প্রসঙ্গ নূর (Noor) : প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم)
আমরা আহলুস সূন্নাহ্ সালাফে সালিহীনদের বুঝ (understandinng) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকি।
ক্বুরআ’নুল কারিম ও সূন্নাহর সঠিক চর্চার ক্ষেত্রে তাঁদের সীরত্ব থেকে তথা তাঁদের রচিত কিতাবাদির মাধ্যমে আমরা ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারি।
ইহাকে ক্বুরআ’নুল কারিমের হিদায়াত (Guidance) অনূসারে “মাআস সাদিক্বীন (to be with the True Believers) বা সাদিক্বীনদের সঙ্গে থাকা“ বুঝায়। ইহাকে সীরত্বল মুস্তাকিমও বলা হয়। এইরুপ চর্চাই হচ্ছে সর্বযুগে সবচে’ নিরাপধ চর্চা।
আমরা আহলুস সূন্নাহ্ বিশ্বাস করে থাকি যে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে “নূর (Noor)“ সম্বোধন করা বৈধ।
ক্বুরআ’নুল কারিমে আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর সম্বোধনে (calling) “নূর (Noor)“ শব্দটিকেই নির্বাচন করেছেন।
সাহাবায়ে ক্বিরাম রা. প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে প্রায় সময় “নূর (Noor)“ সম্বোধনই করতেন।
অথচ বর্তমানে যারা এই সম্বোধনকে মানে না তারা মিথ্যা অভিযোগ করে বলে যে আমরা তাঁকে মানবজাতি হিসেবে মানি না।
ইহা তাদের নিরেট মিথ্যাচার ব্যতীত কিছুই নয়।
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে যারা মানবজাতির বিশ্বাস করে না তারা ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়; কুফরে নিপতিত হয়।
আহলুস সূন্নাহ্ ওয়াল জামা’আতের আক্বিদা-বিশ্বাস হলো প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) হলেন একই সময়ে “মানব ও নূর“। তিনি মানবের নাবী, জ্বীনদের নাবী, ফিরিশ্তাদেরও নাবী।
ক্বুরআ’নুল কারিম থেকে প্রমাণ :
আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) ইরশাদ করেন :
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ ۚ قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ
হে আহলে-কিতাবগণ! তোমাদের কাছে আমার রাসূল আগমন করেছেন! কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে, তিনি তার মধ্য থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করেন এবং অনেক বিষয় মার্জনা করেন।
তোমাদের কাছে একটি নূর (Noor) এসেছে এবং একটি সুস্পষ্ট গ্রন্থ।
*_* সূরাহ্ আল মায়িদাহ্, ৫ : ১৫।
ইমাম তাবারী রহ. ও ক্বাজী শাওকানী রহ. এই আয়াত কারিম সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের অভিমত প্রকাশ করে স্ব-স্ব কিতাবে লিখেন, এই আয়াত কারিমে বর্ণিত “নূর (Noor)“ শব্দটি আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর মুবারাকময় সত্তাকে ইঙ্গিত করে বুঝানো হয়েছে; আর জুজাগ রহ.-ও অনূরুপ অভিমত জানিয়েছেন।
গ্রন্থ সূত্র :
উক্ত আয়াতের অধীনে
*_* ইমাম আত তাবারী রহ., তাফসীর তাবারী;
*_* ক্বাজী শাওকানী রহ., তাফসীর ফাৎহুল ক্বাদীর।
উপরোক্ত সাক্ষ্য-প্রমান (evidence) এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হলো যে, রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে “নূর (Noor)“ সম্বোধন (calling) করাতে কোনো সমস্যা নেই, বরং তা বৈধ। আর ইহাতে শিরিক, কুফরের বিন্দুমাত্র আশঙ্কা নেই, যেরুপ বর্তমানের কতিপয় ব্যক্তি মনে করে থাকে।
হাদিস থেকে প্রমাণ :
ইমাম তিরমিযী রহ. বর্ণনা করেন যে, প্রিয় নবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) যখন হাস্যজ্জ্বোল হতেন তখন মনে হতো যেন তাঁর দাঁত মুবারাক থেকে নূরের আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* শামায়েলে তিরমিযী দ্রষ্টব্য।
আল্লামা ইবনু আল-জাওজী লিখেছেন :
হযরত আদম আ.-কে যখন সৃষ্টি করা হচ্ছিলো তখন তাঁর মুবারকময় কপালে প্রিয় নবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর নূর স্থাপন করা হয়; হযরত আদম আ. তা অবলোকন করলেন।
হযরত আদম আ. জানতে চাইলেন, কে তিনি?
আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) জানালেন : তিনি সর্বশেষ নাবী; তিনি তোমার সকল সন্তানদের থেকে মর্যাদাবান বা ঈমাম বা সাইয়্যিদ হবেন।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনু আল-জাওজী, আল ওয়াফা; অধ্যায় মীলাদুন্নাবী (صلى الله عليه و آله وسلم)।
হাফিয ইবনু কাছির লিখেন :
হযরত আবু হুরয়রা রা. থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, একদিন প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) আমাকে হযরত হাসান রা. ও হযরত হুসাইন রা. কে তাঁদের মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে বললেন।
তাঁদেরকে নিয়ে রওয়ানা হলে দরজায় না পৌঁছা পর্যন্ত দেখলাম নূর আমাদের সাথে সাথে পথ দেখিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, তারিখ আল ইবনূ কাসীর ও সীরাতুন্নাবী (صلى الله عليه و آله وسلم), অধ্যায় মু’জিযাত।
হাফিয ইবনূ কাসীর লিখেন :
মুহাম্মাদ ইবনূ হামজা রা. থেকে বর্ণিত যে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) একদিন আমার আঙ্গুলসমূহ থেকে নূর বিকিরণ করিয়েছিলেন।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, সীরাতুন্নাবী (صلى الله عليه و آله وسلم), অধ্যায় মু’জিযাত।
হাফিয ইবনূ কাসীর লিখেন :
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর মীলাদ বা জন্ম বা শুভাগমন হলে আবিছিনিয়ার বাদশাহ্ আবিছিনিয়া থেকে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) থেকে নির্গত নূর মুবারাক অবলোকন করতে পেরেছিলেন।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, তারিখ ইবনূ কাসীর, অধ্যায় মীলাদুন্নাবী (صلى الله عليه و آله وسلم), খণ্ড ২।
হাফিয ইবনে কাসীর আরো লিখেন :
জনৈক সাহাবী বর্ণনা করেন যে বিদায় হাজ্জের ভাষনের সময় প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর চেহারা মুবারাক পূর্ণিমার চাঁদের মত নূর (আলো)-এ চমকাচ্ছিলো।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* তারিখে ইবনূ কাসীর, অধ্যায় মু’জিযাত, খণ্ড ৬।
হাফিয ইবনূ কাসীর আরো লিখেন :
দাদা হযরত আব্দুল মুত্তালীব আ. তাঁর সন্তান বাবা খাজা আব্দুল্লাহ্ আ. কে সাথে করে হেঁটে যাচ্ছিলেন; জনৈকা রমনী বাবা খাজা ‘আবদুল্লাহ্ আ. এঁর কপাল মুবারাকে এক নূর (a blessed light) অবলোকন করেন।
সেই রমনী তাঁদের নিকট এসে বাবা খাজা আবদুল্লাহ্ আ. কে বিবাহের মানসকামনায় ১০০উট প্রদানের প্রস্তাব পেশ করেন।
তাঁরা সেই রমনীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
দাদীজান আমিনা আ. এর সাথে শাদী মুবারাকের কিছু দিন পরে পথিমধ্যে সেই রমনীর দেখা হয়ে যায়; তখন সে রমনী বাবা খাজা আব্দুল্লাহ্ আ. কে বিবাহের পূর্বের প্রস্তাব করা থেকে বিরত ছিলেন।
