রসুলেপাক (ﷺ) বহু স্বপ্ন দেখেছেন এবং নিজে তার তাবীরও করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম স্বপ্ন ছিলো দুধ দেখা। তিনি তার তাবীর করেছেন দ্বীনের এলেম। বোখারী শরীফে হজরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি (ﷺ) তার তাবীর করেছেন দ্বীনের এলেম। বোখারী শরীফে হজরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি রসুল মকবুল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, আমি নিদ্রিত ছিলাম। আমার নিকট একটি দুধের পেয়ালা আনা হলো। আমি সে পেয়ালা থেকে এতোবেশী দুধ পান করলাম যে, আমার মুখমণ্ডলে পরিতৃপ্ততা দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো। অন্য এক বর্ণনায় আছে, রসুলেপাক (ﷺ) বলেছেন, আমি এতো বেশী পরিমাণে দুধ পান করলাম যে, দেখতে পেলাম আমার দেহের শিরা-উপশিরায় দুধ প্রবাহিত হলো। কিছু অবশিষ্ট ছিলো, তা আমি ওমরকে দিলাম। সাহাবীগণ নিবেদন করলেন, ইয়া রসুলালা হ! এর তাবীর কী? তিনি (ﷺ) বললেন, এর অর্থ দ্বীনের এলেম। শায়েখ ইবনে আবী জমরা (رحمة الله) বলেন, দুধ দেখার তাবীর যে এলেম হাসিল হওয়া, রসুল করীম (ﷺ) একথা মেরাজের ঘটনা দ্বারা বুঝেছিলেন। শবে মেরাজে সর্বপ্রথম রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে হাজির করা হয়েছিলো দুধ এবং শরাবের পেয়ালা। যে কোনো একটি গ্রহণ করার অধিকার তাঁকে দেয়া হয়েছিলো। তিনি দুধ পছন্দ করেছিলেন। তখন জিব্রাইল (عليه السلام) বলেছিলেন, আপনি ফিতরত অর্থাৎ দ্বীনকেই পছন্দ করেছেন। কোনো কোনো মরফু হাদীছে দুধের তাবীর ফিতরত হিসেবেও এসেছে। কোনো বর্ণনায় এসেছে এলেম। দুধের তাবীর এলেম হওয়ার যৌক্তিকতা হচ্ছে, দুধের মধ্যে উপকারিতা অত্যধিক, তেমনি এলেমের উপকারিতাও অনেক। দুধ শরীরকে পুষ্ট করে। এলেম পুষ্ট করে রূহকে। বান্দা মিসকীন শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী বলছেন, এ অধমও রসুলেপাক (ﷺ) এর দানকৃত সদকার কিছু অংশ পেয়েছে। তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে শাদা ও সুস্বাদু দুধে ভর্তি একটি পেয়ালা দেখলাম। আমি সেই দুধ পান করলাম। আলহামদুলিল্লাহি আলা যালিক।
রসুলেপাক (ﷺ) আরেকবার স্বপ্নে দেখেছিলেন একটি কামিয। তার তাবীর করেছিলেন, দ্বীন। ইমাম বোখারী (رحمة الله) আবু সাইদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুলে বারিক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি একদা নিদ্রিত ছিলাম। দেখি, আমার সামনে কিছু লোক। তাদের গায়ে বিভিন্ন আকারের কামীয, কারও কামীয বুক পর্যন্ত, কারও কামিয অত্যন্ত সংকীর্ণ যা গায়ে দেয়ার সময় গলায় আটকে যায়। আমার সামনে দিয়ে ওমর কে হেঁটে যেতে দেখলাম। তার কামীযটি ছিলো অত্যন্ত লম্বা, যা যমীন স্পর্শ করছিলো। হাদীছ শরীফে ‘ওয়ান’ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তার অর্থ দুটি ১. অত্যন্ত সংকীর্ণ জামা যা পরিধানের