লেখকঃ আবুল কাশেম মুহাম্মদ ফজলুল হক
উপাধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়বিয়া কামিল মাদ্রাসা
• হাম্মাদ ইবনে সালামা- সাবিত- আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, একব্যক্তি প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জ্ঞিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘আমার বাবা কোথায় আছেন’? বললেন, জাহান্নামে। ঐ ব্যাক্তি ফিরে যাওয়ার সময় প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে বললেন, “নিশ্চয় তোমার বাবা এবং আমার বাবা জাহান্নামে”।
• এই হল সহি মুসলিম শরীফের পুরো হাদিসটি।
এই হাদীসের আলোকে এক শ্রেণীর লোক প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আব্বা ও আম্মার ব্যাপারে ভীষন রকমের অশোভন শব্দ ব্যবহার করে থাকে এবং বলে, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মা-বাবা জাহান্নামী। নাউজুবিল্লাহ! তারা একবারও ভাবলো না যে, সাধারণ কোন মানুষকেও যদি বলা হয় ‘তোমার মা-বাবা জাহান্নামী’; অথবা ‘তুমি জাহান্নামীর সন্তান’ তাহলে ঐ ব্যক্তি অনেক অপমানিত হয় ও কষ্ট পায়। অথচ এই শব্দগুলোই তারা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মা-বাবা সর্ম্পকে বলে থাকে যা নিশ্চিতভাবে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে অপমান করা ও তাঁকে কষ্ট দেয়ার শামিল।
আর সাধারণ মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য তারা এই হাদীসটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তারা বলে, দেখুন এটা সহি মুসলিম শরীফের হাদীস। নবী নিজেই বলেছেন তাঁর বাবা জাহান্নামে আছে। আর আপনারা বলছেন নবীর মা-বাবা জান্নাতী! বেচারা সাধারণ মানুষ মুসলিম শরীফের কথা শুনেই মাথা হেট। মুসলিম বলে কথা!
বুখারী ও মুসলিমের ‘গুডউইল’ ইদানিং কালে সাধারণকে বিভ্রান্ত করার কার্যকর হাতিয়ার হয়ে যাচ্ছে কোথাও কোথাও!! ফুলের মধ্যেও কখনো কখনো দাগ থাকে! দীন বিশারদদের কাছে শুধু বুখারী ও মুসলিমে থাকাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল দলীলের মান ও শক্তি। বুখারী মুসলিমের হাদীস থেকে অন্য কিতাবের হাদীস মানগত দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী হলে সেক্ষেত্রে শুধু বুখারী মুসলিমে উল্লেখ থাকাটাই ঐ হাদীসের গ্রহনযোগ্যতা দিতে পারে না। বরং অন্য কিতাবের ঐ শক্তিশালী হাদীসটা বুখারী মুসলিমের হাদীসের উপর প্রাধান্য পাবে। এটাই হাদীসবিদগনের শেষ কথা। আবার বুখারী মুসলিমের কোন হাদীস যদি কোরআনের অকাট্য দলিলের বিপরীত হয় তাহলেও বুঝতে হবে ঐ হাদীস মানসুখ কিংবা অন্য কোন কারণে সহি হওয়া সত্তেও আমল যোগ্য নয়। আমল হবে পবিত্র কোরআনের নসের উপর। এগুলো মিমাংসিত সর্বজন গ্রহণযোগ্য নীতি। সে কারণে হাদীস সহি হওয়ার পরও নীতিমালার কারণে কখনো কখনো তা আমল যোগ্য হয় না। ঐ নীতিমালা বিশ্লেষণ করেই এক হাদীসের উপর আরেক হাদীসকে প্রাধান্য দিতে হয়। শুধু বুখারী বা মুসলিমে উল্লেখ থাকাই হাদীসের প্রাধান্য পাওয়ার শেষ কথা নয়।
সহি মুসলিমের এই হাদিসটিও এই রকমই। কারণ এই হাদীসেটি অন্য সনদেও বর্নিত হয়েছে যেখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাবাজান ‘জাহান্নামী’ হওয়ার কথাটি উল্লেখ নাই। সেখানে ঐ প্রশ্নকারীর জবাবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “ যখন তুমি কোন কাফেরের কবরের পাশ দিয়ে যাবে তখন তাকে জাহান্নামের সংবাদ দাও”।
• এই হাদীসের সনদঃ
• ‘মা’মার➡সাবিত➡আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’।
