মনের ভাব প্রকাশ করতে মাতৃভাষাই শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা যত সহজ অন্য ভাষায় তত সহজে ব্যক্ত করা যায় না। মহান আল্লাহ্ জাল্লাশানুহুর সৃষ্ট জগতে মানুষই সর্বোত্তম, শ্রেষ্ঠ। মানুষকে আল্লাহ্ মনের ভাব প্রকাশের শক্তি দান করেছেন তিনিই মানুষকে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিক্ষা দিয়েছেন। [সূরা র্আ রাহমান: আয়াত-৩-৪] বিশ্বে অনেক ভাষা প্রচলিত আছে। ইতোপূর্বে বহুভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষকে সত্য পথের সন্ধান দেয়ার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা অসংখ্য নবী-রাসূল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। নবীগণ যে দেশে বা জনপদে এসেছেন সে দেশের বা জনপদের মানুষের মাতৃভাষাতেই উপদেশ বাণী প্রচার করেছেন। রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,
‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর নিজ জাতির ভাষাভাষি করে প্রেরণ করেছি তাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবার জন্য। [সূরা ইব্রাহীম: আয়াত-৪]
এ আয়াতে করীমায় মাতৃভাষার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। ভাষার বৈচিত্রতা আল্লাহ্ পাকের কুদরত ও নিয়ামতেরই অপূর্ব নিদর্শন। এ অপূর্ব নিদর্শন সম্পর্কে পবিত্র ক্বোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- এবং তাঁর (আল্লাহ্) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। [সূরা রুম: আয়াত-২২] করুণাময় আল্লাহ্ পাক যে সকল ছহীফা ও কিতাব নাযিল করেছেন তার সব ক’টিই স্ব স্ব নবী রাসূলগণের মাতৃভাষায়। প্রিয়নবীকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন,
‘আমিতো আপনার ভাষায় ক্বোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পারেন এবং এর দ্বারা চিন্তাপ্রবন সম্ভ্রদায়কে সতর্ক করে দিতে পারেন।’ [সূরা মরিয়ম: আয়াত- ৯৭]
ইসলাম প্রচার-প্রসারে বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশে দেশে ধর্ম প্রচারক দল গেছেন। তাঁরা সেখানকার ভাষা রপ্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন। স্থানীয় ভাষায় ধর্মপ্রচারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। আমাদের প্রিয় নবী আবিসিনিয়ায় একদল সাহাবী প্রেরণের পূর্বে সে দেশের ভাষা আয়ত্ব করার জন্য অত্যন্ত মেধাবী সাহাবী হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমাকে পাঠান। পারস্য দেশ হতে একদল প্রতিনিধি এসে প্রিয় নবীর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। দেশে প্রত্যাবর্তন করার পূর্বে তারা ক্বোরআন পাকের কিছু অংশ ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করার অনুমতি প্রার্থনা করলে নবীজি হযরত সালমান ফার্সী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে অনুবাদ করার নির্দেশ দেন। ইসলামী কিতাবাদি ফার্সী ভাষায় অনুদিত হবার কারণে পারস্য দেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার তরান্বিত হয়, পারস্য দেশীয় কবি শেখ সা’দী, মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী, হাফিজ জামী, আলওয়ারী ও ফেরদৌসি সহ অসংখ্য কবি দার্শনিক ইসলাম সম্পর্কে লেখালেখি করে বিখ্যাত হয়েছেন।
আমীরুল মু’মিনীন হযরত ওমর বিন খাত্তাব’র খেলাফতকালের মধ্যভাগ সময় হতে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় (৬৪০ খ্রি.)। সুদূর আরব, ইয়েমেন, ইরাক, পারস্য, তুরস্ক, মিশর খোরাসান প্রভৃতি ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে যে সকল ধর্ম প্রচারক এদেশে শুভাগমন করেছেন তাঁরা সকলেই স্থানীয় ভাষা কমবেশী রপ্ত করেই এদেশীয় ভাষাতেই ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন।
এদেশে বাংলা সাহিত্য চর্চার সুদূরপ্রসারী অগ্রগতির সুচনা হয় বাংলার সুলতানের একান্ত পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে। এ প্রসংগে ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের একটি উক্তি প্রনিধান যোগ্য। তিনি লিখেছেন মুসলমানের আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমনীর ন্যায় দীন-হীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল। বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর উপক্ষোয় বঙ্গীয় চাষাগণের কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল এবং তৈলধারপাত্র কিংবা পাত্রধার তৈল লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন, তাহারা হর্ষচরিত হইতে ‘হারং দোই সে হরিনি’ প্রভৃতি দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করায় আত্মতৃপ্তি লাভ করিতেছিল।
