অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কাজকেই মোজেজা বলা হয় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নবুয়তে। মোজেজার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরুদ্ধবাদীকে চ্যালেঞ্জ করা। চ্যালেঞ্জ বলা হয় এমন কাজকে, যাতে উভয়পক্ষ সমান শক্তি সম্পন্ন হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে যে কোনো একপক্ষ বিজয়ী হয়। তবে এটাই সুসাব্যস্ত যে, মোজেজার মধ্যে তাহাদ্দী বা চ্যালেঞ্জ থাকা শর্ত নয়। রসুলে করীম (ﷺ) এর মাধ্যমে এমন অনেক মোজেজা প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোতে চ্যালেঞ্জ ছিলো না। তবে উলামা কেরাম বলেন, বাহ্যত মোজেজার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ দেখা না গেলেও তার মহিমা কিন্তু চ্যালেঞ্জবিহীন নয়। মোজেজা নবুওয়াতের দাবী পেশ করার মাধ্যমে প্রকাশ হতে হবে। একথা সর্বজনবিদিত যে, নবীগণের মাধ্যমে যে অলৌকিকতা সংঘটিত হয়, তাই মোজেজা। আর অলৌকিক কার্যাবলী যদি নবী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যিনি ইমান, তাকওয়া, মারেফত ওদৃঢ়তার অধিকারী, যাকে বলা হয় ওলী, এমন লোকের মাধ্যমে প্রকাশিত অলৌকিক কাজকে বলা হয় কারামত। মুমিন এবং নেককার লোকের প্রকাশিত অলৌকিকত্বকে মাউনত বলা হয়। আর ফাসেক বা কাফেরদের দ্বারা যা প্রকাশ পায়, তাকে বলে এস্তেদরাজ। মোজেজা সম্পর্কে এলমে কালামে বহুবিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানে যেটুকু আলোচনা করা অপরিহার্য, তাই শুধু বলা হলো।
আম্বিয়া মুরসালীন সকলেই মোজেজার অধিকারী ছিলেন। মোজেজাবিহীন কোনো নবী ছিলেন না। তন্মধ্যে আমাদের নবী সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) এর মোজেজাসমূহ অন্যান্য নবী থেকে বেশী, পূর্ণ, শক্তিশালী, উজ্জ্বল, সুস্পষ্ট এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাবসম্পন্ন। পবিত্র কালামে মজীদে নবী করীম (ﷺ) এর মোজেজা সংক্রান্ত বহু আয়াত ও দলীল বিদ্যমান। তাছাড়া নবী করীম (ﷺ) এর নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে তওরাত, ইঞ্জীল ও অন্যান্য আসমানী কিতাবে অনেক কথা বলা হয়েছে। তন্মধ্যে নবী করীম (ﷺ) এর কথা প্রসঙ্গে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের কথা আলোচনা করা হয়েছে, যার কিছু অংশ আগেই বলা হয়েছে। তাছাড়া তাঁর জন্ম এবং নবুওয়াতপ্রাপ্তির দিনে যেসব অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ পেয়েছিলো, তারও আলোচনা করা হয়েছে। যেমন কুফুরীর জগত নিশ্চিহ্ন হওয়া, মুশরিকদের জনপদ পর্যুদস্ত হওয়া। এছাড়াও রয়েছে আরববাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও তাদের নানান আলোচনা। এর বিস্তারিত বিবরণ পরে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ্। আসহাবে ফীলের ঘটনা, পারস্যের হাজার বৎসরের অগ্নি-নির্বাপিত হওয়া, কেসরার রাজপ্রাসাদের পাথর পড়ে যাওয়া, সাতয়া সাগরের পানি শুকিয়ে যাওয়া, গণকদের স্বপ্নদর্শন, গায়েবী ঘোষণা হওয়া, গায়েবী আওয়াজ শুনতে পাওয়া ইত্যাদি সবই তাঁর নবুওয়াতের আলামত। জন্মগ্রহণের সময় দুধপান করার সময় থেকে নবুওয়াতপ্রাপ্তি পর্যন্ত এবং নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার প্রাবল্যের কারণে