এবং মুসলিম শরীফের হাদীসের সনদ লক্ষ করুন যেখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাবা জাহান্নামী হওয়ার কথা আছে তার বর্ণনাকারী,
• হাদিসটির সনদঃ
• ‘হাম্মাদ ইবনে সালামা➡ সাবিত➡আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’
লক্ষ করুন, যেখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাবাজান জাহান্নামী হওয়ার কথা উল্লেখ আছে সেই হাদীসের বর্ণনাকারী ‘হাম্মাদ ইবনে সালামা’। যেখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাবার জাহান্নামী হওয়ার কথা নাই তার বর্ণনাকারী ‘মা’মার’। আর হাদীসবিশারদগণ সবাই জানেন ‘হাম্মাদ বিন সালমা’র তুলনায় ‘মা‘মার’ অনেক বেশী শক্তিশালী রাবী তথা বর্ণনাকারী।
কারণ হাম্মাদের স্বরণশক্তি নিয়ে হাদিস বিশারদগন নির্ভরশীল ছিলেন না। তার পক্ষ থেকে এ কারণেই অনেক ‘মুনকার’ হাদীসও বর্ণিত হয়েছে, যা একজন বর্ণনাকারীর গ্রহনযোগ্যতা নষ্ট করে। এ সকল কারণে ইমাম বুখারী তার বুখারী শরীফে হাম্মাদের কোন বর্ণনা গ্রহন করেননি। ইমাম মুসলিম সাবিতের বর্ণনা সূত্র ছাড়া হাম্মাদের বর্ণনা মুল হাদীসে গ্রহন করেননি।
তার বিপরীতে ‘মা’মার’। যার বর্ণনায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আব্বাজান জাহান্নামী হওয়ার কথা নাই। তিনি এ রকম যে কোন ক্রটি থেকে মুক্ত। সে কারনেই ইমাম বুখারী ও মুসলিম ব্যাপকভাবে তাঁর বর্ণনা গ্রহন করেছেন।
সুতরাং হাম্মাদের তুলনায় মা’মার অনেক বেশী শক্তিশালী বিধায় মা’মারের বর্ণনাটি গ্রহনযোগ্য এবং হাম্মাদের হাদীসটি- সেখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আব্বাজান ‘জাহান্নামী’ হওয়ার কথা আছে- তা গ্রহনযোগ্য নয়।
এছাড়াও ইমাম বাজ্জার, তাবরানী, বায়হাকী এই হাদীসটি আরেকটি সূত্রে বর্ণনা করেছেন। যেখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আব্বাজান জাহান্নামী হওয়ার কথার উল্লেখ নাই।
• এই বর্ণনার সনদ,
• “ইব্রাহিম ইবনে সাদ➡ জুহরী➡ আমের ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস➡ সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস”।
এই সনদটিও অনেক শক্তিশালী যা বুখারী ও মুসলিমের গৃহীত নীতিমালার মানের হওয়ার কারণে ‘হাম্মাদ ইবনে সালামা’র বর্ণিত হাদীস থেকে অগ্রগামী।
ইমাম ইবনে মাযাহও এই হাদীসটি আরেকটি সনদে বর্ণনা করেছেন।
• এই বর্ণনার সনদ,
• “ ইব্রাহিম ইবনে সাদ➡জুহরী➡সালেম➡আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু”। এই সনদটিও অনেক শক্তিশালী।
এই সনদে বর্ণিত হাদীসেও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আব্বাজান জাহান্নামী হওয়ার কথা নাই। সুতরাং দূর্বলতার কারণে এবং তার বিপরীতে অধিকতর শক্তিশালী সনদ থাকার কারণে হাম্মাদ ইবনে সালামার হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য।
এই হাদীসটির ‘আমার বাবা এবং তোমার বাবা জাহান্নামী’ অংশটিকে ইমাম জালালউদ্দিন সুয়ুতী বর্ণনাকারীর বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি নয়।
সুতরাং এই হাদীসের আলোকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আব্বাজানকে জাহান্নামী বলার কোন সুযোগ নাই। কারণ এই হাদীসটি আমলযোগ্য নয়। বরং আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আব্বাজান ও আম্মাজান উভয়ই কোরআন ও হাদীসের অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে জান্নাতি।
তথ্য সূত্র: মাসালেকুল হুনাফা, কৃত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রাহঃ)