তখন সে রমনী বললেন : আপনার কপালে দৃশ্যত: সে নূর আর নেই, যা দেখে আমি আপনিকে আমার সাথে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূল কাসীর, তারিখে ইবনূ কাসীর, খণ্ড ২ ও সীরাতুন্নাবী।
*_* ইবনূ জারীর, আত তাবারী, অধ্যায় মীলাদুন্নিবী।
হাফিয ইবনূ কাসীর আরো বলেন,
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ইরশাদ করেন : আমি হযরত ইব্রাহীম আ. এর দুআ’ এবং হযরত ঈসা আ. এর ভবিষ্যৎবাণী। আমার পূণ্যময়ী মা-জননী যখন আমাকে জন্মদানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তখন তিনি তাঁর শরীর মুবারাক থেকে এইরুপ অভাবনীয় নূর বিচ্ছুরণ হতে দেখতেন যে সেই নূরে দূরবর্তী সিরিয়া অঞ্চলের প্রাসাদ সমূহ নিমিষেই দেখতে পেতেন।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, সীরাতুন্নাবী, খণ্ড ২;
*_* শায়খ নাযদী, মুখতাসার সীরাতুর রাসূল।
ইবনূল জাওযী বর্ণনা করেন যে, প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর নূর কে সূর্য ও বাতীর নূর ম্লান করতো না।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ জাওযী, আল ওয়াফা, অধ্যায় আল বিলাদাহ্।
হাফিয ইবনূ কাসীর আরো লিখেন :
কা’ব ইবনূ মা’লিক রা. প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর উপস্থিতিতে একটি না’ত বা কবিতা পাঠ করেছিলেন। [আমরা আরবী পাঠ থেকে কিছু অংশ অনুবাদ করলাম] :
আমরা আপনার কাছে এসেছি, আর আপনি আমাদের অন্ধকারকে আলোয় ভরে দিলেন, আর মূর্খতার সকল শৃঙ্খল ছিন্ন করে দিলেন।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, তারীখে ইবনূ কাসীর, ও সীরাতুন্নাবী, অধ্যায় মু’জিযাত।
হাফিয ইবনূ কাসীর আরো লিখেন :
দরবারে রিসালাতের কাব্যপ্রতিভূ সাহাবী, আশিক্বে নাবী, হাসান ইবনূ সাবীত রা. বলেন : প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) হলেন সেই তারকা (star) যার থেকে ১৪তারিখের পূর্ণিমার চাঁদও নূর (আলো) আহরন করে।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, তারিখ, অধ্যায় বিলাদাহ্।
হাফিয ইবনূ কাসীর অারো লিখেন :
ইবনূ হিশাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হাসান ইবনূ সাবীত রা. বলেন : আমার বয়স তখন ৮ বছর। জনৈক ইহুদী লোকেদের আহ্বান করছিলো; তারা তার নিকটে সমবেত হলো এবং তার চাঞ্চল্যের কারণ জানতে চাইলো।
তিনি জবাব দিলেন : আহমাদ নামক তারকা আজ উদিত হয়েছে, তারকাটি আজ রাতে জন্ম নিবে।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, তারিখ, খণ্ড ২;
*_* ইবনূ হিশাম, সীরাতুন্নাবী অধ্যায় মীলাদুন্নাবী।
পেশকৃত সকল দলীল প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর নূরের প্রমাণ, উহার সবগুলো প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর উপস্থিতিতে তৎকালীন লোকেদের দ্বারা অনুভূত হয়েছে বা তারা অবলোকন করেছিলেন।
সৃষ্টিকর্তার প্রথম সৃষ্টি কি?
