন্দর্ভগুলো পড়া যায়।তিনি লোহার মরিচা রোধক বার্নিস আবিষ্কার করেছিলেন।এছাড়া ধাতুর শোধন,তরলীকরন, বাষ্পীকরন ও তার আবিষ্কার। তিনিই সর্বপ্রথম ইস্পাত তৈরী করার পদ্ধতি বের করেছেন।চুলের কলব,কাচ,লেখার কালি তৈরীর প্রক্রিয়া ও ব্যবহার বিধি সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছিলেন।
আজদ বংশীয় জাবির কূফায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি রসায়নশস্ত্র শিক্ষার পরে “ইমাম জাফর সাদিকের” নিকট গমন করেন, পরে বারমাকীদের সাথে যোগদান করেন। এসময় তিনি অনেক পরীক্ষাকার্য চালায়। বারমাকী মন্ত্রী জাফরের সহায়তায় খলিফা হারুন অর রশীদের অনুগ্রহভাজন হন। তিনি খলিফার জন্য “কিতাবুন নুহাস” (The Book of Copper) প্রনয়ণ করেন।
ইবনে নাদিম, জাবির ইবনে হাইয়ানের রচিত গ্রন্থ সংখ্যা উল্লেখ করেছেন দুই হাজারেরও বেশী। অতিশয়োক্তি মনে হলেও এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কেননা তার প্রাপ্ত গ্রন্থ গুলোর অনেকটার গড় পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮/১০ এর মতো। এমনকি অনেক গুলোর পৃষ্টা সংখ্যা মাত্র ১টি।
জাবির ইবনে হাইয়ান, রসায়ন বিষয়ে ২৬৭টি, কিতাবুত্ তাকদীর ধরনের গ্রন্থ ৩০০টি, দর্শন বিষয়ে ৩০০টি, যুদ্ধাস্ত্র বিষয়ে ৩০০টি, চিকিৎসা সম্বন্ধীয় ৫০০টি, দার্শনিক যুক্তি খন্ডন বিষয়ক ৫০০টি ও জ্যোর্তিবিজ্ঞান, জ্যামিতি বিষয়ে ৫টি গ্রন্থ রচনা করেন।
রসায়ন বিষয়ে রচনা জাবির ইবনে হাইয়ানকে চির অমর করে রেখেছে। এবিষয়ে কয়েকটি শ্রেষ্টতম রচনা হল “কিতাবুর রহমত”, ” কিতাবুত তাজমী” এবং “জিবাক-উশ্-শরকি”। বিশ্বের বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত তার রসায়ন বিষয়ক কিছু গ্রন্থ হলো—
1️⃣ উস তুকিসিল উসিল আউয়াল ইলাল বারামেক, (The Book of Foundation to Barmaccides) ১৮৯৯ সালে ভারতে ছাপা হয়।
2️⃣ তাফসিরুল উসতুকিস, (An Explanation of Istuqus)
3️⃣ সুন্দুকূল হিকমা, (The Basket of Wisdom) কায়রো, রাজকীয় লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত।
4️⃣ কিতাবুল হুদুদ, (The Book of Definations) কায়রো, রাজকীয় লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত।
5️⃣ কাশফুল আসরার ওযা হাক্কুল আসতার, (The unveiling of Screitsand the Resiling of veils) ব্রিটিশ, মিউজিয়ামে বর্তমান।
6️⃣ রিসালা ফিল কিমিয়া, (Letter on Chemistry) কায়রো।
7️⃣ খাওয়াসুল ইকসিরুজ জাহাব, (The progerties of Elinir of gold) প্যারিসে, পান্ডুলিপি বর্তমান।
8️⃣ কিতাবুল মুকাবিলা ওয়াল মুমসিলা, (The Book of Comparison and Similituoles) বার্লিন, মিউজিয়ামে পান্ডুলিপি বর্তমান।
9️⃣ কিতাবুল রহমত, (The Book of Mercy) লিডিনে, সংরক্ষিত আছে।
🔟 কিতাবুর রহমাস সগীর, (The Little Book of Mercy) প্যারিস।
রসায়ন শাস্ত্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে জাবির, “কিতাব ইলমেস সানতিল ইয়াহিয়া ওয়াল ইকমাতিল ফালাসিফা” (The book of knowledge of the Divine art and Philosophical wisdom) উল্লেখ করেছেন “রসায়ন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি শাখা। এতে দ্রবণীয় বস্তু বা ধাকু সমূহের গঠন প্রণালি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হয় এবং খনিতে কিভাবে আগুনের সাহায্যে ধাতু উৎপন্ন হয় সে সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো হয়। কেননা কৃত্রিম উপায়ে এ সমস্ত তৈরি করতে মানুষকে প্রাকৃতিক নিয়মই অনুসরন করতে হবে। যারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্পর্কে অভিজ্ঞ তারা জানেন, যে রসায়ন বিজ্ঞান প্রকৃতিরই অনুসরন ও সেই অনুসারেই গড়ে ওঠে”।
বিভিন্ন গ্রন্থে গন্ধক ও পারদ সম্পর্কে জাবির যে মতবাত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা উনবিংশ শতাব্দী অবদি বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার ওই থিওরির শেষ পরিণতি Phlogiston Theory। যদিও জাবির এর থিওরি ও Phlogiston theory মধ্যে ব্যবধান খুব সামান্য। তবুও সামান্য ওই ব্যবধান অতিক্রম করতেই বিজ্ঞানের লেগে যায় ৮০০ বছর।
জাবিরের রাসায়নিক কার্যাবলি আলোচনা করতে গিয়ে তার জীবনীকার “এম আকবর আলী” লিখেন— “রসায়ন শাস্ত্রকে কাজে লাগাতে গিয়ে যে সমস্ত প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হয় জাবির তার প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। পূর্বেকার পরিচিতি গুলোকে সংস্কার ও সুশৃঙ্খলিত করে তুলেন। পাতন (Distillation), ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation), পরিস্রাবন (Filtration), দ্রবন (Solution), কেলোসন (Crystallistion), ভস্মিকরন (Calcination), গলন (Melting), বাষ্পীকরন (Evaporation) প্রভৃতি সম্পর্কিত রসায়নের মূল্যবান বিষয়াদি।