মানুষঃ সকলেই মাটির সৃষ্টি নয়; আদি পিতার দেহটিই কেবল মাটির; আদি মাতাও নন ▆
মাটির উৎস পানি। পানি ছাড়া মাটি অস্থিত্বহীন; মাটির অস্থিত্ব পানিতে। পানি হচ্ছে মাটির উপাদান। পানি থেকে মাটি শূন্য নয়। পানি ছাড়া মাটি কিছুই নয়।
হযরত আদম আ. কেবল মাটির; অর্থাৎ তাঁর দেহটিই কেবল মাটির। দেহটি কেবল মাটি থেকে রুপান্তরিত মানবদেহ-খাঁচা-আবরণ। তাঁর প্রাণ চাঞ্চল্য মাটির নয়।
আদি পিতা হযরত আদম আ. এঁর স্ত্রী তথা আমাদের আদি মাতা হাওয়া আ. শরীরধারী মানব জাতির প্রথম পুরুষ হযরত আদম আ. এঁর হাঁড় (bone) থেকে তৈরী। তাঁর (আদি মাতার)’ও প্রাণ চাঞ্চল্য মাটির নয়।
তাঁদের সন্তানদের মধ্যে আমি অতীব সাধারণ একজন মানুষই, কিন্তু আমি মাটির নয়, পানির। পানি থেকেই আমার রুপান্তরিত মানবদেহ-খাঁচা-আবরণ।
কিন্তু মানব সন্তানদের মধ্যে বিশেষ প্রকারে সৃষ্ট হযরত ঈসা আ. মাটিরও নন, পানিরও নন, তিনি আল্লাহ্ সূবহানাহু ওয়া তা’আলার একটি নির্দেশ, রুহ্। তা থেকেই তিনি পরিপূর্ণরুপে মানবজাতিভূক্ত হয়েছেন। সুবহানআল্লাহি বিহামদিহী।
আল্লাহর হাবীব, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন মানব জাতীভূক্ত পরিপূর্ণ এক মানব। কিন্তু তাঁর মানবীয়তা, তাঁর জাতসত্ত্বা অবশিষ্ট সমস্ত মানব জাতী থেকে ভিন্নতর। তিনি নূরপূর্ণ মানুষ। সৃষ্টিকূলের সেরা সৃষ্টি।
এতদব্যতীত মানবজাতির পরিবর্তী নর-নারী সকলেই বিশেষ প্রকার পানির সৃষ্ট।
❑ মানব জাতির সকলেই মাটির তৈরি নয়।
হযরত আদম (আঃ) একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট।
কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ
الَّذِي أَحْسَنَ كلَ شَيْءٍ خَلَقَهُ ۖ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنسَانِ مِن طِينٍ
ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِن سُلَالَةٍ مِّن مَّاءٍ مَّهِينٍ
ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّوحِهِ ۖ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ ۚ قَلِيلًا مَّا تَشْكُرُونَ
অর্থাৎ : তিনিই, যিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং মানব জাতির সৃষ্টির সূচনা মাটি থেকে করেছেন।
অতঃপর তাঁর (মাটি থেকে সৃষ্ট মানবজাতির প্রথমজন) বংশ (পরবর্তী প্রজন্ম) সৃষ্টি করেন এক তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে।
অতঃপর সেটাকে সুঠাম করেছেন এবং তাতে তাঁর নিকট থেকে রূহ ফুঁকেছেন আর তোমাদেরকে কান চক্ষু এবং অন্তরসমূহ দান করেছেন। কতই অল্প কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো!
