উল্লিখিত মোজেজার ন্যায় অল্প পানিকে বেশী পানিতে রূপান্তরিত করে দেয়ার মতো মোজেজাও নবী করীম (ﷺ) থেকে প্রকাশ পেয়েছিলো। তাঁর দোয়ার বরকতেই এরকম হয়েছিলো। সহীহ মুসলিম শরীফে তবুকের যুদ্ধের প্রসঙ্গে হজরত মুআয ইবনে জাবাল (رضي الله عنه) থেকে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, তবুক যুদ্ধের সময় রসুলেপাক (ﷺ) সাহাবীগণকে বললেন, তোমরা ইনশাআল্লাহ্ সূর্যোদয়ের সময় তবুক ঝর্ণার কাছে পৌঁছে যাবে।আমি সেখানে পৌঁছাবার আগে কেউ যেনো ঝর্ণার পানিতে হাত না লাগায়। হজরত মুআয (رضي الله عنه) বলেন, আমরা সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, দু’জন লোক আমাদের আগেই সেখানে হাজির হয়েছে। ঝর্ণা থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) লোক দু’টিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি ঝর্ণার পানিতে হাত দিয়েছো? তারা বললো, হ্যাঁ। তিনি তাদেরকে তিরস্কার করলেন এবং বললেন, আল্লাহ্তায়ালার যা মর্জি তাই হয়। সাহাবীগণ নিজেরা হাত দিয়ে ঝর্ণার মাটি খনন করার চেষ্টা করলেন যাতে পানিগুলো সেখানে যেয়ে জমা হতে পারে। দেখা গেলো, ঝর্ণা থেকে ঘন কুয়াশার মতো কিছু বেরিয়ে আসছে। তারপর রসুলেপাক (ﷺ) তাঁর মুখম-ল ও হাত মোবারক ধৌত করলেন এবং ধৌত কার্যে ব্যবহৃত পানি পুনরায় ঝর্ণায় ঢেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঝর্ণা কুলকুল করে পানিতে ভরপুর হয়ে গেলো। সবাই পানি পান কররেন। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, হে মুআয! তোমরা যদি দীর্ঘায়ূ লাভ করো তবে দেখতে পাবে, এস্থানটি একদিন বড় বড় অট্টালিকা এবং উদ্যানে সুশোভিত হয়ে উঠবে। পরবর্তীতে তাই হয়েছিলো। এই খবর প্রদানের ব্যাপারটিও রসুলেপাক (ﷺ)এর একটি মোজেজা।
হুদাইবিয়া যুদ্ধের বর্ণনায় এসেছে, রসুলেপাক (ﷺ) চারশ’ সাহাবী নিয়ে হুদাইবিয়ার কূপের নিকট উপস্থিত হলেন। কূপটি ছিলো এমন যে, পঞ্চাশটি বকরীকেও তা থেকে পানি পান করানো যায় না। সাহাবায়ে কেরাম কূপের সমস্তপানি তুলে ফেললেন। এক ফোঁটা পানিও অবশিষ্ট ছিলো না। এমতাবস্থায় রসুলেপাক (ﷺ) কূপের এক পাশে এসে দাঁড়ালেন। বালতিতে রাখা পানি দিয়ে অজু করলেন। তারপর মুখের কুলি করা পানি কূয়োর মধ্যে ঢেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কূপের পানি উথলে উঠলো। কূপের মুখ পর্যন্ত পানি থৈ থৈ করতে লাগলো। পানি পান করে সাহাবীগণ পরিতৃপ্ত হলেন এবং আপন উটসমূহকেও পানি পান করালেন। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, রসুল (ﷺ) তুনীর থেকে তীর বের করে কূপের ভিতর নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পানি উঠতে লাগলো। সাহাবীগণ সকলেই তৃপ্তির সাথে সেই পানি পান করলেন। হজরত জাবের (رضي الله عنه) থেকেও এরকম বক্তব্য এসেছে। হুদাইবিয়া নামক স্থানে রসুলেপাক (ﷺ) এর আঙুল মোবারকের মধ্যবর্তী স্থান থেকে ঝর্ণাধারা জারী হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়।
দু’টি বর্ণনার মধ্যে সামান্য অসামঞ্জস্য আছে। উলামা কেরাম দু’টি ঘটনা একই সময়ে সংঘটিত হয়েছিলো বলে মনে করেন। জাবের (رضي الله عنه) বর্ণিত হাদীছের বিবরণ হচ্ছে- নামাজের সময় হলে রসুলেপাক (ﷺ) অজু করলেন এবং সকলেই পানি পান করে তৃপ্ত হলেন। তারপর তিনি বালতির অবশিষ্ট পানি কূপের মধ্যে ঢেলে দিলে পানি বৃদ্ধি পেলো। এভাবেই দুই বর্ণনার সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।
