মূল: জিয়া-ইসলামিক-ডট-কম
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
অনলাইন আরবী রিসোর্স: মওলানা মুহাম্মদ রুবাইয়াত বিন মূসা
*আল্লাহতা’লা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে প্রেরণ করেন তাঁকে সম্মান করার উদ্দেশ্যে*
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বেসাল তথা আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলিত হওয়ার কিছুদিন আগে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হন। আত্ তাবারানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া গ্রন্থগুলোতে এতদসংক্রান্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে, যা নিম্নরূপ:
عَنْ عَلِيِّ بْنِ حُسَيْنٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبِي يَقُولُ: لَمَّا كَانَ قَبْلَ وَفَاةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِثَلَاثَةِ أَيَّامٍ، هَبَطَ عَلَيْهِ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ أَرْسَلَنِي إِلَيْكَ إِكْرَامًا لَكَ، وَتَفْضِيلًا لَكَ، وَخَاصَّةً لَكَ، أَسْأَلُكَ عَمَّا هُوَ أَعْلَمُ بِهِ مِنْكَ، يَقُولُ: كَيْفَ تَجِدُكَ؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَجِدُنِي يَا جِبْرِيلُ مَغْمُومًا، وَأَجِدُنِي يَا جِبْرِيلُ مَكْرُوبًا» . قَالَ: فَلَمَّا كَانَ الْيَوْمُ الثَّالِثُ هَبَطَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ، وَهَبَطَ مَلَكُ الْمَوْتِ عَلَيْهِمَا السَّلَامُ، وَهَبَطَ مَعَهُمَا مَلَكٌ فِي الْهَوَاءِ يُقَالُ لَهُ إِسْمَاعِيلُ عَلَى سَبْعِينَ أَلْفَ مَلَكٍ، لَيْسَ فِيهِمْ مَلَكٌ إِلَّا عَلَى سَبْعِينَ أَلْفَ مَلَكٍ، يُشَيِّعُهُمْ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ أَرْسَلَنِي إِلَيْكَ إِكْرَامًا لَكَ، وَتَفْضِيلًا لَكَ، وَخَاصَّةً لَكَ، أَسْأَلُكَ عَمَّا هُوَ أَعْلَمُ بِهِ مِنْكَ، يَقُولُ: كَيْفَ تَجِدُكُ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَجِدُنِي يَا جِبْرِيلُ مَغْمُومًا، وَأَجِدُنِي يَا جِبْرِيلُ مَكْرُوبًا» . قَالَ: فَاسْتَأْذَنَ مَلَكُ الْمَوْتِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْبَابِ، فَقَالَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ: يَا مُحَمَّدُ، هَذَا مَلَكُ الْمَوْتِ يَسْتَأْذِنُ عَلَيْكَ، مَا اسْتَأْذَنَ عَلَى آدَمِيٍّ قَبْلَكَ، وَلَا يَسْتَأْذِنُ عَلَى آدَمِيٍّ بَعْدَكَ. فَقَالَ: ائْذَنْ لَهُ. فَأَذِنَ لَهُ جِبْرِيلُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَقْبَلَ حَتَّى وَقَفَ بَيْنَ يَدَيْهِ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ أَرْسَلَنِي إِلَيْكَ، وَأَمَرَنِي أَنْ أُطِيعَكَ فِيمَا أَمَرْتَنِي بِهِ، إِنْ أَمَرْتَنِي أَنْ أَقْبِضَ نَفْسَكَ قَبَضْتُهَا، وَإِنْ كَرِهْتَ تَرَكْتُهَا. فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَتَفْعَلُ يَا مَلَكَ الْمَوْتِ؟» قَالَ: نَعَمْ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ أَنْ أُطِيعَكَ فِيمَا أَمَرْتَنِي بِهِ. فَقَالَ لَهُ جِبْرِيلُ؟ عَلَيْهِ السَّلَامُ: إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدِ اشْتَاقَ إِلَى لِقَائِكَ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «امْضِ لِمَا أُمِرْتَ بِهِ» . فَقَالَ لَهُ جِبْرِيلُ: هَذَا آخِرُ وَطْأَتِي الْأَرْضَ،