[সূত্রঃ ক্বুরআ’নুল কারিম: সুরা সিজদা (৩২): আয়াত ৭-৯।]
সিজদা অনুষ্ঠানের পর আল্লাহ মাটি থেকে সৃষ্ট মানবীয় শরীরবিশিষ্ট মানব জাতির প্রথম মানব আদমের জুড়ি হিসাবে তাঁর অবয়ব হ’তে একাংশ নিয়ে অর্থাৎ তার পাঁজর হ’তে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন। ইহাই আদি মাতা হাওয়া (আঃ) এঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়া।
কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
অর্থাৎ : হে মানবজাতি! স্বীয় প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারই থেকে তার জোড়া ( সঙ্গীনী ) সৃষ্টি করেছেন আর এ দু’জন (আদম+হাওয়া) থেকে বহু নর-নারী বিস্তার করেছেন। এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর (তাঁর) নাম নিয়ে যাচ্ঞা কর আর আত্মীয়তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখ। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বদা তোমাদেরকে দেখছেন।
[সূত্রঃ ক্বুরআ’নুল কারিম; সুরা নিসা (০৪): আয়াত ০১। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩২৩৮ ‘বিবাহ’ অধ্যায় ১০ম অনুচ্ছেদ।]
মাটি থেকে সৃষ্ট হওয়া আদমের নাম হ’ল ‘আদম’ এবং জীবন্ত আদমের পাঁজর হ’তে সৃষ্ট হওয়ায় তাঁর স্ত্রীর নাম হ’ল ‘হাওয়া’ (তাফসীরে কুরতুবী)।
শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদরাজি, জীবজন্তু ও প্রাণীকুলের সৃষ্টি হয়েছে মাটি থেকে। আর মাটি সৃষ্টি হয়েছে পানি থেকে। পানিই হলো সকল জীবন্ত বস্তুর মূল।
ইরশাদ হচ্ছেঃ
وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ۖ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ
অর্থাৎঃ আমি প্রত্যেক জীবনবিশিষ্ট বস্তুকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?
[সূত্রঃ ক্বুরআ’ন কারিম; সুরা আম্বিয়া ২১/৩০।]
কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا ۗ وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيرًا
অর্থাৎ : এবং তিনিই, যিনি পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানুষ, অতঃপর তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন; এবং আপনার রব সর্বশক্তিমান।
[সূত্রঃ ক্বুরআ’নুল কারিম; সূরা আল ফুরক্বান, (২৫): আয়াত ৫৪।]
পৃথিবীতে এমন কোন মুসলমান ব্যাক্তি পাওয়া অসম্ভব যে রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে বাশার [মানুষ] বলে বিশ্বাস করে না।
রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বাশার [মানুষ]; কিন্ত বাশার বলেই যে তিনি মাটির তৈরি মানুষ হবেন এ যুক্তি ভূল। এ ভূল যুক্তির প্রবক্তা খারেজীরা।
সালফে সালেহীনদের আক্বিদা-বিশ্বাস এরুপ ছিল না।
আদি পিতা হযরত আদম আ. ব্যতীত তাঁর সন্তানদের কেউই ঠিক তাঁরই অনুরুপে অনুরুপ মাটির তৈরি নয়।
কাজেই সমস্ত বাশার বা মানুষই মাটির তৈরি নয়।
একমাত্র হাযরাত আদাম আ. সরাসরি মাটির তৈরি।
আমরা হাযরাত আদম আ.’র বংশধর হিসেবে নুৎফা তথা বীর্য থেকে তৈরি। আর নুৎফা বা বীর্য আমাদের শরীরে সৃষ্ট রক্ত থেকে তৈরি। আর রক্ত হচ্ছে মাটিতে উৎপাদনকৃত যে সকল খাদ্য সামগ্রী আমরা ভক্ষণ করে থাকি তা থেকে তৈরি হয়। এজন্য আমাদেরকে মাটির মানুষ বলা হয়।
