আহমেদ আফগানী |
একবার রাসূলুল্লাহ সা. একজন বেদুঈনের নিকট হতে একটি ঘোড়া ক্রয় করেন। রাসূল সা.-এর হাতে ঐ সময় পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। তিনি বিক্রেতা লোকটিকে তার সাথে ঘোড়ার মূল্য নেওয়ার জন্য বাড়িতে আসতে বলেন। বেদুঈন মূল্য নেয়ার উদ্দেশ্যে রাসূল সা.-এর পিছনে পিছনে তার বাড়ীর দিকে আসতে থাকে।
মহাম্মদ সা. খুব দ্রুত চলছিলেন এবং বেদুঈনটি ধীরে ধীরে চলছিল। ঘোড়াটি যে বিক্রি হয়ে গেছে এ সংবাদ জনগণ জানতো না বলে তারা ঐ ঘোড়ার দাম করতে থাকে। বিক্রেতার অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। সে কাউকে বলছে না ঘোড়াটি বিক্রি হয়ে গেছে।
বিক্রেতা লোকটি ঘোড়াটি দাম দর করতে থাকে। এক পর্যায়ে এবং রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট ঘোড়াটি যে দামে বিক্রি করেছিল তার চেয়ে বেশী দাম নির্ধারণ হয়ে যায়। বেদুঈন নিয়্যত পরিবর্তন করে রাসূলুল্লাহ সা.-কে ডাক দিয়ে বলে, আপনি হয় ঘোড়াটি এখনই ক্রয় করুন, না হয় আমি অন্যের হাতে বিক্রি করে দেই।’
একথা শুনে নবী সা. থেমে যান এবং বলেন- ‘তুমি তো ঘোড়াটি আমার হাতে বিক্রি করেই ফেলেছো; সুতরাং এখন আবার কি বলছো? বেদুঈনটি তখন বলে, ‘আল্লাহর শপথ! আমি বিক্রি করিনি। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তোমার ও আমার মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় হয়ে গেছে। ঐ ব্যাক্তি তখন বলে, আমি আপনার নিকট বিক্রি করেছি তার পক্ষে সাক্ষী আনয়ন করুন। মুসলমানগণ তাকে বারবার বলে, ওরে হতভাগা! তিনি তো আল্লাহর রাসূল, তার মুখ দিয়ে শুধু সত্য কথাই বের হয়।
কিন্তু তার এই একই কথা-সাক্ষ্য আনয়ন করুন। এমন সময় হযরত খুযাইমা রা. এসে পড়েন এবং বেদুঈনের কথা শুনে বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে ঘোড়াটি বিক্রি করেছ। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে বলেন, তুমি কি করে সাক্ষ্য দিচ্ছ? তিনি বলেন, আপনার সত্যবাদিতার উপর ভিত্তি করে।
এই ঘটনার মতো আরো ঘটনা, লেনদেনে ও ঋণ চুক্তিতে ফাসাদের খবর পাওয়া যায় মদিনাতে। তাই আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারায় ১৮২ নং আয়াতে চুক্তি, ঋণ ইত্যাদি বিষয়ে নীতিমালা নাজিল করেছেন। আয়াতটি অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, হযরত আদম আ. স্বয়ং অস্বীকারকারী। সুতরাং তার সন্তানেরা অস্বীকার করবেই। তাই আল্লাহ তায়ালা এই গাইডলাইন নাজিল করেছেন।
আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পর তাঁর পৃষ্ঠদেশে হাত বুলিয়ে দেন। ফলে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর যতগুলো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সবাই বেরিয়ে আসে। হযরত আদম আ. তাঁর সন্তানদেরকে স্বচক্ষে দেখতে পান। একজনকে অত্যন্ত হৃষ্ট পুষ্ট ও ঔজ্জ্বল্যময় দেখে জিজ্ঞেস করেন,
– হে আল্লাহ! এর নাম কি?
– এটা তোমার সন্তান দাউদ।
– তার বয়স কত হবে?
– ষাট বছর।
– তার বয়স কিছুদিন বাড়িয়ে দিন!