সৃষ্টিকর্তার প্রথম সৃষ্টি পানি, নাকি আরশ, নাকি প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর নূর এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকারের অভিমত রয়েছে।
আমাদের অভিমত হলো প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم)-ই হলেন আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی)-র প্রথম সৃষ্টি।
আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) ক্বুরআ’নুল কারিমে ইরশাদ (Guide) করেন :
وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ۖ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا
যখন আমি সকল পয়গম্বরগণের কাছ থেকে, আপনার কাছ থেকে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও মরিয়ম তনয় ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম এবং অঙ্গীকার নিলাম তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার।
*_* সূরাহ্ আল আহযাব, ৩৩ : ৭।
এই আয়াতুল কারিমে আমাদের জানানো হচ্ছে যে, আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) তাঁর প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) থেকে সর্বপ্রথম অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরপরে অন্যান্য সকল নাবীগণ আ. থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু তাঁরাই প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর আগে নুবূয়্যাতের মহান দায়িত্ব পালনার্থে এই বিশ্ব ধরাধামে আগমন করেছিলেন।
আমাদের এই কথাই নিচে উল্লেখিত প্রাচীন স্কলার (Scholars)-গণ নিজেদের কিতাবে লিখেছেন :
ইমাম তাবারী, হাফিজ ইবনূ কাসীর, ইমাম আল কুরতুবী সকলেই লিখেছেন :
কাতাদা রহ. এর বিবরণ থেকে জানা যায় :
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ইরশাদ করেন, আমি সকলের আগে সৃষ্ঠ হয়েছিলাম, কিন্তু আমি সকলের পরে আগমন করেছি।
গ্রন্থ সূত্র :
সূরাহ্ আহজাব, আয়াত ৭এর তাফসীর
*_* আত তাবারী, তাফসীর তাবারী
*_* কুরতুবী, তাফসীর কুরতুবী
*_* ইবনূ কাসীর, তাফসীর ইবনূ কাসীর
আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) ক্বুরআ’নুল কারিমে ইরশাদ করেন :
الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ
যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি দাঁড়াও,
وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ
এবং সিজদাকারীদের মধ্যে في(=in) তুমি চলাচল করতে।
*_* সূরাহ্ আশ শুআরাহ্; ২৬ : ২১৮-১৯।
হাফিয ইবনূ কাসীর ও কাজী শাওকানী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন :
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনূ আব্বাস রা. এই আয়াত “ وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ
এবং সিজদাকারীদের মধ্যে في(=in) তুমি চলাচল করতে।“ -এর সম্পর্কে বলেন যে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর নূর (Noor) এক নাবী থেকে আরেক নাবীর নিকট যাচ্ছিলেন; মা আমিনার গৃহে (উদরে) না পৌঁছা পর্যন্ত এই নূর (Noor) চলছিল (moved), অবশেষে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর শুভ জন্ম লাভ হয়।
হাফিয ইবনূ কাসীর আরো লিখেন :
শুভ জন্মের পূর্বের অবস্থানকাল সম্পর্কে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ইরশাদ করেন, আমি সর্বযুগে সর্বদাই (always) সবচে’ পবিত্রতর ব্যক্তির মধ্যে (in) অবস্থান (stay) করেছিলাম; অত:পর শেষকালে আমার মা-জননীর উদরে আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) এঁর ইচ্ছায় স্থানান্তরিত হয়েছিলাম।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইবনূ কাসীর, সীরাতুন্নাবী, অধ্যায় বিলাদাহ্।
এই পর্যায়ে আমরা প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর চাচাজান হযরত আব্বাস রা. এঁর স্বরচিত কাব্য মুবারাক পেশ করছি।
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর চাচাজান হযরত আব্বাস রা. স্বরচিত কাব্য মুবারাকটি যুগের সেরা সেরা স্কলার (Scholars)-গণ যেমন ইমাম ইবনূ ‘আব্দিল বার, ইমাম যাহাবী, হাফিজ ইবনূ হাজার আল আসকালানী রহ. সহ আরো অসংখ্য স্কলার্স (Scholars) কোন মতপার্থক্য ছাড়াই নিজ নিজ বিখ্যাত কিতাবে লিখনের খিদমাত করেছেন; কাজেই কেউই এই মুবারাকময় কবিতা অস্বিকারের দু:সাহস করতে পারে না। দূরবর্তী এই যুগে যদি ইসলামী ইউনিফর্ম (Uniform) ধারন করে কেউ অস্বিকারের চেষ্টা করে তাহলে তাকে ইউনিফর্মধারী ইসলামের দুষমন (Enemy of Islam) ছাড়া কিছুই বলা যায় না।
হাফিজ ইবনূ আল কায়্যিম, হাফিজ ইবনূ কাসীর এবং ইবনে আব্দুল ওহ্যাব আন নযদী-প্রকাশ ওহাবী লিখেন :
“প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর চাচাজান হযরত আব্বাস রা. বর্ণনা করেন যে, তাবুক অভিযান থেকে ফেরার কালে আমি প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে বললাম : আমি আপনার সম্পর্কে একটি কাসিদা (কবিতা) পাঠ করতে চাই, তখন প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) জবাব দিলেন : আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) আপনার জবান (mouth)-কে মুবারকময় করুন!