দেখুন, দারুল উলূম দেওবন্দ উলামাদের মূরুব্বী মুফাস্সিরুল ক্বুরআ’ন মুফতি শফি সাহেবের তাফসীরে মা’আরেফুল ক্বুরআ’ন (বাংলা) পৃষ্ঠা ৮৫৬।
❖ হাযরাত হাওয়া আ. আদম সন্তান নন এবং কোন বীর্য দ্বারাও সৃষ্টি নন। তিনি হাযরাত আদাম আ.’র বাম পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি। কিন্তু তিনিও মানুষ (বাশার) ছিলেন।
দেখুন, তাফসীরে জালালাইন শরীফ।
❖ হাযরাত ইসা আ. মানুষ (বাশার) কিন্তু তিনি নুৎফা বা বীর্য থেকে সৃষ্টি নন; কারণ তাঁর পিতা নেই।
তিনি আল্লাহ্’র রুহ; যা হাযরাত জিব্রাইল আ. ফুঁক দিয়ে হাযরাত ইসা আ.’র মাতা হাযরাত মারইয়াম আ.’কে দান করেছিলেন। তিনি তা দ্বারাই সৃষ্টি কিন্তু তিনিও মানুষ (বাশার) ছিলেন। তদ্রুপ রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত সৃষ্টি এমনকি মানবাকৃতির মডেল (নমুনা) একমাত্র মৃত্তিকা দ্বারা সৃষ্ট মানুষ হাযরাত আদাম আ.’র সৃষ্টির হাজার হাজার বছর পূর্বে যখন মাটি-পানি কিছুই ছিল না তখন তিনি মহান আল্লাহ্ পাকের নূর থেকে সৃষ্টি।
অতএব প্রমানিত হল, পৃথিবীর সমস্ত মানুষই মাটির দ্বারা তৈরি নয়।
মহান আল্লাহ্ পাক রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে বাশার বলেছেন।
আর এ বাশার শব্দ দ্বারা রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে খারেজী-ওহাবীরা মাটির সৃষ্টি প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত।
বাশার শব্দের অর্থ মানুষ বা চামড়া ইত্যাদি।
কিন্তু বাশার শব্দ দ্বারা মাটির তৈরি মানুষ বুঝায় না। কারণ আল্লাহ্ পাক ক্বুরআ’নুল কারিমে হাযরাত জিব্রাইল আ. কেও বাশার বলেছেন।
মহান আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
অর্থাৎ “আমি আমার রুহ্ (হাযরাত জিব্রাইল আ.) কে তাঁর (হাযরাত মারইয়াম আ.) নিকট প্রেরণ করেছি। অত:পর সে (হাযরাত জিব্রাইল আ.) তাঁর সামনে পূর্ণাঙ্গ সুঠাম বাশার বা মানুষের দেহাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করলেন“।
[সূরাহ্ মারইয়াম, আয়াত ১৭।]
দেখুন, হাযরাত জিব্রাইল আ. নূরের ফেরেশ্তা। কিন্তু মাটির তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও নুরের তৈরি হয়ে মানুষের মত পৃথিবীতে কখনও কখনও আত্মপ্রকাশ করতেন।
❖ হারুত-মারুত ফিরিশ্তাদ্বয়কে মহান আল্লাহ্ পাক এ জমিনে বাশারিয়্যাত (মানবীয় বৈশিষ্ঠ্যমণ্ডিত) এর অধিকারি করে পরীক্ষার জন্য পাঠালে তাঁদেরও পার্থিব চাহিদার দরকার হয়েছিল। অথচ তখন তাঁরা মাটির সৃষ্টি বাশার হয়ে পরেন নি। তাঁরা কিয়ামাত পর্যন্ত সে পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার বিনিময় পৃথিবীর এক নির্দিষ্ট স্থানে মহান আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছায় ভোগ করছেন।
অত:পর তাঁরা স্বজাতি ফিরিশ্তাদের সাথে পুনরায় যোগ দিবেন।
এ ঘটনাটিও সুস্পষ্ট প্রমান বহন করে।
❖ মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর হাবীব রসূলে কারিম সাল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে বলেন,
হে নবী! আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়ক এবং নূরের প্রদীপ হিসেবে (সিরাজাম মুনিরা)।
[সূরাহ্ আহযাব, আয়াত ৪৫-৪৬।]
