আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত কুরআন, সুন্নাহ এবং সলফে সলেহীনদের পথ, মত এবং আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত তথাপি হাদীসানুসারে নাজাতপ্রাপ্ত আহলে হক দল হিসেবে স্বীকৃত। জামেউত তিরমীজি শরীফে রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম উম্মাহে মুসলেমা তেহাত্তরটি দলে ফারাক হওয়ার সতর্কীকরণ বাণী ঘোষণা করেছেন। সাথে এটিও ঘোষণা করেছেন এই তেহাত্তর ফেরকা হতে মাত্র একটি ফেরকাই থাকবে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত তথা জান্নাতি ফেরকা বাকী বাহাত্তরটি ফেরকার স্থান হবে জাহান্নামে। উপস্থিত সাহাবাগণ রাযি: প্রিয় আক্বা হুজূরপূরনুর সাললল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে কৌতূহলপরবশ প্রশ্ন করে বসলেন….ইয়া রাসূলআল্লাহ..! একটু দয়া করে বলুন না..! ওই সৌভাগ্যবান দল কোনটি..? পিয়ারা নবী সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসালল্লাম ফরমান ” মা’আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী ” ঐ সৌভাগ্যবান দল তাঁরাই হবে যারা আমার সাথে সাথে তোমাদেরও অনুসরণ, অনুকরণ করবে। ( সূনান তিরমিজি)
একটু ভাবুন…! রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামার ঘোষণাটিতে মনযোগী হোন। দেখুন, রাসূলুলুল্লাহ ঐ হাদীসে ” সাহাবী রাযি: দের জান্নাতি দল বলেননি বরংচ তাদের যারা অনুসরণ, অনুকরণ করবে ওদেরকে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত দল তথা জান্নাতি দল হিসেবে ঘোষণা হয়েছে। অতএব, স্পষ্টতর বুঝা গেলো সাহাবী রাযি: গণ তো জান্নাতি বটেই বরংচ তাদের অনুসারীদেরও আহলে হক তথা জান্নাতি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইমাম ইবনে হজর আসকালানী রহ: আহলে সুন্নাতের একজন জগতখ্যাত ইমাম তাঁর একটি বক্তব্য মনে পড়ে যায়। তিনি বলেন ” আস- সাহবাতু কুল্লুহুম মিন আহলিল জান্নাতি কাত’আন ” তথা আহলুস সুন্নাহের আকিদাই প্রত্যেক সাহাবাগণ জান্নাতি।
আর এর বিপরীতে যারা সাহাবাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে তিরমিজি শরীফের হাদীসটি বিপরীত দিকে রাখলে বুঝা যায় বাকী বাহাত্তর জাহান্নামী ফেরকা রাসূলুল্লাহ এবং সাহাবাদের বিপরীত পথ, মতে চলার কারণেই জাহান্নামী। ঐ’সব বাহাত্তর জাহান্নামী ফেরকার মাঝে উল্লেখযোগ্য ফেরকা হল শিয়া, রাফেদ্বী ফেরকা। যারা আসহাবে আজমাঈন রাযি:দের প্রতি বিদ্বেষ রাখে। মূলত, এই সাহাবী বিদ্বেষীতার কারণে তাদের জাহান্নামী ফেরকা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। তাঁরা সাহাবাদের মাঝে সংঘটিত খা’তায়ে ইজতোহাদী নিয়ে সাহাবাদের মুনাফেক, কাফের, ফাসেক হিসেবে অভিহিত করে মা’আজাল্লাহ….