হযরত আলী ইবনে হুসাইন রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সূত্রে বর্ণিত; তিনি তাঁর পিতা হতে শুনেছেন যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বেসালের তিনদিন আগে জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম তাঁর দরবারে হাজির হয়ে আরয করেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহ পাক আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এবং আপনারই খেদমত করতে আমাকে বিশেষভাবে পাঠিয়েছেন। এ কথা বলার পর জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসুখের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। আজরাইল ফেরেশতা হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এ সময় হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, উনি আজরাঈল ফেরেশতা, জান কবজকারী; আপনার সামনে হাজির হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করছেন। ইতিপূর্বে তিনি কোনো নবী আলাইহিস সালাম-এর কাছে এই অনুমতি প্রার্থনা করেননি, আর ভবিষ্যতেও তিনি কোনো মানবের কাছে এ রকম অনুমতি চাইবেন না। এ কথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাঁকে অনুমতি দিন।
আজরাঈল ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে প্রবেশ করে পরম শ্রদ্ধাভরে দণ্ডায়মান হন এবং আরয করেন, নিশ্চয় আল্লাহ পাক আমাকে আপনার কাছে প্রেরণ করেছেন এবং আপনার যে কোনো হুকুম তা’মিল করার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি যদি আপনার পবিত্র রূহ মোবারককে গ্রহণ করার জন্যে আমায় আদেশ করেন, আমি তা করবো। আর যদি তা করতে আপনি আমায় বারণ করেন, তাহলে তা করা থেকে আমি বিরত হবো।
এমতাবস্থায় জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম বলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! নিশ্চয় আল্লাহতা’লা আপনার সাক্ষাৎ চান। অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ওহে জান কবজকারী ফেরেশতা! তোমাকে যে কাজ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তা সম্পন্ন করো। জিবরীল আলাইহিস সালাম ওই সময় বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এই বারই পৃথিবীতে আপনার কাছে আমার শেষবার ওহী নিয়ে আসা। এই পৃথিবীতে আপনি-ই শুধু আমার ……. এবং ……।১৯.
{অনুবাদকের জ্ঞাতব্য: ওপরের উদ্ধৃতিতে বাক্য মিসিং আছে। পাওয়া গেলে শূন্যস্থানে বসানো হবে। }
*জিবরীল আলাইহিস সালাম কর্তৃক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাত মোবারক চুম্বন*
যোবদাতুল মোহাদ্দেসীন হযরত আবূল হাসানা’ত সাঈদ আবদুল্লাহ শাহ সাহেব নকশবন্দী মোজাদ্দেদী কাদেরী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘মীলাদনামা’ পুস্তকের ১৬২ পৃষ্ঠায় একখানা হাদীস উদ্ধৃত করেন:
একবার হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম খুব উৎফুল্ল ছিলেন। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’হাত মোবারক চুম্বন করছিলেন; আর তাঁর জুব্বা মোবারকের (আস্তিনে) মুখ ঘষছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ওহে জিবরীল, এটি কী? তিনি জবাবে বলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অনুগ্রহ করে মিকাঈল ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করুন। এমতাবস্থায় মিকাঈল আলাইহিস সালাম বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার দরবারে হাজিরা দেয়ার আদেশ যখন আমাদের দেয়া না হয়, তখন আমরা অস্থির হয়ে যাই। আজ আমরা আল্লাহর কাছে হাজার হাজার বার প্রার্থনা করি (হাজিরার অনুমতি চেয়ে)। আমাদের এই বিনীত প্রার্থনা দেখে অন্যান্য ফেরেশতারা আমাদের প্রশ্ন করেন, ওহে জিবরীল ও মিকাঈল, কেন এই অস্থিরতা? আমরা জবাবে বলি, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সৌন্দর্যমণ্ডিত চেহারা মোবারক না দেখলে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। আমরা কী করতে পারি? যেহেতু আজ আমরা সহস্র সহস্র আরজি পেশ করার পর আপনার দরবারে হাজিরা দেয়ার অনুমতি পেয়েছি, সেহেতু আমাদের এই উৎফুল্ল চিত্ত।
*জিবরীল আলাইহিস সালাম কর্তৃক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পায়ের গোড়ালি চুম্বন*
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি পেশকৃত হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম-এর ভক্তিশ্রদ্ধার সেরা নিদর্শন আমরা মে’রাজ রাতে ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণের সময় দেখতে পাই।
মোল্লা মুহাম্মদ মুঈন কাশফী হারাভী রহমতুল্লাহি আলাইহি মে’রাজ সম্পর্কে একটি হাদীস শরীফ বর্ণনা করেন:
দ্বিতীয় বিবরণটি জিবরীল আলাইহিস সালাম হতে; তিনি বলেন, আল্লাহতা’লার ওহী থেকে আমি জানতে পেরেছিলাম যে আমার দেহ জান্নাতের কর্পূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু আমি এর কারণ জানতাম না। মে’রাজ রাতেই (এর কারণ) আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। আমার নির্মলতা ও সূক্ষ্মতা সত্ত্বেও আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঘুম থেকে জাগাতে ইতস্ততঃ করছিলাম; কীভাবে জাগাবো তা নিয়ে আমি ছিলাম উদ্বিগ্ন। হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক পা যুগলের গোড়ালিতে আমার মুখ ঘষতে আমায় আদেশ করা হয়। আমি তা করলে কর্পূরের শীতল পরশ (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কদম মোবারকের) উষ্ণতার সাথে মিশে এবং তিনি সহজে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। ওই সময়-ই আমি অনুধাবন করতে পারি কেন আমাকে কর্পূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ২০
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে জিবরীল আলাইহিস সালাম ২১০০০০ ফেরেশতাসহ হাজির হন*
মে’রাজ রাতে জিবরীল আলাইহিস সালাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এ বিষয়ে তাফসীরে রূহুল বয়ান পুস্তকের ৫ম খণ্ড, ১০৯ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে:
মে’রাজ রাতে জিবরীল আলাইহিস সালাম, মিকাঈল, ইসরাফিল ও আজরাঈল ফেরেশতা হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের-এর দরবারে হাজির হন। তাঁদের প্রত্যেকের সাথে ছিলেন ৭০০০০ ফেরেশতা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকে আরোহণ করলে জিবরীল আলাইহিস সালাম লাগাম হাতে ধরেন, মিকাঈল ধরেন রেকাব, আর ইসরাফিল ধরেন জিন।
*ফেরেশতাবৃন্দ নিজেদের এবাদতের বদলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতের সুযোগ পান*
যোবদাতুল মোহাদ্দেসীন হযরত আবূল হাসানাত শাহ নকশবন্দী কাদেরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ’মীলাদনামা’ পুস্তকে লেখেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, আমি তাঁদের (ফেরেশতাদের) সেবায় বিব্রত বোধ করছিলাম, তাই তা বন্ধ করে দেই। ফেরেশতামণ্ডলী আরয করেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা এই খেদমতের দায়িত্ব নিয়েছি হাজার হাজার বছেরের এবাদত-বন্দেগীর বদলে। একদিন আল্লাহতা’লা আমাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা এই এবাদত-বন্দেগীর পুরস্কার হিসেবে কী পেতে চাও? আমরা আরয করি, আরশে আপনার পবিত্র নামের পাশে যাঁর নাম মোবারক লেখা আছে, তাঁর খেদমত করার তৌফিক দিন। আল্লাহতা’লা এরপর এরশাদ ফরমান, তিনি (হুযূর পাক) ধরাধামে শুভাগমন করলে আমি তাঁকে মক্কা মোয়াযযমা থেকে বায়তুল মোকাদ্দেস পর্যন্ত নিয়ে যাবো। ওই ভ্রমণের সময় তোমাদেরকে তাঁর খেদমত করার অনুমতি দেবো আমি। ফেরেশতাকুল বলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমরা এভাবেই এ খেদমতের সৌভাগ্য অর্জন করেছি।
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর জন্যে ‘ওয়াসতায়ে উযমা’*
জিবরীল আলাইহিস সালাম সবসময়ই কীভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সন্তুষ্ট করবেন, তা নিয়ে চিন্তা করতেন। এই সূত্রেই শেষ বিচার দিবসে তিনি পুল-সিরাতের ওপর তাঁর ডানা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাঁর এই ইচ্ছা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে পেশ করেন।
মে’রাজ রাতে ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণকালে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোনো বন্ধু কি তাঁর বন্ধুকে এ রকম এক জায়গায় পরিত্যাগ করতে পারেন? জিবরীল আলাইহিস সালাম জবাবে বলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি যদি আরেক কদম সামনে অগ্রসর হই, তবে আল্লাহতা’লার নূরের তাজাল্লীতে ভস্মিভূত হবো। অপর এক হাদীস শরীফে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে, যদি আমি এক আঙ্গুলের তালু পরিমাণ জায়গা অগ্রসর হই, তাহলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবো। এমতাবস্থায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আপনার কি কোনো প্রার্থনা আছে যা আপনি আল্লাহর কাছে পেশ করতে ইচ্ছুক? জিবরীল আলাইহিস সালাম উত্তর দেন, হে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি আল্লাহর কাছে আমার এই আরজি পেশ করুন যে পুল-সিরাতে আমি যেন আমার ডানা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি পাই, যাতে আপনার উম্মত সহজে তা পার হতে পারেন।