হাযরাত জাবের রা. রসূলে কারিম সাল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে সর্বপ্রথম সৃষ্ট বস্তু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ইরশাদ ফরমান,
“হে জাবের! সমস্ত বস্তু সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ্ তোমার নবীর নূরকে তাঁর আপন নূর হতে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ঐ নূর কুদরতে যেথায় সেথায় ভ্রমন করছিলো। ঐ সময় লওহ- কলম, বেহেসত-দোজখ, ফেরেশ্তা, আসমান- জমিন, চন্দ্র–সূর্য, জিন-ইনসান কিছুই ছিল না।”
[গ্রন্থ সূত্রঃ মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, ভলি-০১, হাদীস নং-১৮; মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়া, শরহে জুরকানী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং -৮৯।]
❖ আল্লামা জারকানী আলাইহির রহমত ‘শরহে মাওয়াহিবে লাদুনিয়া’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন- মিন নূরিহি তাঁর (আল্লাহর) নূর হতে বা নূর কর্তৃক-ইহা ইজাফতে তাশরিফি বা সম্মানসূচক সম্বন্ধ এবং ইহা জানিয়ে দেয়া উদ্দেশ্য যে, ইহা সৃষ্টিজগতের এক আশ্চর্য বস্তু। ইহার একটি পৃথক শান রয়েছে আল্লাহতা’য়ালার দরবারে। এ শানটির একটি মুনাসিবত বা সাদৃশ্য হতে পারে আল্লাহতা’য়ালার ঐ বাণীর সাথে- আদম আলাইহিস সালামের দেহ মোবারকে তাঁর (আল্লাহর) রূহ ফুঁকলেন অর্থাৎ এখানে রূহের সম্বন্ধ আল্লাহতা’য়ালার দিকে সম্মানার্থে করা হয়েছে। মিন নূর এর মধ্যে “মিন” ‘হরফে জার’ বয়ানিয়া, বর্ণনামূলক।
“মিন নূর” এর মধ্যে যে নূর রয়েছে এর ব্যাখ্যায় আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত বলেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে সে নূর আল্লাহতা’য়ালার জাত কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর জাত রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৃষ্টির মাদ্দা বা মূল ধাতু, বরং ইহার অর্থ এই যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক সৃষ্টি করার মধ্যে আল্লাহতা’য়ালার এরাদা বা ইচ্ছার সম্পর্ক বেলা ওয়াসেতা বা সরাসরি অর্থাৎ কোন কিছুর মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন।
আল্লামা জারকানি আলাইহির রহমত এর উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো আল্লাহতা’য়ালা হেকমতে কামেলার দ্বারা সর্বপ্রথম তাঁর হাবিবের নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সৃষ্ট নূরের ডাইরেক্ট বা সরাসরি সম্পর্ক আল্লাহর জাতের সঙ্গে রয়েছে।
❖ ইমাম কাজী আয়াজ রহ. তাঁর রচিত আশ শিফা প্রাচীনতম কিতাবে হাযরাত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন,
হাযরাত মুহাম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূর পৃথিবী সৃষ্টির ২০০০ বৎসর পূর্বে সৃষ্টি করেছিলেন।
[গ্রন্থ সূত্রঃ আশ শিফা, প্রথম অধ্যায়, পৃ., ৪৮।]
❖ আল্লামা ইবনে জাওজী লিখেছেন :
হাযরাত আদাম আ. কে যখন সৃষ্টি করা হল তখন তাঁর ললাট মুবারাকে রসূলে কারিম সাল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর নূর মুবারাক রাখা হয় এবং হাযরাত আদাম আ. রসূলে কারিম সাল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখলেন। তিনি আল্লাহ্ রব্বুল আ’লামীন কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি (সাল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে? আল্লাহ্ তা’লা জবাব দিলেন, তিনি হলেন শেষ নাবী সাল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আপনার সন্তানদের মধ্যে সর্দার।
