রমজানের রোজা আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল। রবের কাছে সহজে পৌঁছার বড় মাধ্যম। সন্তুষ্টি অর্জনের উজ্জ্বল সোপান। রোজা পালনের ফজিলত ও প্রতিদান দেন আল্লাহ নিজে। অন্য সব আমলের সওয়াব ফেরেশতাদের মাধ্যমে পৌঁছান কিংবা আমলের সওয়াব পূর্বনির্ধারিত থাকে। কিন্তু রোজা একমাত্র আমল, যার সওয়াব আল্লাহ নিজেই দান করবেন। কেননা মানুষের সব আমল তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আল্লাহর জন্য। মানুষের সিয়াম সাধনা জগতের মালিকের জন্য। আল্লাহর কথা প্রিয় নবীর কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে, ‘সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশগুণ।’ –সহিহ বোখারি: ১৮৯৪
যেহেতু রোজা গুরুত্বপূর্ণ আমল, তাই ওই রোজা হতে হবে ত্রুটিমুক্ত। আজকের আলোচনায় রোজার টুকিটাকি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
রোজা রেখে যা যা করা যাবে
রোজা রেখে চুলে, হাতে-পায়ে মেহেদি দেওয়া যাবে। চুলে তেল দেওয়া যাবে। চুল, নখ ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম কাটা যাবে। হাতে-পায়ে, মুখে-শরীরে তেল, ক্রিম কিংবা ভ্যাসলিন দেওয়া যাবে। ঠোঁটে লিপস্টিক ও ভ্যাসলিন দেওয়া যাবে (যদি মুখের ভেতরে না যায়)।
টুথপেস্ট ব্যবহার করে ব্রাশ করা যাবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন টুথপেস্টের স্বাদ গলার ভেতরে না যায়, গেলে রোজা ভেঙে যাবে তাই সতর্কতা হচ্ছে, রোজা অবস্থায় পেস্ট দিয়ে ব্রাশ না করে মিসওয়াক করা।
রোজা রেখে চোখে কাজল, সুরমা, আইলাইনার ও ড্রপ দেওয়া যাবে। গায়ে আতর, সেন্ট, বডি স্প্রে ও পাউডার দেওয়া যাবে (তবে এর কোনো ছিটা যেন মুখে না যায়)।
মুখে অক্সিজেন নেওয়া যাবে (তবে অন্য মেডিসিন, দৃশ্যমান কিংবা তরল- মেশানো থাকলে নেওয়া যাবে না)।
জরুরি প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন দেওয়া যাবে। থুথু গেলা যাবে। অজুর কুলির পর মুখ ঝেড়ে পানি ফেলার পর মুখে থুথুর সঙ্গে যা থাকে তা গেলা যাবে।
জিহ্বার আগা দিয়ে খাবারের স্বাদ নেওয়া যাবে (তবে না গিলে তা ফেলে দিতে হবে)।
রোজা ভাঙবে না যেসব কারণে
কেউ ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেললে কিংবা অনিচ্ছাকৃত হালকা বা মুখ ভরে বমি হলো (কেউ যদি মুখে বমি আসার পর আবার ইচ্ছাকৃত গিলে ফেলে তবে ভেঙে যাবে, অনিচ্ছাকৃত আবার গলা দিয়ে নেমে গেলে ভাঙবে না)।
তদ্রুপ স্বপ্নদোষ হলে, দাঁত ফেললে, হিজামা করালে (শিঙা লাগানো) ও নাক দিয়ে রক্ত পড়লেও রোজা ভাঙবে না। রোজা রেখে রক্তদান করলেও রোজা ভাঙবে না। রোজা রেখে বেহুশ হয়ে গেলে, গলায় পোকা-মাকড় কিংবা মশা-মাছি ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত ঢুকলেও রোজা ভাঙবে না। কান বা নাক ফোঁড়ালে ও কান দিয়ে পানি প্রবেশ করলে (তবে যদি কানের পর্দা ফাটা থাকে তখন রোজা ভাঙবে) রোজা ভাঙবে না।
রক্ত বা স্যালাইন নিলে রোজা মাকরুহ হবে নাকি রোজা ভাঙবে বা ভাঙবে না এই প্রশ্ন আসার আগে বলে রাখা ভালো- রোগীর অবস্থা যদি এতই খারাপ হয় যে তাকে রক্ত বা স্যালাইন নিতে হচ্ছে সেক্ষেত্রে রোগীর জন্য রোজা ভাঙা জায়েজ। বরং উচিৎ হবে এমন অবস্থায় রোজা না করে চিকিৎসা নেওয়া।
রোজা ভাঙবে যেসব কাজে
