ইমাম বোখারী ও তিরমিযী হজরত সামুরা ইবনে জুন্দুব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ﷺ) সাহাবীগণকে খুব বেশী জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা কি কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছো? কেউ স্বপ্ন দেখলে বলতেন, আর রসুলেপাক (ﷺ) তার তাবীর করে দিতেন। কিন্তু এক সময় রসুলেপাক (ﷺ) স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা বর্জন করেছিলেন। কেউ স্বেচ্ছায় স্বপ্নের কথা বললে, তখন তিনি তার তাবীর বলে দিতেন। স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার কারণ সম্পর্কে তো পূর্বে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তা পরিহার করার কারণ কী ছিলো- সে সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) সম্পর্কিত স্বপ্নের ঘটনাটিই তার কারণ, যা তিরমিযী এবং আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
একদিন নবী করীম (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছো? একজন বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি দেখলাম, আকাশ থেকে একটি দাঁড়িপালা নেমে এলো। সেই পালায় আপনাকে এবং আবু বকরকে ওজন করা হলো। আপনার পাল্লাটি ভারী হয়ে গেলো। তারপর আবু বকর (رضي الله عنه) ও ওমরকে পালা য় ওঠানো হলে আবু বকরের পালা ভারী হলো। তারপর ওমর ও ওছমানকে পাল্লায় ওঠানো হলে পালা ভারী হলো ওমরের। অতঃপর পালাখানা ওঠিয়ে নেয়া
হলো। এই স্বপ্নের কথা শুনে রসুলেপাক (ﷺ) বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে গেলেন এবং তাঁর চেহারা মোবারকে অসন্তুষ্টির ছাপ পরিলক্ষিত হলো। এরপর থেকে তিনি স্বপ্ন সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা বর্জন করেন।
রসুলেপাক (ﷺ) এর অসন্তুষ্টির কারণ সম্পর্কে আহলে এলেমগণ বলেন, স্বপ্ন মানুষের গোপন রহস্য উন্মোচিত করে দেয়। সাহাবীগণের মধ্যে একজনের উপর আরেকজনের মর্যাদা কতটুকু তা কেবল রসুলেপাক (ﷺ)ই জানতেন। এই প্রাধান্যের ব্যাপারটি স্বপ্ন দ্বারা উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে দেখে রসুলেপাক (ﷺ) শংকিত হলেন, না জানি এভাবে অনবরত স্বপ্নের মাধ্যমে গোপন বিষয় প্রকাশ পেয়ে যায়।
দুনিয়াতে মাখলুকের হাল অপ্রকাশিত থাকুক এটাই আল্লাহ্পাকের ইচ্ছা। এর খেলাফ হওয়াকে রসুলেপাক (ﷺ) পছন্দ করেননি। তাই অসন্তুষ্টির ছাপ তাঁর (ﷺ) চেহারা মোবারকে ফুটে উঠেছিলো এবং এ কারণে তিনি পরবর্তীতে স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা পরিহার করেছিলেন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে এরকম বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থ এই যে, স্বপ্নের মাধ্যমে মর্যাদার তারতম্যের ব্যাপারে যা
দেখানো হলো, তা যদিও সত্য, তথাপি তা প্রকাশিত হয়ে যাওয়াটা ভালো কথা নয়, যদিও রসুলেপাক (ﷺ) কোনো কোনো সাহাবীকে কোনো কোনো সাহাবীর উপর প্রাধান্য দিতেন। বিশেষ করে হজরত আবু বকর ও হজরত ওমরকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু এ স্বপ্নের বাহ্যিক অর্থ তাঁদেরকে খেলাফতের অধিকার দেয়া এবং একজনকে অপরের উপর প্রাধান্য পাওয়া।
শরহে সুন্নাহ কিতাবে লেখা হয়েছে, মীযানের পাল্লা উঠে যাওয়া থেকে রসুলেপাক (ﷺ) মনে করেছিলেন, ব্যাপারটি হয়তো আল্লাহর সন্তোষ অন্বেষণের স্তর থেকে ঝগড়া ও মতানৈক্যের দিকে চলে যাবে। কেউ কেউ বলেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর অসন্তুষ্টির কারণ এই ছিলো যে, তিনি মনে করেছিলেন, হজরত ওমর (رضي الله عنه) এর পর হয়তো খেলাফত শেষ হয়ে যাবে। হজরত ওছমান (رضي الله عنه) এর পাল্লা হালকা হওয়া দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হজরত ওমর (رضي الله عنه) এর পর দ্বীনের মর্যাদায় শিথিলতা আসবে।