*হযরত ইবরাহিম খলীলউল্লাহ আলাইহিস সালাম-এর প্রতি খেদমতের পুরস্কার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করলেন দান*
ইমাম যুরকানী মালেকী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া’ পুস্তকে একটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা নিম্নরূপ:
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত; হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করো (এবং শেখো), আমি তোমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবার আগেই। আমাকে জিজ্ঞেস করো সেই জ্ঞান সম্পর্কে যার খবর না জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর কাছে আছে, না মিকাঈলের। আল্লাহতা’লা মে’রাজ রাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যে সব জ্ঞান শিখিয়েছিলেন, তা থেকে হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে শিখিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার প্রভু খোদাতা’লা আমাকে বিভিন্ন জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অতঃপর বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এ কথা জানান এবং তিনি আরও বলেন, আমি ছিলাম হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর মোবারক দেহের পিঠে অবস্থিত এক নূর (জ্যোতি)। নমরুদ যখন তাঁকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলার উপক্রম, ঠিক তখন-ই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে আসেন এবং বলেন, ওহে খলীলউল্লাহ (আল্লাহর বন্ধু), আপনার কি কোনো (সাহায্যের) প্রয়োজন আছে? তিনি উত্তর দেন, ওহে জিবরীল আলাইহিস সালাম, আপনার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। জিবরীল আলাইহিস সালাম দ্বিতীয়বার আবার আসেন। এবার তাঁর সাথে মিকাঈল-ও ছিলেন। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বলেন, আপনার বা মিকাঈলের কারোরই প্রয়োজন নেই আমার। জিবরীল আলাইহিস সালাম তৃতীয়বার আবার এসে বলেন, আপনার প্রভু খোদাতা’লার কাছে কি আপনার কোনো গুজারিশ আছে? ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বলেন, ভাই জিবরীল আলাইহিস সালাম, বন্ধুর নিদর্শন হচ্ছে তাঁর বন্ধুর ইচ্ছা অমান্য না করা। এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক আমার (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) জবান (মোবারক) খুলে দেন এবং আমি বলি, আমি যখন ধরাধামে আবির্ভূত হবো, আর আল্লাহ পাক আমাকে রেসালাতের উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবেন, আর সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-এর ওপর আমাকে মহা সম্মানিত করবেন, তখন আমি আমার পিতা (পূর্বপুরুষ) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর প্রতি খেদমতের প্রতিদানস্বরূপ জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে পুরস্কৃত করবো। অতঃপর আমাকে আল্লাহতা’লা দুনিয়াতে পয়গম্বর হিসেবে প্রেরণের পর মে’রাজ রাত এলো। জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার দরবারে হাজির হলেন এবং আমার সাথে অবস্থান করলেন, যতোক্ষণ না এক বিশেষ স্থানে আমরা পৌঁছুলাম। সেখানেই তিনি থেমে গেলেন। আমি জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে জিজ্ঞেস করলাম, এ রকম জায়গায় কি কোনো বন্ধু তাঁর বন্ধুকে পরিত্যাগ করেন? জিবরীল আলাইহিস সালাম উত্তরে বল্লেন, আমি যদি এ জায়গা হতে আরও অগ্রসর হই, তবে আল্লাহতা’লার নূরের তাজাল্লী আমাকে পুড়িয়ে খাক করে দেবে। অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বল্লেন, ওহে জিবরীল আলাইহিস সালাম, আল্লাহতা’লার কাছে আপনার কি কোনো আবেদন আছে পৌঁছে দেয়ার? জিবরীল আলাইহিস সালাম জবাব দিলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অনুগ্রহ করে আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করুন যেন আমি আখেরাতে পুল-সিরাতের ওপর আমার ডানা মেলে ধরতে পারি, যাতে আপনার উম্মত সহজেই তা পার হয়ে যেতে পারেন।