সময় গলায় আটকে যায়। ২. নাভী পর্যন্ত পৌঁছে এমন জামা। হাকীম তিরমিযী (رحمة الله) নুরুল সুমুল কিতাবে বর্ণনা করেছেন, কিছু লোকের কামীয নাভী পর্যন্ত ছিলো। কারও ছিলো নিসফে সাক পর্যন্ত। রসুলেপাক (ﷺ) এই স্বপ্নের তাবীর করেছেন দ্বীন অর্জনের নিদর্শনরূপে। যার কামীয যতটুকু লম্বা, তার মধ্যে দ্বীন হাসিল হবে সে পরিমাণে এটাই ছিলো তাঁর তাবীর। যৌক্তিকতা হচ্ছে, কামীয দুনিয়াতে দেহের সতরকে আচ্ছাদিত করে, তেমনি আখেরাতের ব্যাপারেও পর্দাপুশি করে এবং মাকরুহ কাজ থেকে বাঁচায়। যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, তাকওয়ার লেবাসই উত্তম লেবাস। কামীয সীনা পর্যন্ত, অর্থ হচ্ছে, কিছু সংখ্যক লোক কুফুরী থেকে সীনাকে বাঁচাবে কিন্তু কবীরা গোনাহ্ থেকে বাঁচতে পারবেনা। কামীয নাভী পর্যন্ত, তার অর্থ তার লজ্জাস্থান এবং পা বেআব্রু। সুতরাং সে গোনাহ্র দিকে চলবে। যাদের কামীয পা পর্যন্ত লম্বা, তারা তাকওয়া দ্বারা সমস্ত শরীর আচ্ছাদিত রাখবে। যার কামীয যমীন স্পর্শ করবে সে নেক আমলের ক্ষেত্রে কামেল। রসুলেপাক (ﷺ) যাদেরকে দেখলেন তাঁরা সাধারণ উম্মত হতে পারেন, আবার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিও হতে পারেন। রসুলেপাক (ﷺ) এর স্বপ্নসংক্রান্ত বর্ণিত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উম্মতের দ্বীনদার লোকদের মধ্যেও মর্যাদার তারতম্য থাকবে। সকল দ্বীনদার লোক একই রকম মর্যাদার অধিকারী হতে পারবেন না।
রসুলেপাক (ﷺ) আরেকটি স্বপ্ন দেখেছিলেন এরকম— তাঁর হাতে দুটি চুড়ি পরিয়ে দেয়া হয়েছে। মিথ্যা নবীর আবির্ভাব হবে বলে তিনি স্বপ্নটির তাবীর করেছিলেন। হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, একদা আমি নিদ্রামগ্ন ছিলাম। স্বপ্নে দেখতে পেলাম, আমাকে পৃথিবীর ভাণ্ডার দান করা হয়েছে। এর দ্বারা কায়সার ও কেসরার রাজত্বকে বুঝানো হয়েছে, যা তাঁর উম্মতের মাধ্যমে পরবর্তীতে বিজিত হয়েছিলো। দুনিয়ার স্বর্ণরৌপ্যের খনিও অর্থ হতে পারে, যা তাঁর উম্মতের জন্য আল্লাহ্তায়ালা নির্ধারিত করে রেখেছেন।
রসুলেপাক (ﷺ) বলেন, আমার দু হাতে দুটি স্বর্ণের চুড়ি পরিয়ে দেয়া হলে আমার খুব খারাপ লাগলো। খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ওহীর নির্দেশ এলো— চুড়ি দুটিতে ফুঁ দাও। ফুঁ দিতেই দেখলাম, চুড়িদুটো নেই। এক বর্ণনায় আছে,
সেগুলো উড়ে গেলো। রসুলেপাক (ﷺ) বলেন, চুড়ি দু’টির তাবীর এই যে, আমি বর্তমানে দু’জন মিথ্যা নবীর মধ্যবর্তী স্থানে আছি। এক মিথ্যা নবী ছিলো সাফা পর্বতের মধ্যে। আরেকজন ছিলো ইয়ামামায়। সে নবুওয়াত দাবি করেছিলো। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারদের একজনের নাম ছিলো আসওয়াদ আনাসী। সে সিলো ইয়ামন প্রদেশের। রসুলেপাক (ﷺ) এর ওফাতের পূর্বেই ফিরোজ দায়লামীর হাতে সে নিহত হয়েছিলো। অপর মিথ্যা নবী ছিলো মুসায়লামা কায্যাব। সে ইয়ামামায় নবুওয়াত দাবি করেছিলো। ইয়ামামা হেজাজের একটি শহরের নাম। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এর খলাফতকালে তাকে হত্যা করা হয়।