কিন্তু আহলে সুন্নাতের ফায়সালা হল –
فإن ما جرى بينهم كان مبنيًا على الاجتهاد، وكل مجتهد مصيب، والمصيب واحد مثاب، والمخطئ معذور، لا تردُّ شهادته “
তাদের মাঝে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তা ছিল ইজতিহাদ নির্ভর। আর প্রতিটি মুজতাহিদই সওয়াব পায়। যিনি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারেন, তিনি সওয়াব পান, আর যিনি ভুল করেন, তারাও এতে মাজূর। তাদের সাক্ষ্য অগ্রহণীয় নয়। [জামেউল উসূল ফী আহাদিসির রাসূল, ইবনুল আছীর জাযারীকৃত-১/১৩৩, ১/৭৪]
অতএব, আসহাবে আজমাঈন রাযি: দের ইজতেহাদী ইখতেলাফাত নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য এবং সমালোচনা করা আহলে সুন্নাহের আদর্শের খেলাফ।
তদ্রূপ একই ইজতেহাদী খা’তাকে বলির পাঠা বানিয়ে শিয়া, রাফেদ্বীরা টার্গেট করে বসলো আমীরে মুয়াবীয়া রাযি:কে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর আপত্তির জন্ম দিয়ে আপত্তিগুলোর পক্ষে শত শত জাল হাদীসসহ অন্যান্য হাদীসের শব্দ, বাক্য তথা মতন পরিবর্তন পর্যন্ত করেছে। সেই সুবাদে আজ আমীরে মুয়াবীয়া রাযি: এর বিরুদ্ধে তাদের উপস্থাপিত ” মসনদে আহমদের ” একটি হাদীসের তাহকীক আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার প্রয়াস করেছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সত্য অনুধাবন করার তাওফিক দিন। আমীন।
عَبْدُ اللَّهِ بْنُ بُرَيْدَةَ قَالَ
دَخَلْتُ أَنَا وَأَبِي عَلَى مُعَاوِيَةَ فَأَجْلَسَنَا عَلَى الْفُرُشِ ثُمَّ أُتِينَا بِالطَّعَامِ فَأَكَلْنَا ثُمَّ أُتِينَا بِالشَّرَابِ فَشَرِبَ مُعَاوِيَةُ ثُمَّ نَاوَلَ أَبِي ثُمَّ قَالَ مَا شَرِبْتُهُ مُنْذُ حَرَّمَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مُعَاوِيَةُ كُنْتُ أَجْمَلَ شَبَابِ قُرَيْشٍ وَأَجْوَدَهُ ثَغْرًا وَمَا شَيْءٌ كُنْتُ أَجِدُ لَهُ لَذَّةً كَمَا كُنْتُ أَجِدُهُ وَأَنَا شَابٌّ غَيْرُ اللَّبَنِ أَوْ إِنْسَانٍ حَسَنِ الْحَدِيثِ يُحَدِّثُنِي
“আব্দুল্লাহ ইবনে বুরাইদা বর্ণনা করেছেন “আমি ও আমার আব্বা মুয়াবিয়ার কাছে গেলাম,মুয়াবিয়া আমাদের ফারসের উপর বসতে দিল এবং আমাদের জন্য খাদ্য পরিবেশন করল ও আমরা খেলাম, তারপর মুয়াবিয়া শারাব নিয়ে এল, মুয়াবিয়া পান করল ও আমার আব্বাকে দিল, আমার আব্বা বললেন, যখন থেকে রাসূল সা: এটিকে হারাম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, তখন থেকে আমি এটি পান করিনি।
(মুসনাদে আহমদ খণ্ড- ৫ পৃ- ৩৪৭)
* হাদীসটির তাহকীক : – উল্লেখ্য যে, হাদীসটি দু’কারণে অগ্রহণযোগ্য –
১/ হাদীসটির সনদ দয়ীফ।