ইবনে কুতায়বা বলেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে না চাওয়ার কারণ হচ্ছে ইবনে রমলের হাদীছ। হজরত ইবনে রমল বর্ণনা করেন, নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র অভ্যাস ছিলো, ফজরের নামাজের পর বসা অবস্থায় সুবহানালা হি ওয়াবিহামদিহী ওয়াসতাগফিরুলা হ সত্তর বার পাঠ করতেন এবং বলতেন, সত্তরবার তসবীহ পাঠ সাতশ বারের সমান। বান্দা জানে না যে তার দ্বারা সাতশ বারের চেয়েও বেশী গোনাহ্ হয়ে থাকে। তারপর রসুলেপাক (ﷺ) চেহারা মোবারক মুসলী গণের দিকে ফিরিয়ে বলতেন, কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছো কি? হজরত ইবনে রমল বলেন, একদিন আমি নিবেদন করলাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি একটি স্বপ্ন
দেখেছি। তখন রসুলেপাক (ﷺ) এই দোয়াখানা পাঠ করলেন।
ﺧَﯿْﺮٌ ﺗﱠﻠَﻘﱠﺎهُ وَﺷَﺮﱡﺗَﻮَﻓﱠﺎهُ وَﺧَﯿْﺮُﻟﱠﻨَﺎ وَﺷَﺮﱢ ﻟﱠﺎ ﻋَﺪَاﺋِﻨَﺎ وَاﻟْﺤَﻤْﺪُ ﻟِّﻠﮫِ رَبﱢ
اﻟْﻌﻠَﻤِﯿْﻦَ –
তারপর বললেন, এখন তোমার স্বপ্নটি বলো। আমি বর্ণনা করলাম, সমস্ত মানুষ সুন্দর মনোরম বড় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে একটি বাগানে প্রবেশ করলাম। বাগানটি এতই সুন্দর ছিলো যে, মনে হলো কেউ কোনোদিন এরকম সুন্দর বাগান দেখেনি। বাগান ছিলো গাছপালায় ভর্তি। আর সে গাছপালাগুলো এতই সজীব যেনো পানির ফোঁটার মত মদিরতা গাছ থেকে টপকে টপকে পড়ছে। বাগানে নানাপ্রকারের ফুল ফুটে আছে দেখে আনন্দিত হচ্ছিলাম। আর আমার পূর্বে যারা সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলো, তারাও খুব আনন্দিত হচ্ছিলো। আনন্দে সকলেই আলা হু আকবর ধ্বনি দিচ্ছিলো এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ছিলো। এরপর যারা প্রথমে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলো তারা আপন গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলো। ডানে বামে না গিয়ে সোজা প্রশস্ত রাস্তায় চলে গেলো।
দ্বিতীয় কাফেলা এলো। এ কাফেলার লোকসংখ্যা পূর্বের চেয়ে অধিক। তারাও এখানে এসে বিস্মিত হয়ে উচ্চকণ্ঠে আল্লাহু আকবার বলতে বলতে আপন গন্তব্যের দিকে চলে গেলো। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কিছু কিছু লোক তাদের
ঘোড়াগুলোকে মাঠে ঘাস খেতে দিলো এবং কিছু কিছু ঘাসের আটি বেঁধে সঙ্গে নিলো। এভাবে তারা বাগানটিকে কিঞ্চিত নষ্ট করে দিয়ে গেলো। তারপর এর চেয়ে বড় একটি কাফেলা এলো। তারাও বাগানের সৌন্দর্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগলো এবং তকবীরের ধ্বনি দিতে লাগলো।
তারা বলাবলি করছিলো, জায়গাটি বড়ই সুন্দর ও আকর্ষণীয়- অর্থাৎ তারা এস্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ইচ্ছা করলো এবং এস্থানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাগানের এদিক সেদিক ঘুরাফেরা শুরু করলো। এগুলো দেখার পর আমি আর সেখানে স্থির না থেকে আপন রাস্তায় চলা শুরু করলাম। এক পর্যায়ে বাগানের শেষ প্রান্তে গিয়ে উপনীত হলাম। সেখানে যাওয়া মাত্র হঠাৎ করে আপনার উপর আমার দৃষ্টি পড়লো। দেখলাম, একটি মিম্বর যার মধ্যে সাতটি সিঁড়ি ছিলো, আপনি সবচেয়ে উঁচু সিঁড়িটিতে বসে আছেন। আপনার ডান পাশে উন্নত নাসিকাবিশিষ্ট সুন্দর একজন পুরুষ বসে আছেন। তিনি কথা বললে উচ্চ আওয়াজ হয়। তিনি