হজরত আবু কাতাদা রা থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদা সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) আমাদেরকে একটি সফর সম্পর্কে আভাস দিয়ে বললেন, সারা রাত চলতে থাকবে। সকালে ইনশাআল্লাহ্ পানির নিকট পৌঁছে যাবে। নির্দেশ মোতাবেক সেখানে পৌঁছে সকলেই পানির সন্ধান করতে লাগলেন। রসুলেপাক (ﷺ) এর সাহচর্যের কথা তাঁরা ভুলেই গেলেন। আরো সামনে চলতে লাগলেন। রাতের শেষ প্রহরে রসুলেপাক (ﷺ) একস্থানে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে সাহাবীগণকে বলে রাখলেন, যাতে তাঁরা ফজরের ওয়াক্তের খেয়াল রাখেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে সকলেই নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। সকলের পূর্বে ঘুম থেকে জাগলেন নবী করীম (ﷺ)। তাঁর পবিত্র মুখাবয়বের উপর সূর্যের কিরণ পড়ছিলো। তিনি বললেন, যাত্রা শুরু করো, এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে। এটা শয়তানের জায়গা। সকলেই রওনা হয়ে গেলেন। সূর্য তখন বেশ উপরে। একস্থানে থামলেন সবাই। তাঁবু খাটালেন। সাহাবীগণের নিকট পানির অন্বেষণ করলেন রসুল (ﷺ)। পানির মশকটি আমার নিকটে ছিলো। পানি ছিলো সামান্য। তিনি সেটুকু দিয়ে অজু করলেন এবং অবশিষ্ট যৎসামান্য পানিসহ মশকটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেন, খুব হেফাজতে রেখো। এর মাধ্যমে এক বিরাট মোজেজা প্রকাশ পাবে।
এরপর হজরত বেলাল (رضي الله عنه) নামাজের জন্য আযান দিলেন। ফজরের নামাজ আদায় করে সামনে অগ্রসর হলেন রসুল (ﷺ)। সূর্যের আলো যখন প্রখর হয়ে গেলো, সবকিছু হলো উত্তপ্ত, তখন আমরা নিবেদন করলাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরা তো পিপাসায় মরে যাচ্ছি। তিনি বললেন, না। এরপর তিনি আমার কাছ থেকে মশক নিয়ে মশকের মুখের উপর মুখ রাখলেন। বুঝলাম না, রসুলেপাক (ﷺ) মশকের মধ্যে তাঁর মুখের লালা মোবারক ঢেলে দিলেন, না ফুঁ দিলেন। দেখলাম, মশক থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রসুল (ﷺ) আমাকে হুকুম করলেন, লোকদেরকে পানি পান করাও। সবাই পানির জন্য জটলা করতে লাগলেন। নবী করীম (ﷺ) বললেন, ভিড় কোরো না। শৃঙ্খলার সঙ্গে পানি পান করো। সকলেই পান করতে পারবে। পানি পান করে সকলেই পরিতৃপ্ত হলো। আমরা ছিলাম তিনশ’। সকলের শেষে রসুলেপাক (ﷺ) আমার দিকে পানির পাত্রটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও, পান করো। আমি বললাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনি পান না করলে আমি পান করবো না। তিনি হুকুম করলেন, তুমি পান করো। পানি পান করানেওয়ালা সবশেষেই পান করে থাকে।
সাইয়্যেদুনা ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, তখন মানুষ এতো পিপাসিত হয়ে পড়েছিলো যে, তারা নিজেদের উট জবেহ করে সেগুলোর নাড়িভুঁড়ি নিঙড়িয়ে পান করা শুরু করে দিয়েছিলো।তখন হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) আল্লাহ্তায়ালার কাছে দোয়া করার জন্য নবী করীম (ﷺ) নিকট আবেদন জানালেন। তিনি দোয়া করার জন্য হাত ওঠালেন। দোয়া শেষে হাত নামানোর আগেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। যাঁদের নিকট বরতন ছিলো, সকলের বরতনই ভরপুর হয়ে গেলো। লক্ষণীয় ব্যাপার, এই বৃষ্টি সেনাসীমানার বাইরে কোথাও বর্ষিত হয়নি। লশকরের সীমানা পর্যন্তই ছিলো এই বৃষ্টির পতনপরিধি।
