শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী |
মানবচরিত্রের মন্দ স্বভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘গিবত’ ও ‘তুহমাত’। গিবত শব্দের অর্থ পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা, পরচর্চা করা, দোষারোপ করা; কারও অনুপস্থিতিতে তাঁর দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা। ইসলামি শরিয়তে গিবত হারাম ও কবিরা গুনাহ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে, মানুষের ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় ও প্রচার করে।…অবশ্যই তারা হুতামায় (জাহান্নামে) নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো, হুতামা কী? তা আল্লাহর প্রজ্বলিত হুতাশন, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে।
নিশ্চয় বেষ্টন করে রাখবে, দীর্ঘায়িত স্তম্ভগুলোতে।’ (সুরা-১০৪ হুমাজা, আয়াত: ১-৯)। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘যারা অগ্র-পশ্চাতে অন্যের দোষ প্রচার করে, তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের দুঃসংবাদ।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কি জানো, গিবত কাকে বলে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ভালো জানেন।’ তিনি বলেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা–ই গিবত।’
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি যে দোষের কথা বলি, সেটা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলেও কি গিবত হবে?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি যে দোষের কথা বলো, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তবে তুমি অবশ্যই গিবত করলে আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার ওপর তুহমত ও বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছ।’ (মুসলিম)
যদি কেউ কারও ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে ইসলামি দণ্ডবিধিতে তাঁকে ৮০ দোররা (চাবুক) দেওয়া হবে। শরিয়তে দৃষ্টিতে তাঁরা ফাসিক, পাপী, অপরাধী। ইসলামি আদালতে তাঁদের সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য নয়। আপনার সম্মুখে কেউ যখন অন্যের গিবত করেন, তখন তাঁকে থামতে বলুন, তা যদি করতে না পারেন, তবে সেখান থেকে সরে আসুন। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) গিবত বা পরনিন্দা ইসলামি শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ। গিবত করা ও গিবত শোনা সমান অপরাধ।
মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গুনাহ হলো গিবত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! গিবত কি জেনা-ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। কারণ, কোনো ব্যক্তি জেনার পর তাওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গিবতকারীকে যার গিবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না।’ (মুসলিম) মনে রাখতে হবে, একটি কবিরা গুনাহ কাউকে জাহান্নামে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
গিবতকারীর অপরাধের শাস্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং মিরাজে দেখে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমাকে (জাহান্নামের শাস্তি দেখানোর জন্য) তামার নখবিশিষ্ট একদল লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা তাদের নখগুলো দিয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলে ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হে জিবরাইল! তারা কারা?” জিবরাইল (আ.) বললেন, “এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গিবত ও চোগলখোরি করত।”’
(আবুদাউদ) রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়াতে যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে, অর্থাৎ গিবত করবে, কিয়ামতের দিন তাকে মৃত পচা মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য করা হবে। অতঃপর সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিৎকার করতে করতে তা ভক্ষণ করবে।’ (বুখারি)
ধারণাপ্রসূত বিষয় মিথ্যার শামিল। আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে বিরত থাকো। নিশ্চয় অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। তোমরা একে অপরের বিষয়ে অনুসন্ধান কোরো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দাবাদ কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ পছন্দ করে? তবে তা তোমরা ঘৃণাই করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১২)
রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা মন্দ ধারণা থেকে দূরে থাকো। কারণ, তা (অনেক ক্ষেত্রে) চরম মিথ্যাচারে পরিণত হয়।’ (সহিহ বুখারি: ৫১৪৩) প্রিয় নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘যা শুনে তা–ই বলা কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (মুসলিম) মিথ্যাবাদী অভিশপ্ত। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লানত।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৬১)
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘গিবতের কাফফারা হলো, তুমি যার গিবত করেছ, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। তুমি এভাবে বলবে, “হে আল্লাহ! তুমি আমার ও তার গুনাহ মাফ করে দাও।”’ (বায়হাকি)





Users Today : 992
Users Yesterday : 1060
This Month : 8627
This Year : 180498
Total Users : 296361
Views Today : 8708
Total views : 3529767