আমি তারপর এই কাসিদা (কবিতা)-টি পাঠ করেছিলাম :
[আমরা কাসিদাটির অংশবিশেষ আরবী থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছি।]
“এই পৃথিবীতে আসার আগে আপনি জান্নাতের বৃক্ষরাজীর পত্রপল্লবের নিচে অবস্থান করেছিলেন।
নাবী আদম আ. জান্নাতের গাছের পত্রপল্লব দ্বারা নিজেকে আবৃত করে নিয়েছিলেন। [যখন তাঁর স্বর্গীয় পরিচ্ছদ অনাবৃত হয়েছিলো।]
হযরত আদম আ. এই পৃথিবীতে আসার আগে আপনার নূর তাঁর কপালে স্থানান্তরিত হয়েছিলো।
হযরত আদম আ. এর মাধ্যম (through – উসিলা)-এ আপনি এই পৃথিবীতে শুভ আগমন করেছিলেন, অথচ তখন আপনি না ছিলেন মানুষ, না ছিলেন মাংসপেশির কোন পিণ্ড, না একফোঁটা রক্ত।
কিন্তু তখন আপনি ছিলেন কেবল নূর আপনার পূর্বপুরুষের পৃষ্ঠে।
অন্যরা যখন ডুবছিলো তখন আপনার পূর্বপুরুষ হযরত নূহ্ আ. নৌকায় আরোহন করেছিলেন।
নৌকা থেকে নামার পরে আপনার নূর এক পবিত্রা রমণী থেকে অারেক পবিত্রা রমণীর নিকট স্থানান্তরিত হয়েছিলো।
নাবী হযরত ইব্রাহীম আ.-এঁর পৃষ্ঠে না আসা পর্যন্ত। আপনিতো তাঁর পৃষ্ঠে ছিলেন,অগ্নি কিভাবে তাঁকে জ্বালাতে পারে?