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আশীর্বাদপ্রার্থী জিবরীল আলাইহিস সালাম*
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম যেভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজিরা দেয়ার সময় আদব বজায় রাখার বিষয়টি (সবসময়) বিবেচনা করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘সিদরাতুল মোনতাহা’য় অধিষ্ঠানকেও তিনি তাঁর নিজের জন্যে আশীর্বাদ লাভের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন।
মোল্লা মুঈন কাশফী হারাভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর কৃত ‘মা’আরিজ-উন্-নবুওয়াহ’ পুস্তকে (এতদসংক্রান্ত) একটি হাদীসের উল্লেখ করেন:
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, হে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার একটি আরজি আছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমায় বলুন তা কী। জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, আমার (একান্ত) অনুরোধ, আপনি এখানে দু’রাক’আত নামায পড়ুন, যাতে আমার আবাসস্থল আপনার পবিত্র পায়ের ধুলো দ্বারা আশীর্বাদধন্য হয়। ২১
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সুরক্ষা চাইতে জিবরীল আলাইহিস সালাম আদিষ্ট*
নুযহাতুল মাজালিস গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা নিম্নরূপ:
أوحى الله تعالى إلى جبريل قف على قدم العبودية واعترف بعز الربوبية وامرح في ميدان شكري واعلم عظم قدري فقد مننت عليك فاستمع بما يوحى إليك فقال يا رب أنت اللطيف وأنا العبد الضعيف فقال خذ علم الهداية وبراق العناية وخلعة القبول وطيلسان الرسالة ومنطقة الجلالة وانزل مع سبعون ألف ملك إلى محمد صلى الله عليه وسلم فقم ببابه ولذ بجنابه فأنت الليلة صاحب ركابه ويا ميكائيل خذ علم السؤال وانزل مع سبعين ألف ملك إلى باب حجرة الرسول صلى الله عليه وسلم ويا إسرافيل ويا عزرائيل افعلا كما فعل جبريل وميكائيل زد من نور الشمس على نور القمر أي ضوء القمر ومن القمر على نور الكواكب فقال يا رب أقرب قيام
আল্লাহতা’লা জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে আদেশ করেন, ওহে জিবরীল আলাইহিস সালাম! হেদায়াতের নিশান তথা পতাকা, কল্যাণের বোররাক, মহাসম্মানের পোশাক, নবুওয়্যতের আলখেল্লা ও (আধ্যাত্মিক) রাজসিকতার পাগড়ী (এমামা) নিয়ে ৭০০০০ ফেরেশতার মিছিলসহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হও! তাঁর দ্বারে দাঁড়িয়ে তাঁরই সুরক্ষা প্রার্থনা করো। এ রাতে তোমাকে তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরতে হবে। ওহে মিকাঈল! তুমি (খোদায়ী) রেযামন্দির ঝাণ্ডা নিয়ে ৭০০০০ ফেরেশতার মিছিলসহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হও! ওহে ইসরাফিল ও আজরাঈল! তোমরা দু’জন-ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি একই রকম খেদমত পেশ করো। ২২
ইমাম সৈয়ুতী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রণীত ‘খাসাইসুল্ কুবরা’ গ্রন্থে এবং ইমাম তাবারানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কৃত ‘মো’জাম-এ-আওসাত’ ও ‘মজমাউয্ যাওয়াইদ’ পুস্তকগুলোতে একখানা হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে যা বিবৃত করে:
উম্মুল মো’মেনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, আমি পূর্বদিক হতে পশ্চিমদিক পর্যন্ত চষে বেরিয়েছি, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো এতো বড় (সেরা) মহাত্মা কাউকেই খুঁজে পাইনি।২৩
*’ফাহামাযানী বি কাদামিহী’ বাক্যটি সম্পর্কে গবেষণা*
