নিযামুল মুলকের হত্যাকান্ড: একটি সরল পর্যালোচনা:-
শুরুর আগের কথা!
ইসলামী পয়গাম ঈদসংখ্যা পড়ছিলাম। ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে। তাই শুরু করলাম ইশতিয়াক আহমাদের ‘যেভাবে খুন হলেন নিযামুল মুলক’ দিয়ে সাবলীল লেখা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গতি ধরে রেখেছেন। হোচট খেলাম একেবারে শেষে এসে। লেখক লিখেছেন, লোকটি কাছে আসতেই নিযামুল মুলক দেখলেন, লোকটি হাসান ইবনে সাব্বাহ। নিজামুল মুলকের কাছাকাছি আসতেই তার হাতে বেরিয়ে এলো দুধারী খঞ্জর। হাসান ইবনে সাব্বাহ নিজামুল মুলককে জাপটে ধরে তার বাম বুকে দুটি এবং গলার কাছে একটি আঘাত করে। মুহূর্তেই ঘটে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক একটি হত্যাকান্ড।
একটা ধাক্কা খেলাম নিযামুল মুলককে হাসান বিন সাব্বাহর দলের লোকেরা হত্যা করেছে সত্য। কিন্তু স্বয়ং হাসান বিন সাব্বাহ, নিযামুল মুলকের খুনী এমন তথ্য কোথাও পাইনি। ভাবলাম ইতিহাসগ্রন্থগুলো একটু নেড়ে দেখা যাক। সামান্য অনুসন্ধানে যা পেয়েছি তা নিয়ে এই লেখা। বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে নিযামুল মুলক ও হাসান বিন সাবাহর পরিচয় জেনে আসা যাক।
নিযামুল মুলক:
নিযামুল মুলকের জন্মা ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে (৪০৮ হিজরী)। তুস শহরে। ১১ বছর বয়সে হিফজ শেষ করেন। এরপর তাফসীর, হাদিস ও শাফেয়ী ফিকহে পান্ডিত্য অর্জন করেন। [১] প্রথমদিকে তিনি গজনীর সুলতানদের অধীনে চাকরি করতেন। পরে সেলজুকি সাম্রাজ্যের উজির হন। আল্প আরসালান (১০৬৩-১০৭২) ও মালিক শাহ সেলজুকির (১০৭২-১০৯২) রাজত্বকাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন, উজিরের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বাগদাদ ও অন্যান্য শহরে স্থাপিত নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তার অন্যতম প্রধান কীর্তি। আলেমদের খুব সম্মান করতেন। আজানের শব্দ শুনলে সব কাজ থামিয়ে দিতেন। [২] রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর লিখিত তার সিয়াসতনামা গ্রন্থটি তার পান্ডিত্যের প্রমান বহন করে। ৪৮৫ হিজরির ১০ রমজান (১৪ অক্টোবর ১০১২ খ্রিষ্টাব্দ) ইসফাহান থেকে বাগদাদ যাওয়ার পথে আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন।
হাসান বিন সাব্বাহ:
হাসান বিন সাব্বাহ জন্মসাল সম্পর্কে ইতিহাসগ্রন্থগুলো নীরব। কারো কারো মতে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম। তার পিতা ছিলেন শিয়াদের ইসনা আশারা মতবাদে প্রভাবিত। হাসান পিতার কাছ থেকে এই মতবাদ গ্রহন করে। পরে আরেক বরেন্য ইসমাইলী ব্যক্তিত্ব আব্দুল মালেক বিন আত্তাশের কাছে বিভিন্ন গুপ্তবিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি এই মতবাদের দীক্ষা নেয়। ৪৭১ হিজরীতে সে মিসরে সফর করে ফিরে এসে সে একটি গুপ্তঘাতক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে এর সদস্যদের হাশিশ নামক মাদক পান করানো হতো তাই তার অনুসারীদের হাশাশিন বলা হতো সে সেলজুকি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। পারস্যের আলামুত নামে একটি পার্বত্য দুর্গ দখল করে একে তার অনুসারিদের জান্নাত ঘোষনা দেয়। অনেক লড়াই ও যুদ্ধ করেও তাকে দমানো যায়নি। ১২ জুন ১১২৪ (২৬ রবিউস সানি ৫১৮ হিজরি) তে হাসান বিন সাব্বাহ মারা যায় তার মৃত্যতে হাশাশিনরা, যাদেরকে ফেদাইন বলা হতো, তারা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। [৩]