কথিত আছে, একদা নবী করীম (ﷺ) ও তাঁর চাচা সাইয়্যেদ আবু তালিব একটি বাহনের উপর বসে সফর করছিলেন। আবু তালিব বললেন, ভাতিজা! আমারতেষ্টা পেয়েছে। পানিও নেই। রসুলেপাক (ﷺ) বাহন থেকে নিচে নামলেন এবং কদম মোবারক দিয়ে মাটিতে আঘাত করলেন। যমীন থেকে পানি বের হতে লাগলো। রসুল (ﷺ) বললেন, চাচাজান! পানি পান করুন। বোখারী ও মুসলিম শরীফে হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, এক সফরে আমি রসুল করীম (ﷺ) এর সঙ্গে ছিলাম। লোকেরা তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লো। তিনি দু’জন সাহাবীকে ডাক দিয়ে আনলেন। তন্মধ্যে একজন হচ্ছেন হজরত আলী ইবনে আবী তালিব। বললেন, পানির তালাশে বেরিয়ে পড়ো। তোমরা একটি মেয়ে লোককে দেখতে পাবে, যার উটের উপর দু’টি পানির মশক রয়েছে।
দু’জন সাহাবী সেই মহিলার অন্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন এবং এক পর্যায়ে উক্ত রমণীর সাথে দেখা হয়ে গেলো। তাঁরা উক্ত রমণীকে পানির মশকসহ নবী করীম (ﷺ) এর নিকটে নিয়ে এলেন। তার উটের উপর থেকে পানির মশক নামিয়ে আনা হলো। রসুলেপাক (ﷺ) পানির বরতন চাইলেন এবং রমণীর মশক থেকে পানি নিয়ে বরতনে ঢাললেন। বললেন, তোমরা এসো। সকলেই পানি পান করে যাও এবং অন্যদেরকেও পান করাও।
মহিলাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলো এবং এমনভাবে বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো যে, সামনে না জানি আরও কতো ঘটনা ঘটবে। বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহ্র কসম! রসুলেপাক (ﷺ) মহিলার মশক ভর্তি পানি সবটুকুই ফিরিয়ে দিলেন এবং আমার মনে হলো যে পূর্বের পানির চেয়ে তার পানি আরও বেশী হয়ে গেছে। এরপর রসুলেপাক (ﷺ) ওই মহিলার জন্য আহারের আয়োজনের নির্দেশ দিলেন।
সাহাবীগণ খেজুর, আটা এবং ছাতু একত্রিত করে চাদরের মধ্যে বেঁধে তার উটের উপর রেখে দিলেন। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) মহিলাটিকে লক্ষ্য করে বললেন, যাও। তোমার পানি একটুও কমেনি।আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে তাঁর আপন কুদুরত থেকে পানি দান করেছেন। এরপর মহিলাটি আপন জনপদে পৌঁছে লোকদেরকে বলতে লাগলো, আমি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। দু’জন লোক আমাকে এমন একজন লোকের কাছে নিয়ে গেলো, যাঁকে তারা তাদের নেতা বলে মনে করে। এরপর মহিলাটি সমস্ত ঘটনা বলার পর বললো, আল্লাহ্র কসম! লোকটি হয় একজন মস্ত যাদুকর, না হয় আল্লাহ্র খাঁটি রসুল। সে আরো বললো, তোমাদের কারও ইসলাম গ্রহণ করার ইচ্ছা আছে না কি?
হাদীছের বিবরণ আরো দীর্ঘ। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ায় এই হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো বিবৃতিতে আছে, লোকেরা সেই মহিলার কথা শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। এ ধরনের আরও হাদীছ রয়েছে। যথাস্থানে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]