তাবলীগের প্রকৃত মর্ম ও তাৎপর্য অনেকের কাছে ভুলভাবে প্রচারিত হয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, তাবলীগ শুধুমাত্র ৪০ দিন চিল্লা দেওয়া বা তুরাগ ময়দানে ইজতিমার আয়োজন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে আমাদের আসল তাবলীগের মূল উদ্দেশ্য আসলে এসব বিদআতি কর্মপন্থার মধ্যেই আটকে নেই। আলহামদুলিল্লাহ।
★তাবলীগের প্রকৃত উদ্দেশ্য
তাবলীগের শাব্দিক অর্থ হলো বার্তা বা নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া। ইসলামে তাবলীগের কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহ্ ﷻর দেওয়া নির্দেশ ও প্রিয় নবী করিম ﷺ’র আদর্শ বিধর্মিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটি একটি দ্বীনি দায়িত্ব যা আমাদের প্রিয় নবীজী ﷺ এবং সাহাবীদের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে। তারা সব সময় মানুষকে মহান আল্লাহ ﷻর পথে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, বিশেষত তাদের যারা সত্য থেকে বিচ্যুত ছিল বা ইসলামের বাইরে ছিল।
★মুসলিমদের মাঝে #তাবলীগ নয়, বরং #তালিম
মুসলিমদের মাঝে তাবলীগ করার প্রয়োজন নেই, কারণ তারা অলরেডি ইসলামের আলোতে জীবনের পথ চলছে। মুসলিমদের জন্য তালিম বা শিক্ষার প্রয়োজন যাতে তারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষায় আরও দৃঢ় হতে পারেন। খানকা ও মাদ্রাসা গুলোতে এই তালিমের ব্যবস্থা করা হয় যেখানে মুসলিমরা কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান শিখেন। তবে বিধর্মিদের কাঝে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোই প্রকৃত তাবলীগের কাজ।
★প্রচলিত ইজতিমা ও চিল্লা
বর্তমান তবলীগের নামে ইলিয়াস মেওয়াতীর স্বপ্ন গ্রহণযােগ্য নয়, কারণ তার প্রচলিত তাবলীগের মত ও পথ হলাে ভিন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের পরিপন্থী।
১। তাফসিরে রুহুল মায়ানী, প্যারা ২৩, পৃঃ১২৮-“নবীগণ আলাইহিমুস সালামের উপর নাজিলকৃত ওহী জাগ্রত অবস্থায় যেরূপ নির্ভুল, সঠিক ও সত্য, তদ্রুপ তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন ও ওহী নির্ভুল, সঠিক ও সত্য এবং শরীয়তের দলিলরূপে পরিগণিত।”
২। তাফসিরে জালালাইন শরীফ, পৃ: ৩৭৭ “নবীগণ। আলাইহিমুস সালামের স্বপ্ন সত্য এবং তাদের কাজসমূহ মহান আল্লাহ ﷻ নির্দেশেই সম্পাদিত হয়ে থাকে।”
৩। নবীগণ ব্যতীত অন্য কারাে স্বপ্ন সবসময় সত্য নাও হতে পারে। তাই নবীগণ ব্যতীত অন্য কারাে স্বপ্ন শরীয়ত নয়। অলীগণের স্বপ্ন কুরআন হাদীস অনুযায়ী হলে নিজের জন্য গ্রহণযােগ্য হতে পারে, কিন্তু অন্যের জন্য দলিল হতে পারে না।
★নবীওয়ালা কাজঃ
১। উম্মত কখনও নবীর মত হতে পারে না এবং নবীগণের বিশেষ দায়িত্ব উম্মত পালন করতে পারে না।
২। সাহাবীগণ বলেন-“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার মত নই।”(বুখারী শরীফ-১ ম খন্ড, পৃঃ ২৫৭)
৩। অন্য হাদীস-“তােমাদের মধ্যে আমার মত কে আছে? “অর্থাৎ কেউই নেই। (বুখারী শরীফ-১ ম খন্ড, পৃ: ২৬৩)
মন্তব্য-
(১) উপরােক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণ হলাে উম্মত নবীর মত নয়। কাজেই, নবীর বিশেষ কাজ কিভাবে উম্মত পালন করবে? আর যদি এ উম্মতের আলেমগণ বনী ঈসরাইলের নবীগণের হন। তবে তারা হক্কানী ওলামায়েকেরাম ও নেয়ামত প্রাপ্ত বুজুর্গানে দ্বীন, যাদের মাধ্যমে নবুয়তের ধারা রহিত হওয়ার পরও বেলায়েতের ধারা চালু আছে। আর নবীর ওয়ারিশ হিসেবে তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বাবলী পালন করবেন।
(২) হাদীসে আছে, “নিশ্চয়ই আলেমগণ হলেন নবীর ওয়ারিশ।”আবার অন্য হাদীসে আছে।”ভালাের চেয়ে। ভালাে হলাে আলেম এবং খারাপের চেয়ে খারাপ হলাে। আলেম।”(মেশকাত-পৃ: ৩৭, দারেমী-১ ম খন্ড, পৃ: ১১৬, হাদীস নং ৩৭০) কাজেই দ্বীনের দাওয়াতের জন্য হক্কানী আলেম হতে হবে, আলেমে সূ (অসৎ আলেম) নয়, আম জনতা বা অনুপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ তাে নয়ই।
★ইসলামী তাবলিগের উসুল বনাম ইলিয়াসী তাবলিগের উসুলঃ
১। ইসলামের রােকন/ উসূল হলাে ০৫ টি। যথা-