নিযামুল মুলকের একটি প্রাচীন অসিয়ত থেকে জানা যায়, উমর খৈয়াম, হাসান বিন সাব্বাহ ও নিয়ামুল মুলক বাল্যকালে একই মক্তবে পড়াশোনা করতেন। উর্দু উপন্যাসিকদের অনেকেই এই তথ্য বেশ জোরের সাথে প্রচার করেছেন। যেমন উর্দু উপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ তার ‘ফিরদাউসে ইবলিস’ গ্রন্থে, আলমাস এম এ তার ‘হাসান বিন সাবাহ’ গ্রন্থে, ইলিয়াস সীতাপুরী তার ‘রাগ কা বদন’ গ্রন্থে এমন তথ্য দিয়েছেন। তবে গবেষকদের মধ্যে এই তথ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। হাসান বিন সাব্বাহ সাথে নিযামুল মুলকের বয়সের পার্থক্যের কারনে তিনজনের সহপাঠী হওয়ার সম্ভাবনা কম। নিয়ামুল মুলকের অসিয়তে উল্লেখিত হাসান অন্য কেউও হতে পারেন। এ বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন সাইয়েদ সোলাইমান নদভী তার ‘উমর খৈয়াম’ গ্রন্থের ২০-৩০ পৃষ্ঠা এবং ড. আব্দুল হাদি মুহাম্মদ রেজা তার ‘নিযামুল মুলক’ গ্রন্থের ৩০৭-৩০৯ পৃষ্ঠায়।
নিযামুল মুলকের খুনী:
নিযামুল মুলকের হত্যাকান্ড ঘটে ৪৮৫ হিজরীর ১০ রমজানে এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের বক্তব্য দেখা যাক:-
“ইবনে কাসীর লিখেছেন, ৪৮৫ হিজরীর রমজানে সুলতান মালিক শাহ সেলজুকি ইস্ফাহান থেকে বাগদাদের দিকে রওনা হন। এসময় তার সাথে ছিলেন নিযামুল মূলক। কাফেলা নিহাওয়ান্দের কাছে এক গ্রামে এসে পৌছায়। নিযামুল মূলক বলেন, হজরত উমরের (রা) শাসনামলে এখানে অনেক সাহাবী শহীদ হয়েছেন। কতই না উত্তম তারা। ১০ম রোজায় ইফতার শেষে নিযামুল মুলক তাবুর দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় এক কুর্দি বালক এসে তার কাছে সাহায্য চায়। তিনি বালকের দিকে এগিয়ে যেতেই সে নিযামুল মুলকের পেটে ছুরি মারে নিযামুল মুলক মাটিতে পড়ে যান, বালক পালাতে গিয়ে তাবুর রশিতে পা আটকে পড়ে যায়, তাকে ধরে ফেলা হয় এবং হত্যা করা হয়। এই বালক ছিল ফেদাইন সুলতান মালিক শাহ সংবাদ পেয়ে নিয়ামুল মুলকের তাবুতে ছুটে আসেন। সুলতানের সামনেই নিযামুল মুলক প্রাণত্যাগ করেন। [৪]
“হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবীও অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি লিখেছেন: সেরাত ছিল জুমার রাত আহত হওয়ার পর নিযামুল মুলকের প্রথম কথা ছিল আমার খুনিকে তোমরা কিছু বলো না। আমি তাকে মাফ করে দিয়েছি। [৫] অন্যত্র তিনি লিখেছেন, এই হত্যার পেছনে সুলতান মালিক শাহ সেলজুকি জড়িত বলে গুজব আছে। [৬]
“ইবনে আসীর হত্যাকান্ডের বিবরণ দিয়েছেন তার বর্ননাতেও ভিক্ষার পাত্র হাতে উপস্থিত কুর্দি বালকের কথাই আছে। [৭]
“ইবনুল জাওযি এই হত্যাকান্ডের বিবরণে কুর্দি বালকের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনিও লিখেছেন সুলতান মালিক শাহ নিযামুল মুলকের উপর ক্রুদ্ধ ছিলেন এই হত্যায় তার যোগসাজশ থাকতে পারে। [৮]
“ইবনে খালদুন লিখেছেন, নিযামুল মুলক রাষ্ট্রের সকল কাজ পরিচালনা করতেন, সম্ভবত এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সুলতান তাকে হত্যা করেন তার হত্যার বিবরনেও কুর্দি বালকের উল্লেখ আছে। [৯]
“ইবনে খাল্লিকান লিখেছেন, এই হত্যাকান্ডে সুলতানের হাত আছে। [১০]
“ঐতিহাসিক সালাহুদ্দিন খলিল বিন আইবেক সাফাদিও কুর্দি বালকের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি লিখেছেন, এই হত্যাকান্ডের সাথে খলীফার যোগসাজশ ছিল নিযামুল মুলকের দীর্ঘ হায়াতে খলিফা বিরক্ত ছিলেন। [১১]
“ইবনে তাগরি বারদি লিখেছেন, কুর্দি বালকের হাতে একটি ভিক্ষার পাত্র ছিল। [১২]
“আবদুল্লাহ বিন আসআদ ইয়ামানি হত্যার বিবরণ দিয়ে লিখেছেন, তাজুল মুলকের সাথে নিযামুল মুলকের দ্বন্দ ছিল অনেকের মতে তাজুল মুলকই এই হত্যাকান্ড ঘটায়। [১৩]
প্রখ্যাত লেখক ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবীও নিযামুল মূলকের হত্যাকান্ডের ঘটনায় কুর্দি বালকের কথা উল্লেখ করেছেন। [১৪]
নেপথ্যে কে?
ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি থেকে পরিষ্কার, নিযামুল মুলকের হত্যাকারী এক কুর্দি বালক যে কিনা ফেদাইন গ্রুপের সদস্য ছিল হাসান সাব্বাহ নিযামুল মুলকের হত্যাকারী নয়,ফেদাইনরা ছিল গুপ্তঘাতক তারা রাজনৈতিক কারনে ও নগদ অর্থের বিনিময়ে হত্যা করতো। [১৫] নিযামুল মুলকের হত্যায় ভাড়াটে খুনীকে ব্যবহার করা হয়েছে আড়ালে কে রয়েছে সে সম্পর্কে ইতিহাস নীরব, ঐতিহাসিকরা নানা অনুমান করেছেন, যেমনটা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সকল বর্ননা পর্যালোচনা করে ড. আব্দুল হাদি মুহাম্মদ রেজা সন্দেহের তীর ছুড়েছেন তিনজনের দিকে তাজুল মুলক, হাসান বিন সাব্বাহ ও সুলতান মালিক শাহ। [১৬]
নিযামুল মুলকের সাথে তাদের তিনজনেরই দ্বন্দ ছিল। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। মূল বিষয় এটাই যে হাসান বিন সাব্বাহ নিজে সরাসরি নিযামুল মুলককে হত্যা করেনি। এই তথ্য কোনো ইতিহাসগ্রন্থ ও কিংবা ঐতিহাসিক সমর্থন করেন না।
রেফারেন্স:—
[১] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ইবনে কাসীর।
[২] আল ওয়াফি বিল ওয়াফায়াত: সালাহুদ্দিন খলিল বিন আইবেক সাফাদি।
[৩] নিযামূল মূলক : আব্দুল হাদি মুহাম্মদ রেজা।
[৪] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ইবনে কাসীর।
[৫] সিয়ারু আলামিন নুবালা: হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবী।
[৬] তারিখুল ইসলাম ওরা ওফায়াতুল মাশাহিরি ওয়াল আলাম : হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবী।
[৭] আল কামেল ফিত তারিখ: ইবনুল আসীর জাযারি।
[৮] আল মুস্তাজাম কি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম: আবুল ফারাজ জাওযি।
[৯] তারীখে ইবনে খালদুন: ইবনে খালদুন।
[১০] ওফায়াতুল আইয়ান ওয়া আনবাউ আবনাইয যামান: ইবনে খাল্লিকান।
[১১] আল ওয়াফি বিল ওফায়াত: সালাহুদ্দিন খলিল দিন আইবেক সাফাদি।
[১২] আন নুজুমুয যাহেরা ফি মুলুকি মিসর ওয়াল কাহেরা: ইবনে তাগরি বারদি।
[১৩] মিরআতুল জিনান ওয়া ইরাতুল ইয়াকজান ফি মারিফাতি মা ইউতাবারু মিন হাওয়াদিসিজ জামান: ইবনে সোলাইমান ইয়ামানী।
[১৪] দাওলাতুস সালাজিকা: ড.আলী মুহাম্মদ সাল্লাবী।
[১৫] হারাকাতুন হাশশাশিন: মুহাম্মদ উসমান খশত।
[১৬] নিযামুল মুলক: ড.আব্দুল হাদি মোহাম্মদ রেজা।
মুল তথ্যসূত্র: ইতিহাসের পাতা: ইমরান রাইহান।