অত:পর আপনি মা খিন্দাফ আ.-এঁর নিকট যাত্রা করেছিলেন, তিনিও ছিলেন এক পবিত্রা রমণী।
এইভাবে আপনি সম্মুখে যাত্রা করতে থাকলেন, আপনার জন্মের পূর্ব পর্যন্ত।
আপনার শুভ জন্ম কালে আপনার নূরে যমীন ও আকাশ যতোটা আলোকিত হয়েছিলো আর কখনো তেমন হয় নি। এখনো আমরা সেই নূরের পথপ্রদর্শনোর দ্বারাই ভ্রমণ করছি।“
গ্রন্থ সূত্র :
[উপরোক্ত কাসিদাটিকে সকল যুগের সকল স্কলার্স (Scholars) বর্ণনা ও সত্যায়িত করেছেন।
কতিপয় স্কলার্স এর নাম ও সূত্র দেয়া হলো।]
*_* ইমাম ইবনূ আব্দিল বার রহ., কিতাব আল ইস্তিয়াব, হুরায়ম ইবনূ ওয়াস এর জীবনবৃত্তান্ত।
*_* কাজী আয়াজ রহ., কিতাব আশ শিফা।
*_* ইবনূ আসীর, তাবারানী।
*_* ইবনূ কাইয়্যিম, যা’দুল মা’আদ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১০।
*_* ইবনূ কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, অধ্যায় গাজওয়ায়ে তাবুক-শেষের অংশে।
*_* ইবনূ কাসীর, কিতাব সীরাতুন্নাবী।
*_* ইবনূ আসীর, কিতাব উসদুল গাবাহ।
*_* ইবনূ আব্দুল ওহ্যাব আন নযদী, প্রকাশ ওহাবী, কিতাব মুখতাসার সীরাতুর রাসূল।
*_* ইমাম ইবনূ হাজার আল আসকালানী রহ., কিতাব আল আসাবাহ্।
*_* হাফিজ ইমাম আয যাহাবী রহ., কিতাব তাখলিস মুস্তাদরাক।
*_* আশরাফ আলী থানবী, কিতাব নাশরুততীব।
কাজী আয়াজ রহ. তদীয় কিতাব আশ শিফা, প্রকাশ- শিফা শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনূ আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর নূর বিশ্ব ভূবন সৃষ্টির ২০০০বৎসর আগে সৃষ্টি করা হয়েছিলো।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* কিতাবুশ শিফা, অধ্যায় ১, পৃষ্ঠা ৪৮।
ইবনূ আব্দুল ওহাব আন নযদী, প্রকাশ ওহাবী লিখেন :
এক হাদিসুল কারিমে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ইরশাদ করেন : হযরত আদম আ. যখন মাটি ও পানির মধ্যে মিশ্রিত সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় ছিলেন তখনো আমি নাবী ছিলাম।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* ইমাম তিরমিযী রহ. সংকলিত হাদিস।
*_* ইবনূ আব্দুল ওহাব আন নযদী, প্রকাশ ওহাবী, কিতাব মুখতাসার সীরাতুর রাসুল।
*_* ইমাম বায়হাকী, ইমাম আহমাদ, ইমাম হাকেম, ইমাম আয যাহাবী রহ. প্রমুখ স্কলার্স (Scholars)-গণ হাদিসটিকে সহীহ্ প্রমাণ করে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ইরশাদ করেন :
আমি সর্বদাই পবিত্রতম ব্যক্তিদের মাঝে অবস্থান করেছিলাম, আমার নূর আদম (আ.) এঁরও আগেই বিদ্যমান ছিলো।
গ্রন্থ সূত্র :
*_* কাজী আয়াজ রহ. এঁর কিতাবুশ শিফা, তাবারীতেও অনূরুপ; অধ্যায় মীলাদ আন নাবী।
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর পূণ্যময় সাহাবায়ে ক্বিরাম রা.-গণও প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে নূর সম্বোধনে (calling) অভ্যস্থ ছিলেন।
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর ওফাৎ পরবর্তীকালে নিচের না’ত শরীফ সমূহ পাঠ করা হয়েছিলো :
ইমাম ইবনূ সা’দ লিখেন যে দরবারে রিসালাতের অন্যতম সাহাবী হযরত হাসান বিন সাবীত রা. নিচের না’ত শরীফটি পাঠ করেছিলেন :
“যে মানব হলেন নূর, তাঁর সাথে অন্য কোন মানবের তুলনা চলে না, এই মানব থেকে নূর বিচ্ছুরিত হতো।