২/ হাদীসটির মতনে হেরফের এবং হাদীসে উল্লেখিত বাক্যাংশ অর্থাৎ ” ﻣَﺎ ﺷَﺮِﺑْﺘُﻪُ ﻣُﻨْﺬُ ﺣَﺮَّﻣَﻪُ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ
” ﷺ বক্তব্যটিকে হজরতে বুরাইদা রা: দিকে নিসবত করা।
( ১) হাদীসটির সনদ দয়্বীফ –
_______________________
* কারণ আব্দুল্লাহ বিন বুরাঈদা রা: থেকে হুসাঈন বিন ওয়াকেদ বর্ণনা করার কারণে মুনকার সাবিত হয়।
* ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ: মুসনাদ আহমদে উল্লেখ করে স্বয়ং হাদীসকে মুনকার হিসেবে রায় দিয়ে লিখেন –
ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﺑﺮﻳﺪﺓ ﺍﻟﺬﻱ ﺭﻭﻯ ﻋﻨﻪ ﺣﺴﻴﻦ ﺑﻦ ﻭﺍﻗﺪ ﻣﺎ ﺃﻧﻜﺮﻫﺎ
আব্দুল্লাহ বিন বুরাঈদার হাদীস, যেটি হুসাঈন বিন ওয়াকেদ বর্ণনা করেছেন সেটি ” মুনাকার ” হিসেবে সাব্যস্ত।
( ২২ ২/ ﺍﻟﻌﻠﻞ ﻭﻣﻌﺮﻓﺔ ﺍﻟﺮﺟﺎﻝ )
* ইমাম আহমদ রহ: অন্যত্র লিখেন –
ﻣﺎ ﺃﻧﻜﺮ ﺣﺪﻳﺚ ﺣﺴﻴﻦ ﺑﻦ ﻭﺍﻗﺪ ﻭﺃﺑﻲ ﺍﻟﻤﻨﻴﺐ ﻋﻦ ﺑﻦ ﺑﺮﻳﺪﺓ
( ﺍﻟﻌﻠﻞ ﻭﻣﻌﺮﻓﺔ ﺍﻟﺮﺟﺎﻝ /1 301 )
হাদীসটি সর্বসম্মতে ” মুনাকার ” হিসেবে সাব্যস্ত। ভ্রান্ত মতবাদীরা এই হাদীসকে আমীরে মুয়াবীয়া রাযি:কে অপমানিত এবং ঘৃণ্য প্রমাণ করতে ব্যবহার করে থাকে।
( ২) হাদীসটির মতনে হেরফের এবং হাদীসে উল্লেখিত বাক্যাংশ অর্থাৎ ” ﻣَﺎ ﺷَﺮِﺑْﺘُﻪُ ﻣُﻨْﺬُ ﺣَﺮَّﻣَﻪُ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ
” ﷺ বক্তব্যটিকে হজরতে বুরাইদা রা: দিকে নিসবত করা।
_______________________________
* শিয়া, রাফেদ্বীরা আরেকটি চালাকি করে থাকে তা হল হাদীসে উল্লেখিত বাক্যাংশ –
ﻣَﺎ ﺷَﺮِﺑْﺘُﻪُ ﻣُﻨْﺬُ ﺣَﺮَّﻣَﻪُ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ
ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ” অর্থাৎ, যখন থেকে রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাললাম এটিকে হারাম ঘোষণা করেছেন তখন থেকে কখনই আমি এটা পান করিনি ” এই বাক্যাংশকে শিয়া, রাফেদ্বীরা হহরতে বুরাঈদা রাযি: এর দিকে নিসবত করে যেমনটি তাদের অপব্যখ্যাকৃত হাদীসে পরিলক্ষিত হয়। বাস্তবে এই বাক্য হজরত বুরাঈদা রা: এর নই বরং হজরতে আমীরে মুয়াবীয়া রাযি: এর ছিলো। এবং এই হাদীসের মতন মুসনাদে আহমদের ব্যাখ্যাকার আল্লামা শুআইব রহ: উল্লেখ করেছেন।
* মুসনাদে আহমদের ব্যাখ্যাকারক আব্দুল্লাহ শুআইব আরনাউত রা: হজরতে আব্দুল্লাহ বুরাঈদা রা: এর হাদীসের ব্যাখ্যাই লিখেন –
ﻭﻗﻮﻟﻪ : “ ﺛﻢ ﻗﺎﻝ : ﻣﺎ ﺷَﺮِﺑﺘُﻪ ﻣﻨﺬ ﺣﺮَّﻣَﻪ ﺭﺳﻮﻝُ ﺍﻟﻠﻪ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ” ﺃﻱ : ﻣﻌﺎﻭﻳﺔ ﺑﻦ ﺃﺑﻲ ﺳﻔﻴﺎﻥ، ﻭﻟﻌﻠﻪ ﻗﺎﻝ ﺫﻟﻚ ﻟِﻤﺎ ﺭﺃَﻯ ﻣﻦ ﺍﻟﻜﺮﺍﻫﺔ ﻭﺍﻹﻧﻜﺎﺭ ﻓﻲ ﻭﺟﻪ ﺑﺮﻳﺪﺓ، ﻟﻈﻨِّﻪ ﺃﻧﻪ ﺷﺮﺍﺏٌ ﻣُﺤﺮَّﻡ، ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺃﻋﻠﻢ .
মুয়াবীয়া রাযি: এর এই বক্তব্য অর্থাৎ ” আমি এখনও পর্যন্ত এটি পান করিনি যখন হতে রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাললাম মদকে হারাম ঘোষণা দিয়েছেন। বস্তুত, এই কথাটি আমীরে মুয়াবীয়া রাযি: তখন বলেছিলেন, যখন তিনি হজরতে বুরাঈদা রাযি: এর চেহারায় একপ্রকারের মালিন্যতা দেখতে পান। অর্থাৎ, হজরত বুরাঈদা রাযি: ভাবনায় ছিলেন যে, মুয়াবীয়া রাযি: কি আমাকে হারাম ” মাশরুব ” দিলেন..!
[ ﻣﺴﻨﺪ ﺃﺣﻤﺪ ﻁ ﺍﻟﺮﺳﺎﻟﺔ ( /38 26 )].
* অতএব স্পষ্টতর বুঝা গেলো, ” যখন থেকে রাসূলুল্লাহ এটি হারাম ঘোষণা দিয়েছেন, তখন হতে এটি আমি পান করিনি ” বক্তব্যটি হজরত বুরাঈদা রা: এর নই বরং হজরতে আমীরে মুয়াবীয়া রাযি: এর যা শরহে মুসনাদে আহমদের হাদীস হতে সহজেই পরিলক্ষিত হয়।
* এবার আসুন আরেকটি হাদীসে উল্লেখিত ” ﻣﺎ ﺷَﺮِﺑﺘُﻪ ” শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা জেনে নেই। মুসনাদে আহমদের হাদীসের ব্যাখ্যা হতে স্পষ্টতর বুঝা গেলো যে, ” ﻣﺎ ﺷَﺮِﺑﺘُﻪ ” ” শরাব ” নই। শিয়া, রাফেদ্বীরা অনুবাদে পর্যন্ত মিথ্যাচার করে। অনেকেই উর্দুতে ” শরাব ” এর অনুবাদ করে। কিন্তু উর্দুতে যেটাকে ” শরাব ” বলা হয় সেটাকে আরবীতে ” ﺧﻤﺮ ” বলা হয়। সঠিক তাহকীক হল যে, ” শরাব ” এর তরজুমা ” ﻣﺎ ﺷَﺮِﺑﺘُﻪ ” করাই সঠিক মানে একপ্রকারের পানীয়জল। এটাকে উর্দু ” শরাব ” শব্দে নেয়া বোকামী।
* পরিশেষে, এই রেওয়ায়েতটি সকল সনদের ভিত্তিতে ” দ্বয়ীফ ” এবং ” শরাব ” কে হাদীসে উল্লেখিত ” মাশরুব ” শব্দ দ্বারা চয়ন করতে হবে অর্থাৎ কোন একপ্রকার পানীয়জল তবেঁ উর্দুতে চয়িত ” শরাব ” নই। অতএব, এই হাদীস দ্বারা আমীরে মুয়াবীয়া রাযি:কে ” শরাব ( ﺧﻤﺮ) পান করলেওয়ালা হিসেবে সাব্যস্ত হয়না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের শিয়া, রাফেদ্বীদের ভ্রান্ত মতবাদ হতে হেফাজত করুন। আমীন।
_________________________
Sifat Sultan Alif.
Researcher – Ala Hazrat Research Academy.