মে’রাজ রাতে জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম-এর আসমান থেকে অবতরণ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসা পর্যন্ত এবং পুরো ভ্রমণকাল যাবৎ তিনি ছিলেন হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মূর্ত প্রতীক। তিনি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখেন। শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সামান্যতম গাফিলতি-ও তাঁর তরফ থেকে হয়নি।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে জিবরীল আলাইহিস সালাম আসেন আলতোভাবে পা ফেলে এবং তিনি হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র পায়ের গোড়ালিতে নিজ গণ্ড ঘর্ষণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে ’সীরাতে ইবনে হিশামের’ মতো কিছু সীরাহ (জীবনী) পুস্তকে ’ফাহামাযানী বি কাদামিহী’ (فَاهَمَزَانِي بِقَدَمِهِ) মর্মে বাক্যটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু লোক এটিকে অনুবাদ করেছে এভাবে – ‘জিবরীল আলাইহিস সালাম আমাকে (ঘুম থেকে) জাগাতে আমায় লাথি মেরেছিলেন।’ এই অনুবাদ সম্পূর্ণ ভুল এবং যুক্তিপরিপন্থী; আর আমাদের কাছে যা নির্ভরযোগ্য রওয়ায়াত দ্বারা বর্ণিত হয়েছে তারও পরিপন্থী এটি। কোনো মুসলমান-ই এভাবে চিন্তা করতে পারেন না। কেননা, এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একদম খেলাফ। আর এটি জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর মতো মহান ফেরেশতার প্রতি মিথ্যা অপবাদ-ও। এ কারণেই এই বাক্যের ভাষাতত্ত্বগত গবেষণার অবতারণা করা হলো নিচে।
প্রথমে যে বিষয়টি জানা দরকার তা হলো, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম-দেরকে এমন-ই আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা দ্বারা জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন ’সিদরাহ’ থেকে অবতরণের প্রস্তুতি নেন, তখন এই দুনিয়াতে থেকেই তাঁরা তাঁর গন্ধ শুঁকতে পান এবং বুঝতে পারেন যে জিবরীল আলাইহিস সালাম অবতরণ করতে যাচ্ছেন। আল্লামা শেহাবউদ্দীন খাফফাজী নিজ ‘নাসীম আল-রিয়ায’ পুস্তকে লেখেন:
সার কথা হলো, আম্বিয়া কেরাম আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের অন্তর (আধ্যাত্মিকতা) ও তাঁদের বোধশক্তি ফেরেশতাসদৃশ। এ কারণেই তাঁরা দুনিয়ার শেষ সময় পর্যন্ত যা যা ঘটবে তা তা (দিব্যদৃষ্টিতে) দেখতে পান, আসমানের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শুনতে পান এবং জিবরীল আলাইহিস সালাম আসমান থেকে অবতরণের সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা তাঁর গন্ধ শুঁকতে পান। ২৪
একই পুস্তকে কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত, হাদীস শরীফ এবং ইমামবৃন্দের ও সাহাবা-এ-কেরাম মণ্ডলীর বাণী ও শরয়ী সিদ্ধান্ত দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা হয়েছে যে জিবরীল আলাইহিস সালাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পছন্দকৃত একজন সেবক। তাঁকে আল্লাহ পাক-ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে নিয়োগ করেছেন। তিনি এক চুল পরিমাণ-ও হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন হতে বিচ্যুত হন না। অতএব, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঘুম থেকে জাগাতে এ রকম অশিষ্ট আচরণ তিনি করতে পারেন বলে কি কখনো ধারণাও করা যায়? ইসলাম হলো এমন এক ধর্ম, যেটি সভ্যতা-ভব্যতা শিক্ষা দেয়। একজন সাধারণ মুসলমানকেও এভাবে ঘুম থেকে জাগানো ইসলামী শিষ্টাচারের খেলাফ।
*আলোচ্য বাক্যটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ*
আরবী ‘হামাযা’ শব্দটির একাধিক অর্থ আছে। সেগুলোর মধ্যে ‘হিমস্’ একটি, যার মানে হলো মৃদু বা আলতো পায়ে হাঁটা, হালকা কদম ফেলে এগোনো, ধীরে ধীরে কথা বলা, অন্তরে উদ্রেক হওয়া, কোনো কিছু অপসারণ করা, চাপ দেয়া, কারো আড়ালে গিয়ে তার সমালোচনা করা ইত্যাদি।
আল্লামা ইবনে মনযূর কর্তৃক বর্ণিত উক্ত শব্দের এতোগুলো অর্থের মধ্যে হাল্কা বা মৃদু পায়ে হাঁটা একটি। [‘লিসানুল আরব’, হারফুয যা, হা মীম যা]