ঈমান (কলেমা), নামাজ, রােজা, হজ্জ ও যাকাত। (বুখারী-১ ম খন্ড, পৃ: ০৬, মুসলিম-১ ম খন্ড, পৃঃ ৩২ এবং মেশকাত-পৃ: ১২)
২। তাবলীগ জামাতের রােকন/ উসূল হলাে ০৬ টি। যথা-ঈমান (কলেমা), নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলেমীন। (মুসলমানদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন), তা সহীহে নিয়ত (নিয়ত শুদ্ধ করা) ও নাফর ফি সাবিলিল্লাহ (তাবলীগের জন্য বের হওয়া)। (সূত্রঃ দাওয়াতে তাবলীগ-২ য় খন্ড)
মন্তব্যঃ (১) মুসলমানদের রােকনের প্রবর্তক হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু তাবলীগের রােকন বা উসূলের প্রবর্তক হলেন দিল্লীর মৌ: ইলিয়াস মেওয়াতী (১৩০৩ হি: ১৩৬৩ হি: তথা ১৯৪৪ সাল) যিনি এই প্রচলিত তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা। এই ০৬ উসূলের ভিত্তি করেই তিনি ১৩৪৪ হিঃ তে সর্বপ্রথম তাবলীগের কাজ ও গাত শুরু করেন।
মন্তব্যঃ (২) ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ হলাে ০৫ টি। আর তাবলীগ জামাতের ০৬ টি। তাই ইসলামের মৌলিক স্তম্ভে হস্তক্ষেপ করে, অর্থাৎ ০৩ টি কােন কােন দিয়ে নতুন ৪ টির সংযােজন করে, তাবলীগ জামাতের প্রবর্তক ও অনুসারীগণ নিজেরাই ইসলামের দায়রা বা বৃত্ত হতে দৃশ্যত বেরিয়ে গেছেন। তারা যত খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করুন না কেন, এটাই সত্য। আর ইসলামের মূল নীতির পরিবর্তনকারীরা কাফের। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সিদ্ধান্ত।
★আমাদের দ্বীন কি শুধুই শরীয়ত?
১। এলেম অর্জন ফরজ। এলেম আবার ০২ প্রকারের জাহেরী ও বাতেনী। কাজেই উভয় প্রকার এলেম অর্জনই ফরজ। (মেশকাত-পৃ: ৩৪, ইবনে মাজাহ-পৃ: ১৯)।
২। হাদীসে জিব্রাইল অনুযায়ী আমাদের দ্বীনের পুর্ণতার জন্য তিনটি বিষয় রয়েছে। যথা-ইসলাম, ঈমান ও এহসান। (বুখারী-১ ম খন্ড, পৃ: ১২, ২ য় খন্ড, পৃ: ৭০৫, মুসলিম-১ ম খন্ড, পৃ: ২৭, মেশকাত-পৃ: ১১)। ইসলাম ও ঈমান হলাে শরীয়তের বিষয় এবং এহসান হলাে তরিকত/ মারেফত বা সূফিবাদের বিষয়।
৩। ইমাম মালেক রহমতুল্লাহ আলাইহি ফরমান-“যে ব্যক্তি এলমে শরীয়ত বা শরীয়তের জ্ঞান হাসিল করেছে এবং এলমে মারেফতের জ্ঞান হাসিল করেনি, সে ফাসিক। আর যে ব্যক্তি মারেফতের জ্ঞান হাসিল করেছে, কিন্তু শরীয়তের জ্ঞান হাসিল করেনি, সে জিন্দিক (কাফের)। আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার জ্ঞান অর্জন করেছে, সেই হচ্ছে হক্কানী আলেম বা নয়েবে রাসূল।”(মিরকাতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কিতাবুল ইলম, ১: ৩৩৫)
মন্তব্যঃ উপরােক্ত ০৩ টি তথ্যের আলােকে তাবলীগের অনুসারীগণ বাতেনী এলেম হাসিল, এহসান অর্জন এবং মারেফতের জ্ঞান লাভের জন্য কি উপায় বা পদ্ধতি বা নিয়ম অনুসরণ করেন, তা সরলপ্রাণ মুসলমানদের অবশ্যই জানতে ইচ্ছা করে এবং জানার অধিকারও রয়েছে। সম্ভবত কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ মেওয়াতী সাহেব নিজেই তাবলীগের অনুসারীদের সূফীদের কিতাব পড়তে নিষেধ করেছেন(সূত্র: মালফুজাত নং-৮০)। কারণ সূফীদের কাছে সত্য পথের ঠিকানা পাওয়া যায় এবং তাদের দ্বারস্থ হলে। মেওয়াতী সাহেবের দল ভেস্তে যাবে।
★রাসুলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীদের তাবলীগ
রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর সাহাবারা ইসলামের তাবলীগে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁরা শুধু মুসলিমদের মাঝে নয় বরং বিশ্বের অমুসলিমদের কাছে মহান আল্লাহ ﷻর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। এই তাবলীগের মাধ্যমেই আজ ইসলামের আলো পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছেছে।
★সঠিক বোঝাপড়ার গুরুত্ব
প্রচলিত ভ্রান্ত ইজতিমা ও চিল্লাকে এটি তাবলীগ নয়। যদি তবলীগ বলা হয়, তাহলে কুফর হবে ও স্পষ্ট বিদআত হবে। আসল তাবলীগ হলো সেই প্রচেষ্টা, যা ইসলামের আলো অমুসলিমদের কাছে পৌঁছে দেয়। সুতরাং, আমাদের উচিৎ তাবলীগের প্রকৃত অর্থ বুঝে ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা এবং ভুল ধারণা দূর করা।