হায়েজ-নেফাস হলে, ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু খেলে, ফরজ গোসল করার সময় গড়গড়া ও নাকের একদম ভেতরে পানি পৌঁছালে (স্বাভাবিকভাবে কুলি ও নাক পরিষ্কার করবে), সিগারেট-বিড়ি, হুক্কা টানলে, স্বামী-স্ত্রীর গভীর চুম্বনের ফলে যদি একে অপরের থুথু গিলে ফেলে, সহবাস করলে, নাকে ড্রপ দিলে, পায়ূপথ দিয়ে মেডিসিন কিংবা পানি ইত্যাদি প্রবেশ করালে (তবে যদি চিকিৎসার জন্য পাইপ প্রবেশ করায় ও সেই পাইপের সঙ্গে যদি পানি বা কোনো মেডিসিন না থাকে তবে রোজা ভাঙবে না)।
পাথর কিংবা লোহার টুকরা অথবা কোনো ফলের বিচি গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে, তদ্রুপ ইনহেলার অথবা নেবুলাইজার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে।
রোজার কাজা, কাফফারা ও ফিদইয়ার বিধান
হায়েজ-নেফাস বা অন্য কোনো অসুস্থতা-দুর্বলতা কিংবা মুসাফির হওয়ার কারণে যদি কারো রোজা না রাখা হয়, তবে সে একটি রোজার পরিবর্তে একটি রোজা কাজা আদায় করে নেবে।
যদি কোনো প্রয়োজন ছাড়া এমনিতেই ইচ্ছা করে রোজা ভেঙে ফেলে, তবে বিরতিহীন ৬০টি রোজা কাফফারা ও একটি কাজাসহ মোট ৬১টি রোজা রাখবে। বিরতিহীন বলতে বুঝায়, কেউ যদি ৫০টি লাগাতার রেখে একদিন বাদ দেয় তবে তাকে আবার শুরু থেকে ৬০টি রাখতে হবে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে রোজার মাঝে হায়েজ আসলে, তা থেকে পবিত্র হয়ে যেখানে থেমেছিল তারপর থেকে কাফফারা আদায় করবে।
ইচ্ছাকৃত সহবাস করে ফেললে রোজার কাজ ও কাফফারা আদায় করবে।
কেউ যদি কাফফারা আদায় করতে না পারে অসুস্থতার কারণে (কোনো মরণব্যাধি বা বার্ধক্যজনিত কারণে) তবে সে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা পেটপুরে খাওয়াবে।
কেউ যদি এমন অসুস্থ হয়, তার আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে সে ফিদইয়া আদায় করবে। ফিদইয়া হচ্ছে, একটি রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাওয়ানো অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য তাকে দিয়ে দেওয়া (১.৫ কেজি পরিমাণ চাল, গম ও খেজুর। পুরো একমাসের ৪৫ কেজি)। তবে কেউ যদি আর সুস্থ হবে না ভেবে ফিদইয়া আদায় করে দেয় ও পরবর্তীতে সুস্থ হয়, তবে তার আদায়কৃত ফিদইয়া সদকা হিসেবে গন্য হবে ও তাকে রোজাগুলোর কাজা আদায় করতে হবে।
রোজা সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কিছু কথা
রোজা সহিহ শুদ্ধভাবে পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য অনেক শর্ত থাকলেও তারাবির নামাজের সাথে রোজার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অনেকে মনে করেন তারাবির ২০ রাকাত নামাজ আদায় না করলে রোজা শুদ্ধ হবে না।
কেউ যদি সব শর্ত রেখে রোজা রাখেন কিন্তু তারাবির নামাজ না পড়েন তবে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
তবে সারাবছর নয় বরং এই একটি মাসে বাড়তি সওয়াবের আশায় তারাবির নামাজ আদায় করে থাকি। কারণ রমজান মাস হলো বেশি বেশি ইবাদত করার মাস। তাই কোনো অজুহাত বের না করে তারাবির নামাজ পড়া উচিৎ। কারণ এটা একটি স্বতন্ত্র ইবাদত।
উল্লেখ্য যে, রোজার কাজা ও কাফফারা আদায়ের সময় তারাবির নামাজ পড়তে হয় না।
কারও যদি গোসল ফরজ হয় কিন্তু ফজরের ওয়াক্তের আগে সময় না পায় গোসল করার, তবে সে আগে সেহেরি খেয়ে নেবে ও আজানের পর গোসল করে নামাজ আদায় করবে।