আমাদের মহানবীর ওপর মাতৃভাষায় ক্বোরআন মজীদ নাযিল করে আল্লাহ্ তা’আলা মাতৃভাষার গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘আমি আপনার ভাষায় ক্বোরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে ওরা উপদেশ গ্রহণ করে। [সূরা দোখান: আয়াত-৫৮] মাতৃভাষার প্রতি ইসলামের গুরুত্ব আরোপ করায় মুসলিমরা যেখানেই গিয়েছেন সেখানকার জনগণের ভাষাকে আপন করে নিয়েছেন এবং তাঁকে যথাযথ পরিচর্যা করার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষিদের দুই-তৃতীয়াংশই মুসলমান।
আমাদের এদেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হন তারা হলেন, আবুল বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম, শফিক প্রমুখ। তারা জীবন উৎসর্গ করে কালোত্তীর্ণ ইতিহাস সৃষ্টি করেন। বাংলা আজ আন্তর্জাতিক ভাষা এবং ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে বাংলা ভাষার গৌরব ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাকে জাতি সংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে বাংলাদেশ সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পরিতাপের বিষয়, বাংলা শুদ্ধ লিখন পঠন সম্পর্কে মাননীয় হাইকোর্ট’র নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই তা রপ্ত করেনি বা করতে চায় না। তারা বাংলা ইংরেজী মিশিয়ে ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়, বিদেশী ভাষা শিক্ষা করা প্রয়োজন বটে, তবে তাও শুদ্ধভাবে রপ্ত করা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। মিডিয়া ও গণমাধ্যম রেডিও এফএম প্রভৃতি এখনো শুদ্ধ বাংলা লিখন পঠনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেনি। মিডিয়া ও রেডিও গণমাধ্যম ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সাংবাদপত্রে ভুল বানান ভুল উচ্চারণ কোনভাবেই গ্রহণ যোগ্য নয়। এ দিকে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডার গার্টেন নামক বিদষুটে নাম সর্বস্ব শিক্ষা নিকেতন ব্যাঙের ছাতার মতো রাতারাতি গজিয়ে উঠছে। শহর মফ:স্বল কোথাও বাকী নেই রমরমা ব্যবসা। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বিত্তবান শ্রেণি হন্যে হয়ে ছুটে চলছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দিকে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীরা হয় ‘না ঘরকা না খটকা।’ অর্থাৎ শুদ্ধ ইংরেজী বা বাংলা কোনটাই রপ্ত করতে পারে না সঠিকভাবে শুধু ড্যাডি, মাম্মী, আন্টী ছাড়া। ইংরেজী বা ভাল বাংলা জানলে সে ভাষায় সে দক্ষ হবে নিঃসন্দেহে, আমাদের দেশে উঠতি পুঁজিপতির ইংলিশ আভিজাত্য হয়ে উঠার প্রতিযোগতায় পড়ে কিম্বুৎ কিমাকার কিছু একটা হয়ে যায়।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে (১৯৭২ ইং) সরকারি দাপ্তরিক ভাষা করার মাধ্যমে বাংলা প্রচলন শুরু হলেও ৭৫ পরবর্তীকালে ইংরেজী সমাদর শুরু হয়।
প্রিয় নবী ফরমান, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। দেশপ্রেম শব্দের মধ্যে মাতৃভাষার প্রশ্নটিও এসে যায়। এর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ থেকে বুঝা যায় মাতৃভাষা বাংলাকে সম্মান দেখানো, বাংলাকে সর্বস্তরে প্রাধান্য দেয়া, এবং মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করা প্রত্যেক দেশেপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য। মাতৃভাষার বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের লক্ষ্য করে মধ্যযুগীয় কবি আবদুল হাকিম বলেছেন:
‘‘যেজন বঙ্গেতে জন্ম হিংসে বংগবাণী
সেজন কারজন্ম নির্ণয় ন জানি।’’
স্মরণ রাখা প্রয়োজন ধর্ম ও মাতৃভাষার মধ্যে কোন বিভেদ নেই। কুপমন্ডুকদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, মাতৃভাষাকে সম্মান দেখাতে হবে, তাহলেই বিশ্বে আমরা গর্বিত জাতি হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধায় গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারব। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন সকলেই মাতৃভাষার ওপরই অধিষ্ঠিত। ধার করা ভাষা তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ও অপমানকর।
২১ ফ্রেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষার জন্য আত্ম দানকারী শহীদদের মাগফেরাত কামনা করি। এ মহান ভাষা দিবসকে সামনে রেখে কবির ভাষায় বলতে চাই-
‘‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই তার ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবেন দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’’
আসুন আমরা সকলেই মাতৃভাষা বাংলার প্রতি যত্নবান হই। এ হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা, সকল স্তরে মাতৃভাষা প্রয়োগ করব, এ হোক অঙ্গীকার।