উচ্চতায় সকলের চেয়ে উঁচু। আপনার বাম পাশে আরেকজনকে দেখলাম, যাঁর দেহাকৃতি মধ্যম ধরনের, শরীরের ত্বক রক্তিমাভ। তিনি কথা বললে আপনি তাঁর কথা সম্মানের সাথে মনযোগ সহকারে শোনেন। আপনার মিম্বরের সামনে একজন বৃদ্ধ বুযুর্গ লোককে দেখতে পেলাম। মনে হলো, আপনি তার আনুগত্য এবং অনুসরণ করছেন। তাঁর সামনে দেখলাম একটি দুর্বলাকৃতির উটনী। যার বয়স অনেক বেশী হয়েছে। মনে হলো আপনি সে উটনীটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এ স্বপ্নের বর্ণনাকারী হজরত ইবনে রমল। স্বপ্নের বৃত্তান্ত শোনার পর তাঁর চেহারা মোবারকে ঈষৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। এ অবস্থা চললো কিছুক্ষণ। তারপর তিনি বাইরে চলে এলেন। মনে হলো, তাঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছে। তাই তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হচ্ছিলো। অতঃপর যখন তিনি সহজ হলেন, তখন স্বপ্নের তাবীর শুরু করলেন। বললেন, মনে হয়, বড় যে রাস্তাটি দেখেছো সেটা হচ্ছে সিরাতুল মুুস্তাকীম, যার উপর তোমরা চলছো। আর বাগানটি দুনিয়া। বাগানের সৌন্দর্য এবং সজীবতা হচ্ছে এই দুনিয়ার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, যা আমাকে দান করা হয়েছে। কিন্তু তা আমি কামনা করিনি। আর সেও আমাকে চায় না।
আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় যে কাফেলাটি দেখেছো, এতটুকু বলে তিনি পাঠ করলেন, ‘‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন’- এ দোয়াটি মুসিবতের সময় পাঠ করতে হয়, তারা দুনিয়ার মুসিবতে দুনিয়ার মোহে পড়ে গিয়েছে। দুনিয়াবী জিন্দেগীর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জড়িত হয়ে সীমালংঘনের বিপদে পড়ে গিয়েছে। এ দুনিয়ার রাজা বাদশাহ্দের অবস্থা এরকমই। কিন্তু হে ইবনে রমল! তুমি সোজা রাস্তা, কল্যাণ ও কামিয়াবীর উপর রয়েছো এবং সর্বদাই থাকবে। অবশেষে আমার সাথে মিলিত হবে। এখন সাতটি সিঁড়িবিশিষ্ট মিম্বরের তাৎপর্য কী তা শোনো। সেটা দুনিয়া।
দুনিয়ার বয়স সাত হাজার বৎসর। আর আমি সর্বশেষ হাজার সালের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছি, যার সিঁড়িটি তুমি সর্বোপরি দেখতে পেয়েছো। লম্বা আকৃতির যাঁকে দেখেছো, তিনি নবী মুসা। আমি তাঁকে এ কারণে সম্মান করি যে, তিনি কলীম হওয়ার ফযীলত লাভ করেছেন। আর মধ্যমাকৃতির রক্তিমাভ বর্ণের যাঁকে দেখেছো, তিনি নবী ঈসা। আমি তাকে সম্মান করি এ করণে যে, আল্লাহ তায়ালার নিকট তাঁর যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে। আর বয়োবৃদ্ধ লোকটি হলেন নবী ইব্রাহীম। আর দুর্বল যে উটনীটিকে দেখতে পেয়েছো, যাকে আমি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তা হচ্ছে কিয়ামত, যা আমার এবং আমার উম্মতের উপর কায়েম হবে। আমার পরে আর কোনো নবী হবে না। আর কোনো উম্মতও হবে না। হজরত ইবনে রমল বলেন, এই স্বপ্ন শোনার পর রসুলে করীম (ﷺ) আর কারও কাছে স্বপ্নের ব্যাপারে কোনো কিছু জানতে চাননি। তবে কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কিছু বললে, তিনি তার তাবীর করে দিতেন। এই হাদীছটি ইবনে কুতায়বা আর বায়হাকী ‘দালায়েল’ কিতাবে লিখেছেন। তবে হাদীছটির সনদ দুর্বল। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
وَاَﺧَﯿْﺮُ دَﻋْﻮَاﯾِﻨَﺎ اَنِ اﻟْﺤَﻤْﺪُ ﻟِّﻠﮫِ رَبﱢ اﻟْﻌﻠَﻤِﯿْﻦَ وَاﻟﺼﱠﻠﻮةُ وَاﻟﺴﱠﻠَﺎمُ
ﻋَﻠﻲ ﺳَﯿﱢﺪِ اﻟْﻤُﺮْﺳَﻠِﯿْﻦَ وَﻋَﻠﻲ اﻟِﮫ وَاَﺻْﺤَﺎﺑِﮫ اﻟﻄﱠﺎھِﺮِﯾْﻦَ –
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]