[গ্রন্থ সূত্রঃ আল ওয়াফা, ইবনে জাওজী; অধ্যায় মীলাদুন্নাবী সাল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম।]
❖ সূরাহ্ আশ শুআরা, আয়াত ২১৯-এর ব্যাখ্যা :
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর এবং ক্বাযী শাওকানী লিখেছেন, হাযরাত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
“আল্লাযী ইয়ারকা হীনা তাক্বওমু ওয়াতাক্বল্লুবাকা ফীস সাজিদীন অর্থাৎ তিনি সিজদাকারীদের মাঝে আপনার পরিভ্রমণ প্রত্যক্ষ করেন“-এর অর্থ সে নূর এক নাবী থেকে আরেক নাবী বরাবর সঞ্চালিত হচ্ছিল এবং তা হাযরাত মা আমিনা (উনার প্রতি সালাম)’র রেহেম মুবারাকে পৌঁছা পর্যন্ত অব্যাহত ছিলেন; অত:পর হাযরাত মুহাম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে শুভাগমন (শুভ-বিলাদাত) করেন।
❖ রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমান- “আমি পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভে প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হয়েছি। আমার বেলাদত হয়েছে বৈধ বিবাহের ফলে, অবৈধ যৌনাচার থেকে নয়। আল্লাহ্ পাক যখন (হযরত) আদম (আ:)-কে পৃথিবীতে পাঠালেন, তখন তিনি
আমাকে আদম (দ:)-এর মেরুদন্ডে স্থাপন করেন; আর সেখান থেকে নূহ (আ:)-এর কাছে তাঁর নৌকায় স্থানান্তরিত হলাম; অতঃপর সেখান থেকে (হযরত) ইব্রাহীম (আ:) এবং তারপর ধারাবাহিকভাবে পবিত্র ঔরস থেকে পবিত্র গর্ভ হয়ে আমার পবিত্র পিতা-মাতার ঔরসে স্থানান্তরিত হই, যাঁরা কখনোই অবৈধ যৌনাচার করেন নি’।
[গ্রন্থ সূত্রঃ তাফসীরে রূহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা।]
❖ আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন,
“রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান, আমি হচ্ছি হাযরাত ইব্রাহীম আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সেই দুআ’; হাযরাত ইসা আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সেই ভবিষ্যদ্বাণী; আমার পূন্যময় জননী যখন আমাকে ধারন করছিলেন তখন তিনি তাঁর শরীর মুবারাক থেকে চকমকিত নূরোজ্জল আলোক রশ্মী প্রত্যক্ষ করেন; যার মাধ্যমে তাঁর কাছে সিরিয়ার প্রাসাদগুলোও উদ্ভাসিত হত“।
[গ্রন্থ সূত্রঃ তাওয়ারিখে ইবনে কাসীর, খণ্ড ২, অধ্যায় সীরাতুন্নাবী সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম; মুখতাসার সীরতে রসূল সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম, কৃত ইবনে শায়খ নাযদী।]
❖ আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেন,
“হাযরাত আব্দুল মুত্তালিব রা. তাঁর পূত্র হাযরাত আব্দুল্লাহ্ রা.’র সাথে হাঁটতে থাকাকালে এক নারী হাযরাত আবদুল্লাহ্ রা.’র কপাল মুবারাকে চকমকিত এক নূর অবলোকন করেন। তিনি তাঁদের নিকটে এসে হাযরাত আব্দুল্লাহ্ রা.’র সাথে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করত: ১০০উট প্রদানের প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু তাঁরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। হাযরাত আমীনা রা.’র সাথে বিবাহের কিছুদিনপর হাযরাত আবদুল্লাহ্ রা.’র সাথে সে নারীর দেখা হয়ে যায়। কিন্তু এবার সে নারী বিবাহের প্রস্তাবের পরিবর্তে বললেন, ‘আপনার ললাটে আর সে নূর বিদ্যমান নেই’।