তাঁর নাসীহাত ছিলো বারাকাতপূর্ণ, তিনি ছিলেন আমাদের মুর্শিদ (পথপ্রদর্শক – guide), আমাদের সতর্ককারী।
তিনি ছিলেন এমন নূর যে তাঁর নূর সমগ্র সৃষ্টিতে আলো ছড়াতো।
যে মানুষটি আমাদের তাঁর নূরের পথ প্রদর্শণ বা ইরশাদ (guide) করেছেন তিনি পূর্ণতার সর্বোচ্চ শিখড়ে আসীন।
তিনিতো নূর, তিনিতো নূর।
আমরা তাঁরই পদাঙ্ক অনূসরণ করে চলছি, আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی)-র ইচ্ছায় তাঁর দিকেই আমাদের কর্ণ ও চোখ আকর্ষিত হতো।“
কা’ব ইবনূ মালিক রা. বর্ণনা করেন :
“তিনি ছিলেন বাশির আন নাযীর, তাঁর নূরের রেখাপাতে আমরা আলোকিত।
তাঁর নূরের বারাকাতে আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) আমাদের রক্ষা করেছেন, তিনি (صلى الله عليه و آله وسلم) রউফুর রহীম, তাঁর করুণায় আমরা নরকের অগ্নি থেকে মুক্ত হয়েছি।“
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর ফুফু আম্মা হযরত আরওয়া বিনতি আব্দ আল মুত্তালীব রা. বর্ণনা করেন :
“আমি যদি কান্না করি তবে তাঁর জন্য করি, তিনি হলেন সমগ্র সৃষ্টির জন্য নূর।
তিনি হলেন আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی)-র নাবী, আর তাঁর নাম আহমাদ। আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) আমার মনের অবস্থা এখন যেরুপ সেরুপই রাখুন!“
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর ফুফু আম্মা হযরত আতিকা বিনতি আব্দ আল মুত্তালীব রা. বর্ণনা করেন :
“ওরে নয়ন আমার! কান্না করো সেই নির্বাচিত নূরের জন্যে, তিনি হাশিমী বংশের সন্তান।“
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর ফুফু আম্মা হযরত সাফিয়া বিনতি আব্দ আল মুত্তালীব রা. বর্ণনা করেন :
“আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তাঁর প্রতি রয়েছে সুপথ, তাঁর প্রতি রয়েছে নম্রতা।
অন্ধকারের স্থলে তিনি এনেছেন সুপথের নূর।“
প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর ফুফাত বোন হযরত হিন্দ বিনতি উসাসা বিনতি আব্দ আল মুত্তালীব রা. বর্ণনা করেন :
“তিনি ছিলেন চৌদ্দতম রাতের পূর্ণিমার চাঁদ, তিনি এমন নূর যাঁর থেকে নূর বিচ্ছুরণ হয়, আল্লাহ্ (سبحانہ و تعا لی) অসীম করুণায় তাঁকে কিতাব উপহার দিয়েছেন।“
গ্রন্থ সূত্র :
*_* তাবাকাত ইবনূ সা’দ, অধ্যায় ওয়াফাত আন নাবী।
এই অধ্যায়ে থাকা সকল প্রমাণ সমূহ প্রমাণ করে যে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর নূর সমগ্র সৃষ্টির অস্থিত্বের আগে বিদ্যমান ছিলো।
এই কারণে সকল সময়ে, সকল যুগে অর্থাৎ সূন্নাহর অনূসারী (আহলুস সূন্নাহ্)-র আক্বিদা-বিশ্বাস হচ্ছে, প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) মানব সন্তান হলেও তাঁর সত্ত্বা নূর (noor) হওয়াতে এবং তাঁকে নূর সম্বোধনে কোন সমস্যা নেই বরং তা প্রমানিত।
ইহাই হচ্ছে প্রিয়নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর নূর হওয়া সম্পর্কিত ধর্মমতের বাস্তবতা। ইহাই হচ্ছে “আহলুস সূন্নাহ্ ওয়াল জামা’আত” এর সকল সময়ে, সকল যুগের আক্বিদা-বিশ্বাস।
সর্বশেষে প্রশ্ন থাকে যে, এই আক্বিদা-বিশ্বাস যদি কুফর হয়, তাহলে উল্লেখিত সকল স্কলার্স (Scholars) এবং তাঁরা এই আআক্বিদা-বিশ্বাস প্রমাণে কিতাব রচনা করার কারণে কি কুফ্ফার শ্রেণীভূক্ত হবে? (আস্তাগফিরুল্লাহ্!)