যেসকল অভূতপূর্ব ও সূক্ষ্ম বিষয়াদি সংঘটিত হয়েছে তার সবকিছুই বহুবিদিত হাদীছসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ অবস্থা ছিলো এই যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর এমন কোনো সম্পদ ছিলো না, যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেন, বা তাঁর সম্পদের লোভে পড়ে মানুষ তাঁর অনুগত হয়ে যেতে পারে। আবার শারীরিক শক্তিও এমন কিছু ছিলো না যে, তাঁর ভয়ে মানুষ ভীত হয়ে তাঁর অনুগত হয়েছিলো। যেদিন তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন এবং দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মানুষের কাছে গেলেন, তখন তাঁর সৈন্যসামন্তও ছিলো না, ধনসম্পদও ছিলো না। সেসময় মানুষ ভেসে যাচ্ছিলো মূর্তিপূজা আর মূর্খতাম-িত আচার সংস্কারের নির্বাধ প্রবাহে। কুসংস্কার,হিংসাবিদ্বেষ এবং হত্যালীলা ছিলো নিয়মিত ব্যাপার। এ সমস্ত অপকর্ম সম্পাদনের পরিণতি সম্পর্কে তারা চিন্তাই করতো না। আযাব বা শাস্তির ভয় ছিলো না তাদের। নিন্দা তিরস্কারের আশংকাও তারা করতো না। এ ধরনের জঘন্য অবস্থা ও কাজ নবী করীম (ﷺ)ই সংশোধন করে দিয়েছিলেন। তাদের অন্তঃকরণে বইয়ে দিয়েছিলেন প্রেম ভালোবাসার সুকুমার স্রোত। এক কলেমার নীচে সমবেত করেছিলেন সকলকে। তাদের অবস্থা এরূপ হয়ে গিয়েছিলো যে, অভিমতসমূহ একিভূত এবং অন্তররাজি সমন্বিত হয়ে গিয়েছিলো। সকলেই তাঁর অনুগত হয়েছিলেন। সত্যের সাহায্যের ব্যাপারে বিভিন্ন লোকের হৃদয় একই হৃদয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। তাঁরা নবী করীম (ﷺ) এর রূপসৌন্দর্য দর্শনে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ভালোবাসায় জন্মভূমি শহর, বাড়িঘর বিসর্জন দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। আপন কাওম ও আপনজন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য জীবন, সম্পদ উৎসর্গ করতে কুন্ঠিত হননি। রসুল করীম (ﷺ) এর সম্মানার্থে জীবনকে তলোয়ারের নীচে স্থাপন করতে দ্বিধা করতেন না। অথচ নবী করীম (ﷺ) এর এমন কোনো বিত্তবৈভব ছিলো না যে, সেগুলোর লালসা তাঁদের পেয়ে বসতে পারে। বরং নবী করীম (ﷺ) কে দেখা গেছে ধনীকে দরিদ্র বানিয়ে দিয়েছেন, আবার শরীফ ব্যক্তির সাথে বিনয় প্রদর্শন করেছেন। এই সমস্ত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য কি কোনো এক ব্যক্তির মধ্যে সন্নিবেশিত হতে পারে? চিন্তা ফিকিরের এবং চেষ্টার মাধ্যমে এগুলো অর্জন করা কি সম্ভব? তিনি ছিলেন এতীম। ছিলো না ধনসম্পদ, সাহায্য উপকরণ, যশপ্রতিপত্তি। তেমন সাহায্যকারীও ছিলো না। কিন্তু আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে এমন সম্মান, শক্তি, ক্ষমতা, সাহায্য, সহযোগিতা, মানমর্যাদা প্রদান করেছিলেন যে, তিনি হয়েছিলেন সকলের মধ্যমনি। সিদ্ধান্ত গ্রহণের চরম দৃঢ়তা তাঁকে দান করা হয়েছিলো। তাঁর কসমের বাণী “লাওয়াল্লাহে” (আল্লাহর কসম) সকলকে পর্যুদস্তকরে দিয়েছিলো। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে কোনো বুদ্ধিমান যদি চিন্তা করে, তাহলে তার সন্দেহ করার ক্ষমতা আর থাকবে না। তার পূর্ণবিশ্বাস হবে, এ সব কিছুই আল্লাহ্তায়ালার নির্দেশ ও আসমানী শক্তিমত্তার নিদর্শন। মানবীয় শক্তিতে এ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]