এই শব্দটির ব্যাপারে আরবী ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক ইমাম আল্লামা যোহরী নিজ ‘সিহাহ’ পুস্তকে, আল্লামা ইবনে ফারাস তাঁর ‘মাকায়ীস-উল-লোগাত’ বইতে লিখেছেন এবং ’মোখতার আস্ সিহাহ লির্ রাযী’ গ্রন্থেও লেখা আছে যে এর অর্থ মৃদু পায়ে হাঁটা। ‘আল-মোনজিদ’, ’মো’জাম আল-ওয়াসীত’ বইগুলোও একই কথা লিখেছে।
সবগুলো অভিধান যেখানে ওই শব্দটিকে মৃদু পায়ে হাঁটা হিসেবে বর্ণনা করেছে, সেখানে সমস্ত তথ্যকে অবজ্ঞা করে তাকে ‘লাথি’ হিসেবে অনুবাদ করা কতো-ই না বড় ভুল কাজ! এটি ভাষা-সাহিত্যের পাশাপাশি শরীয়ত হতেও বিচ্যুতি বৈ কী! বস্তুতঃ হাদীসে ব্যবহৃত শব্দাবলী সব সময়-ই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রাপ্য সম্মান ও শোভনতা-শালীনতা বজায় রেখে বুঝতে হবে এবং সেভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। তাই ‘ফাহামাযানী বি-কাদামিহী’ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে ‘জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার কাছে আসেন মৃদু পায়ে হেঁটে।’
এই শব্দের আরেকটি মানে হলো অন্তরে উদ্রেক হওয়া। ফলে রূপকার্থে এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘আমি তাঁর আগমন নিজ অন্তরে অনুভব করেছিলাম।’
কোনো সেবক তার মনিবের দরবারে পরম শ্রদ্ধা ছাড়া আর অন্য কোনোভাবে হাজির হন না। কাউকে লাথি মারা কোনো জাতি কিংবা সমাজেই গৃহীত বা গ্রহণযোগ্য নয়; আর এটি বেআদবি বা অসম্মানসূচক আচরণ হিসেবেই বিবেচিত।
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষেত্রে সৎ উদ্দেশ্যে হলেও দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহার পরিহার্য*
কুরআন মজীদে একটি আয়াতে করীমা আছে, যার ব্যাখ্যায় শায়খুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ আনওয়ারউল্লাহ ফারূকী লেখেন:
সার কথা হলো, সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম এই শব্দটি (’রায়িনা’) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষেত্রে অত্যন্ত নেক উদ্দেশ্য নিয়ে ও যথাযথ ভক্তি সহকারে উচ্চারণ করতেন, কিন্তু তা আরেক ভাষায় শ্লেষাত্মক হওয়ার কারণে আল্লাহতা’লা তার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। সবাই এখানে বুঝতে সক্ষম, যে শব্দটি কোনো রকম অসম্মানের ইঙ্গিত-ও বহন করেনি, অন্য আরেকটি ভাষায় হেয়করণে ব্যবহৃত হওয়ায় তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় যে সব শব্দের উদ্দেশ্য অসম্মানসূচক, সেগুলোকে কীভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া যায়? কেউ যদি বলে, ওই নিষেধাজ্ঞা শুধু ইহুদীদের প্রতি আরোপিত হয়েছিল এই মর্মে যে তারা তা ব্যবহার করতে পারবে না, তাহলে আমি বলবো, হয়তো তা হতে পারে; কিন্তু এ-ও তো অস্বীকার করার জো নেই যে ওই নিষেধাজ্ঞা মুসলমানদের প্রতি-ও ছিল, যাঁরা শব্দটিকে সম্মানার্থে ব্যবহার করতেন। এখানে (আয়াতে) ইহুদী ও তাদের ভাষার কোনো উল্লেখ-ই নেই। যদি তা-ই উদ্দেশ্য হতো, তাহলে ইহুদীদের অন্যান্য বদমাইশির মতো এটিরও উল্লেখ থাকতো। মুসলমানদেরকে সম্বোধন করায় বোঝা যায় যে সৎ উদ্দেশ্যেও এই ধরনের শব্দ ব্যবহারের অনুমতি নেই। [আনওয়ার-এ-আহমদী, ২২২ পৃষ্ঠা]
পবিত্র কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সামান্যতম অসম্মান প্রদর্শন বা অশ্রদ্ধা জ্ঞাপনও কারো ঈমান ধ্বংস করতে পারে; আর ওই ব্যক্তি তা বুঝতেও পারবে না। এরশাদ হয়েছে –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
– হে ঈমানদার মুসলমান! নিজেদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু কোরো না ওই অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)-এর কণ্ঠস্বরের ওপর এবং তাঁর সামনে চিৎকার করে কথা বোলো না, যেভাবে তোমরা একে অপরের সামনে করে থাকো, যেন কখনো তোমাদের কর্মসমূহ নিষ্ফল না হয়ে যায়, আর (এতে) তোমাদের খবরও থাকবে না। ২৫
এই আয়াতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে পূর্ণ শ্রদ্ধাজ্ঞাপক শুধুমাত্র যে সব বাক্য ব্যবহার করা যাবে, সেগুলোর ব্যাপারেই আল্লাহ পাক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি আরও এরশাদ ফরমান:
لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الَّذِينَ يَتَسَلَّلُونَ مِنْكُمْ لِوَاذًا فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
– (ওহে মুসলমান)! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আহ্বানকে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তেমনি স্থির কোরো না, যেমনটি তোমরা একে অপরকে ডেকে থাকো। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন যারা তোমাদের মধ্যে চুপে চুপে বের হয়ে যায়, কোনো কিছুর আড়াল গ্রহণ করে। সুতরাং যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা যেন ভয় করে (এই মর্মে) যে কোনো বিপর্যয় তাদেরকে পেয়ে বসবে, অথবা তাদের প্রতি (আখেরাতে) বেদনাদায়ক শাস্তি পতিত হবে। ২৬
যদি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আহ্বান করা আমাদের পরস্পরের মাঝে ডাকাডাকি তথা সম্বোধনের মতো না হয়, তাহলে তাঁর ব্যক্তিত্ব কীভাবে আমাদের, অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের ব্যক্তিত্বের মতো হতে পারে? তাঁর সামনে সামান্য একটু উচ্চস্বরে কথা বল্লেও ঈমানহারা ও আমল বরবাদ হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতেও স্পষ্ট হয় যে হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন অনুসারী, সেবক ও উজির ছিলেন। এই কারণেই তিনি হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজিরা দেয়ার সময় হয়েছিলেন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মূর্ত প্রতীক। তিনি (সর্বদা) দরুদ-সালাম প্রেরণ করে তাঁর দরবারে প্রবেশের অনুমতি চাইতেন। বোখারী ও মুসলিম শরীফে এতদসংক্রান্ত একখানি সর্বসম্মত হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা’তে বিবৃত হয়:
একবার হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হন; তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর হাত দুটো নিজ পায়ের উপরিভাগে স্থাপন করেন। অতঃপর তিনি হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঈমান, ইসলাম, এহসান, কেয়ামত ও কেয়ামতের নিদর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সেসব প্রশ্নের উত্তর দ্বারা পুরস্কৃত করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-কে বলেন,
هَذَا جِبْرِيلُ جَاءَ لِيُعَلِّمَ النَّاسَ دِينَهُمْ
উনি জিবরীল আলাইহিস সালাম। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের ধর্ম শেখাতে এসেছিলেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন জিবরীল আলাইহিস সালাম আমাদেরকে আমাদের ধর্ম শেখাতে এসেছিলেন। প্রশ্ন হলো, এখানে ধর্ম তথা দ্বীন শিক্ষা দেয়ার কথা বলে কী বোঝানো হয়েছে? জিবরীল আলাইহিস সালাম তো সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-কে ইসলাম ধর্মের বিধিনিষেধ কোনো কিছুই শেখাননি। খোদ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই এগুলো জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর নিজে নিজে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাহলে জিবরীল আমিন আলাইহিস সালাম কী শেখালেন? এর উত্তর পরিষ্কার। জিবরীল আলাইহিস সালাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে পরম ভক্তিভরে হাজিরা দিয়েছেন এবং নিজের আরজি তাঁর বরাবরে পেশ করেছেন। তিনি গোটা উম্মতে মুহাম্মদীকে শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজিরা দিতে হয় এবং কীভাবে তাঁর কাছে ফরিয়াদ করতে হয়। এই সম্মান প্রদর্শন ও আদবশীলতাকেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘দ্বীন’ বা ধর্ম হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং তাঁর সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-কে বলেছেন: উনি জিবরীল আলাইহিস সালাম। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের ধর্ম শেখাতে এসেছিলেন।
আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসীলায় মুসলমান সমাজকে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তা’যিম তথা সম্মান প্রদর্শনের দিকনির্দেশনা দিন এবং ইসলামী বিধিবিধান মানারও তৌফিক দিন, আমীন।
*সমাপ্ত*