– না, তা হবে না। তবে তুমি যদি তোমার বয়সের মধ্য হতে তাকে কিছু দিতে চাও তবে দিতে পার।
– ইয়া আল্লাহ! আমার বয়সের মধ্য হতে চল্লিশ বছর তাকে দেওয়া হোক।
সুতরাং তা দেয়া হয়। হযরত আদম আ. এর প্রকৃত বয়স ছিল এক হাজার বছর। বয়সের এই আদান-প্রদান লিখে নেয়া হয় এবং ফেরেশতাদেরকে ওর উপর সাক্ষী রাখা হয়।
হযরত আদমের আ.-এর মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আমার বয়সের এখনও তো চল্লিশ বছর অবশিষ্ট রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তখন বলেন, ‘তুমি তোমার সন্তান দাউদকে চল্লিশ বছর দান করেছ।
হযরত আদম আ. তা অস্বীকার করেন। তখন তাঁকে ঐ লিখা দেখানো হয় এবং ফেরেশতাগণ সাক্ষ্য প্রদান করেন। এই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে মুহাম্মদ সা. বলেন, অস্বীকার করা, ভুলে যাওয়া আদম সন্তানদের বৈশিষ্ট্য।
চুক্তির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
১. হে ঈমানদারগণ! যখন কোন নির্ধারিত সময়ের জন্য তোমরা পরস্পরে মধ্যে ঋণের লেনদেন করো তখন লিখে রাখো।
২. উভয় পক্ষের মধ্যে ইনসাফ সহকারে এক ব্যক্তি দলীল লিখে দেবে। আল্লাহ যাকে লেখাপড়ার যোগ্যতা দিয়েছেন তার লিখতে অস্বীকার করা উচিত নয়। সে লিখবে এবং লেখার বিষয়বস্তু বলে দেবে সেই ব্যক্তি যার ওপর ঋণ চাপছে (অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা)। তার রব আল্লাহকে তার ভয় করা উচিত। যে বিষয় স্থিরীকৃত হয়েছে তার থেকে যেন কোন কিছুর কম বেশি না করা হয়।
৩. কিন্তু ঋণগ্রহীতা যদি বুদ্ধিহীন বা দুর্বল হয় অথবা লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে, তাহলে তার অভিভাবক ইনসাফ সহকারে লেখার বিষয়বস্তু বলে দেবে।
৪. তারপর নিজেদের পুরুষদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তিকে তার স্বাক্ষী রাখো। আর যদি দু’জন পুরুষ না পাওয়া যায় তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা সাক্ষী হবে, যাতে একজন ভুলে গেলে অন্যজন তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। এসব সাক্ষী এমন লোকদের মধ্য থেকে হতে হবে যাদের সাক্ষ্য তোমাদের কাছে গ্রহণীয়।
৫. সাক্ষীদেরকে সাক্ষ্য দেবার জন্য বললে তারা যেন অস্বীকার না করে।
৬. ব্যাপার ছোট হোক বা বড়, সময়সীমা নির্ধারণ সহকারে দলীল লেখাবার ব্যাপারে তোমরা গড়িমসি করো না।
৭. আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য এই পদ্ধতি অধিকতর ন্যায়সঙ্গত, এর সাহায্যে সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা বেশী সহজ হয় এবং তোমাদের সন্দেহ-সংশয়ে লিপ্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
৮. তবে যেসব ব্যবসায়িক লেনদেন তোমরা পরস্পরের মধ্যে হাতে হাতে করে থাকো, সেগুলো না লিখলে কোন ক্ষতি নেই।
৯. কিন্তু ব্যবসায়িক বিষয়গুলো স্থিরীকৃত করার সময় সাক্ষী রাখো। লেখক ও সাক্ষীকে কষ্ট দিয়ো না। এমনটি করলে গোনাহের কাজ করবে।
১০. আল্লাহর গযব থেকে আত্মরক্ষা করো। তিনি তোমাদের সঠিক কর্মপদ্ধতি শিক্ষা দান করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন।
মহান রাব্বুল আলামীন এই গাইডলাইন দিয়েছে সূরা বাকারের ২৮২ নং আয়াতে।
এর পর ২৮৩ নং আয়াতে সফরকালীন বিশেষ অবস্থার গাইডলাইন দিয়েছেন।
১. যদি তোমরা সফরে থাকো এবং এ অবস্থায় দলীল লেখার জন্য কোন লেখক না পাও, তাহলে বন্ধক রেখে কাজ সম্পন্ন করো।
২. যদি তোমাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি অন্যের ওপর ভরসা করে তার সাথে কোন কাজ কারবার করে, তাহলে যার ওপর ভরসা করা হয়েছে সে যেন তার আমানত যথাযথরূপে আদায় করে এবং নিজের রব আল্লাহকে ভয় করে। আর সাক্ষ্য কোনোক্রমেই গোপন করো না।
৩. যে ব্যক্তি সাক্ষ্য গোপন করে তার হৃদয় গোনাহর সংস্পর্শে কলুষিত। আর আল্লাহ তোমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বেখবর নন।
এরপর ২৮৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা হুমকি দিলেন যারা চুক্তি পরিপালন করবে না তাদের ব্যাপারে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
১. আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর।
২. তোমরা নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করো বা লুকিয়ে রাখো, আল্লাহ অবশ্যি তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন।
৩. তারপর তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন, এটা তাঁর এখতিয়ারাধীন।
৪. তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তি খাটাবার অধিকারী।
এই আয়াত নাজিলের পর সাহাবায়ে কেরাম অস্থির হয়ে গেলেন এবং রাসূল সা.-এর কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতদিন আমরা মনে করতাম যে, আমাদের ইচ্ছাকৃত কাজেরই হিসাব হবে। মনে যেসব অনিচ্ছাকৃত কল্পনা আসে, সেগুলোর হিসাব হবে না। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, প্রতিটি কল্পনারও হিসাব হবে। এতে তো শাস্তির কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সাংঘাতিক কঠিন মনে হয়।
মহানবী রাসূল সা. নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা সমীচীন মনে করলেন না বরং ওহীর অপেক্ষায় রইলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে আপাততঃ আদেশ দিলেন যে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে নির্দেশ আসে, তা সহজ হোক কিংবা কঠিন – মুমিনের কাজ হলো তা মেনে নেয়া।
সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা.-এর নির্দেশমত কাজ করলেন; যদিও তাদের মনে এ সংশয় ছিল যে, অনিচ্ছাকৃত কল্পনা ও কু-চিন্তা থেকে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা প্রথমে মুসলিমদের আনুগত্যের প্রশংসা করেন এবং বিশেষ ভঙ্গিতে ঐ সন্দেহের নিরসন করে ২৮৬ নং আয়াতে বলেন, আল্লাহ তা’আলা কাউকে তার সাধ্যের বহির্ভূত কোন কাজের নির্দেশ দেন না।
কাজেই অনিচ্ছাকৃতভাবে যেসব কল্পনা ও কু-চিন্তা অন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, এরপর সেগুলো কার্যে পরিণত করা না হয়, সেসব আল্লাহ্ তা’আলার কাছে মাফযোগ্য। যেসব কাজ ইচ্ছে করে করা হয়, শুধু সেগুলোরই হিসাব হবে। কুরআনে বর্ণিত এ ব্যাখ্যার ফলে সাহাবায়ে কেরামের মানসিক উদ্বেগ দূর হয়ে যায়।
এরপর আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদেরকে ২৮৬ নং আয়াতেই কয়েকটি বিশেষ দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে ভুল-ভ্রান্তিবশতঃ কোন কাজ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পূর্ববর্তী উম্মতদের মত শাস্তিও যেন এ উম্মতের উপর না আসে, তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতে বলা হয়েছে।
১. رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
রব্বানা-লা-তু আ-খিযনা ইন নাছীনা-আও আখত’না
হে আমাদের রব! আমরা যদি ভুলে যাই, অথবা ভুল করি তাহলে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না।
২. رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِنَا
রব্বানা ওয়ালা-তাহমিল আলাইনা ইসরান কামা-হামালতাহূ আলাল্লাযীনা মিন কাবলিনা
হে আমাদের রব, আমাদের উপর বোঝা চাপিয়ে দেবেন না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
৩. رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۚ أَنتَ مَوْلَانَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
রব্বানা ওয়ালা তুহাম্মিলনা-মা-লা-তা-কাতা লানা-বিহী ওয়া’ফু’আন্না ওয়াগফিরলানা ওয়ারহামনা আনতা মাওলা-না-ফানসুরনা আলাল কাওমিল কা-ফিরীন।
হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না, যার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমাদের প্রতি কোমল হন, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি করুণা করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক। কাফেরদের মোকাবিলায় আপনি আমাদের সাহায্য করুন।






Users Today : 1011
Users Yesterday : 1060
This Month : 8646
This Year : 180517
Total Users : 296380
Views Today : 9146
Total views : 3530205