[গ্রন্থ সূত্রঃ তাওয়ারিখে ইবনে কাসীর, খণ্ড ২, সীরাতুন্নাবী অধ্যায়; তাবারী ইবনে জারীর র., মীলাদুন্নাবী অধ্যায়।]
❖ আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেন,
হাযরাত রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান, “আমি সর্বদাই পবিত্র ব্যক্তির মাঝে পরিভ্রমন করেছি; অত:পর সর্বশেষ আমার মায়ের কাছে উপনীত হয়ে ভূমিষ্ট হই“।
[গ্রন্থ সূত্রঃ সীরাতুন্নাবী ওয়িলাদাতুন্নাবী কৃত ইবনে কাসীর।]
❖ নিম্নোল্লেখিত ইমামগনও রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম সৃষ্টি হওয়া সম্পর্কে ব্যাক্ত করেছেন :
ইমাম তাবারী, ইবনে কাসীর এবং ইমাম কুরতুবী লিখেছেন, হাযরাত কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, হাযরাত রসূলে কারিম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করছেন :
“সকলের পূর্বেই আমি সৃষ্ট হয়েছিলাম; আর সকল পায়গাম্বরদের পরে আমার আগমন“।
দেখুন, সূরাহ্ আহযাব, আয়াত ৭-এর তাফসির:
– তাফসীর তাবারী;
– তাফসীর ইবনে কাসীর;
– তাফসীর কুরতুবী।
❖ হানাফী মাযহাবের অন্যতম ভাষ্যকার ফকিহ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহ আলাইহি বলেন :
মোদ্দাকথা মানুষ তিন প্রকার:-
(১) খাস বা সর্বশ্রেষ্ট স্তর যেমন আম্বিয়া আলাইহিমুচ্ছালাম।
(২) আউসাত বা দ্বিতয় স্তর যেমন ছাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ ও ছাহাবায়ে কেরাম ছাড়াও অন্যান্য ছালেহীন বা সৎকর্ম পরায়নগণ। (৩) তৃতীয় স্তর, আম বা সর্ব সাধারণ (পূর্বে উল্লেখিত দুই প্রকার ব্যতিত অন্যান্য) মানুষ।
[গ্রন্থ সূত্রঃ রাদ্দুল মুহতার ১/২৮২ নতুন ছাপা ২/৪১১ পৃষ্ঠা।]
ইমাম হাফিজ ইবনে হজর মক্কী হাইতামী আলাইহির রহমত (ওফাত ৯৭৪ হিজরি) তদীয়-‘আদদুর মানদুদ’ নামক কিতাবের ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন : হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানব এর উপর ইজমা হয়েছে। আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেন, “আমি আদম সন্তানের সরদার। এতে আমার কোন গর্ব নেই”।
কাজেই তিনি জাতীতে নূর অর্থাৎ, তাঁর প্রকৃত সত্ত্বা নূর হওয়া সত্ত্বেও মানবীয় পূর্ণতা সহকারেই এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন এবং এ কারণেই তিনি আমাদের মত পানাহার করেছেন, বিবাহ করেছেন, সন্তানাদী হয়েছে এবং মাতা-পিতার মাধ্যমে এ ধরাধামে আগমন করেছেন।
এ মানবীয়তা এবং মানবীক গুণাবলী মহান আল্লাহ্ পাকের অন্যতম কুদরাতরই বহিঃপ্রকাশ।
বুঝা গেলো আমরা সুন্নীরাই সঠিক আকিদা পোষণ করি। আমরা রাসূলের দুই বৈশিষ্ট্যের উপরই বিশ্বাস রাখি।
কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ
অর্থাৎ : আর স্মরণ করুন (সে সময়ের কথা), যখন আল্লাহ নবীদের থেকে তাঁদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, ‘আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দান করবো। অতপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যায়নকারী হিসেবে একজন রাসূল তোমাদের কাছে তাশরীফ রাখবেন। তখন অবশ্যই তোমরা তাঁর প্রতি ইমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ্) বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করে নিয়েছ এবং এর উপর আমার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছ’? তাঁরা (নবীগণ আঃ) বললেন, ‘আমরা স্বীকার করলাম’। (অত:পর) আল্লাহ ইরশাদ করলেন, ‘তবে তোমরা (একে অপরের) সাক্ষী হয়ে যাও’। এবং (আল্লাহ্) ইরশাদ করলেন, ‘আমি নিজেই তোমাদের সাথে (সেই রাসুলের ব্যাপারে) সাক্ষীদের মধ্যে সাক্ষী রইলাম।’
[সূত্রঃ ক্বুরআ’নুল কারিম : সুরা আলে ইমরান, (০৩): আয়াত শরীফ ৮১।]
এই আয়াতে কারীমায় সেই অঙ্গীকারের ইতিহাসই তুলে ধরা হয়েছে, যা আলমে মিসাক বা প্রতিশ্রুতি দিবসে সমস্ত নবীগণের নিকট থেকে নেওয়া হয়েছে।
উক্ত আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় ইমাম জালালউদ্দিন সুয়ুতী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘আল খাসাইসুল কুবরা’ নামক কিতাবের ১ম খণ্ড (উর্দু) ১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন- ‘আল্লামা শেখ তকিউদ্দিন সুবুকী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, উক্ত আয়াতে কারীমায় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজমত, সম্মান ও সুউচ্চ মর্যাদার এত স্পষ্ট বিবরণ প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজমত, সম্মান ও সুউচ্চ মর্যাদার সন্দেহের কোন অবকাশ মাত্র নেই।
সাইয়্যিদুল বাশার, আশ্রাফুল আম্বিয়া, ইমামুল মুর্সালীন প্রিয় নাবী কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ইরশাদ করেন: “আদমের দেহ ও আত্মার মধ্যে সংযোগ স্থাপন হওয়ারও পূর্ব থেকেই আমি নবী”
নোটঃ ইমাম তিরমিযী রহ. হাদিসটি বর্ণনা পূর্বক বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ্, আল হাকিম (২:৬০৯) হাদিসটিকে সহিহ্ বলে মান নির্ধারন করেছেন, ইবনে আবি শায়বাও হাদিসটি তাঁর মুসান্নাফ (১৪:২৯২) এ বর্ণনা করেছেন, আর আল বুখারী হাদিসটিকে তাঁর তারিখ (৭:৩৭৪) এ বর্ণনা করেছেন।
সৃষ্টিকূলে সেরা সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুর্সালীন প্রিয় নাবী কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) আদম (আঃ) নবী হওয়ার পূর্বেই নবী। সহিহ্ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছ: ইরবাদ ইবনে সারিয়া থেকে বর্ণিত যে প্রিয় নবী কারিম প্রিয় নাবী কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ফরমান: আমি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট নবুওয়তের সীল হিসেবে ছিলাম, আদমের দেহ তখনো তৈরি হয় নি।” [সূত্রঃ ইবনে হিব্বানের সহিহ্ সংকলনে ও আল হাকিমের মুস্তাদরাকে হাদিসটি বর্ণনা করা হয়েছে।]
আল্লাহ্ রব্বুল ‘আলামীন, পক্ষান্তরে তাঁর হাবীব তাঁরই সৃষ্টির জন্যে রহমাতুল্লিল ‘আলামীন।
আল্লাহ্ রউফুর রহিম, তাঁর হাবীবকেও করেছেন রউফুর রহিম।
আল্লাহ্ নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আর্দ্ব, অপরদিকে তাঁর হাবীবকে করেছেন নূর বিকিরনকারী সূর্য (সীরাজুম মুনীর) বা নূরের প্রদীপ।