আহলে এলেমগণ বলেন, কোনো জিনিসকে যথাস্থানে না রাখা হলে তাকে বলা হয় কিযর বা মিথ্যাচার। চুড়ির স্থান রসুলেপাক (ﷺ) এর হাত নয়। সে হিসেবে নবুওয়াতের স্থানও ওই দুই ব্যক্তি নয়। কাজেই তারা মিথ্যা নবী। দুই কব্জিতে
দুটি চুড়ি দেখা রসুলেপাক (ﷺ) এর জন্য স্বাভাবিক নয়। চুড়ি রমণীদের অলংকার। এখানে আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে, স্বর্ণ পুরুষের জন্যে পরিধান করা নিষিদ্ধ। স্বর্ণের আরবী হচ্ছে যাহাবুন যা যেহাবুন থেকে এসেছে।
যেহাবুন এর অর্থ চলে যাওয়া। স্বর্ণ মানুষের হাত থেকে চলে যায়। স্থায়ী থাকে না। একারণেই রসুলেপাক (ﷺ) তাবীর করলেন, যারা মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি করবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ফেতনা বেশী দিন টিকবে না। স্বপ্নে আল্লাহ্তায়ালা হুকুম করেছিলেন চুড়ির উপর ফুঁ দিতে। এর তাবীর, এ ফেতনা বেশী দিন স্থায়ী হবে না।
ইমাম কুরতুবী বলেন, স্বপ্নের তাবীর বাস্তবে রূপ লাভ করেছিলো এভাবে যে, সাফা ও ইয়ামামার লোকজন ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। শুধু তাই নয়, তারা ইসলামের সাহায্যকারীও হয়েছিলো। পরবর্তীতে যখন দুই শহরে দুজন মিথ্যা নবী আত্মপ্রকাশ করেছিলো, তখন তাদের সুন্দর সুন্দর চটকদার বাক্য শুনে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকায় নিপতিত হয়েছিলো। ব্যাপারটি এমন হয়েছিলো, যেনো সেই দুই শহরের লোকগুলো সম্মিলিতভাবে দু’টি শহর আর দু’টি চুড়ি দুই মিথ্যা নবী। স্বপ্নের তাবীর এই দৃষ্টিকোণ থেকেও হতে পারে। কোনো কোনো আহলে এলেম এই স্বপ্নের তাবীর এভাবেও করে থাকেন যে, দুই হাতে দুই চুড়ি দেখার মানে হাতকে বেঁধে দেয়া অর্থাৎ নবুওয়াতের তৎপরতা থেকে তাঁকে বাধা প্রদান করা, দুই মিথ্যা নবী রসুলেপাক (ﷺ) এর নবুওয়াতের কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছিলো। তাইয়্যেবী এরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
রসুলেপাক (ﷺ) আরেকটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। কালো কুৎসিত এক জটা চুলধারী রমণী মদীনা মুনাওয়ারা থেকে বের হয়ে গেলো। তিনি (ﷺ) এর তাবীর করলেন, মদীনা মুনাওয়ারা থেকে একটি বালা সৃষ্টি হয়ে জুহফার দিকে চলে যাবে।
বোখারী শরীফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুল মকবুল (ﷺ) বলেছেন, আমি কালো কুৎসিত জটা চুলধারী এক রমণীকে দেখলাম মদীনা মুনাওয়ারা থেকে বের হয়ে মুহতাগায় দিয়ে থেমেছে। জুহফার অপর নাম হচ্ছে মুহতাগা, যা মক্কা মুকাররামা ও মদীনা মুনাওয়ারার মধ্যবর্তীতে অবস্থিত। স্থানটি ছিলো ইহুদীদের আবাস। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, আমি এ স্বপ্নের তাবীর এটাই মনে করি যে, মদীনা তাইয়্যেবা থেকে বালা জুহফার দিকে স্থানান্তরিত হবে। রসুলেপাক (ﷺ) মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পূর্বে সেখানে জ্বরজারি ইত্যাদি বহু বালা মুসিবত ছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) সেই বালা মুসিবতকে মদীনা থেকে বের করে কাফেরদের জনপদে চালিয়ে দিয়েছিলেন। কালো রমণী বালা মুসিবত বলে তাবীর করেছিলেন রসুলেপাক (ﷺ) – এর যৌক্তিকতা সম্পর্কে আহলে এলেমগণ বলেন, রসুলেপাক (ﷺ) সওদা (কালো) শব্দ থেকে সু (বালা) অর্থ করেছিলেন।
আরেকবার রসুলেপাক (ﷺ) স্বপ্নে তলোয়ার ঘুরাতে দেখলেন। দেখলেন, তলোয়ারটি কখনও কখনও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনও হয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক। হজরত আবু মুসা আশআরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, রসুলেপাক (ﷺ) বলেছেন, স্বপ্নে দেখলাম, আমি একটি তলোয়ার ঘুরাচ্ছি। তলোয়ারটি কখনও কখনও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। আবার কখনো হয়ে যাচ্ছে পূর্বের চেয়েও ধারালো। রসুলেপাক (ﷺ) তাঁর এই স্বপ্নের তাবীর করলেন, আল্লাহ্তায়ালা বিজয় এবং মুসলমান এই দুটিকে একত্রিত করে দিয়েছেন। উপরোক্ত তাবীরের যৌক্তিকতা সম্পর্কে আহলে এলেমগণ বলেন, রসুলেপাক (ﷺ) তলোয়ারের তাবীর করলেন সাহাবা। কেনোনা তাঁর সমস্ত শক্তি ও বিজয়ের মাধ্যম ছিলেন সাহাবা কেরাম। আর তলোয়ার ঘুরানোর ব্যাখ্যা করলেন, সাহাবীগণকে জেহাদ করতে হবে। তলোয়ার ভোঁতা হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা করলেন, কোনো কোনো সময় মুসলমানগণ পরাজয় বরণ করবে। পুনরায় তলোয়ার আরও ধারালো হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা করলেন, অবশেষে মুসলমানগণ একতাবদ্ধ হয়ে জেহাদে অংশ গ্রহণ করবে এবং তাদের বিজয় ও গৌরব প্রতিষ্ঠিত হবে। এ স্বপ্ন ছিলো উহুদযুদ্ধের পূর্বাভাস।
মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে হজরত আবু মুসা আশআরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, রসুলে করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, স্বপ্নে দেখলাম, আমি মক্কা মুকাররমা থেকে এমন স্থানে হিজরত করে যাচ্ছি, যেখানে রয়েছে অনেক খেজুরের বাগান। আমি মনে করলাম স্থানটি হয়তো হবে ইয়ামামা, না হয় খয়বর। কেনোনা সেখানে খেজুরের বাগান ছিলো অনেক। তারপর আমাকে জানিয়ে দেয়া হলো, স্থানটি ইয়াছরিব বা মদীনা মুনাওয়ারা। ইমাম আহমদ (رحمة الله) হজরত জাবের (رضي الله عنه) থেকে এরকমই একখানা হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, ওয়ারয়ে হুসায়না থেকে বের হয়েছি। আরও বর্ণনা রয়েছে, তিনি স্বপ্নে গরু জবেহ করতে দেখেছেন যা বাস্তবায়িত হয়েছিলো উহুদযুদ্ধে সাহাবীগণের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে। মেশকাত শরীফে হিজরতের কথা উল্লেখ না করে ইয়াছরিবের দিকে যাত্রা, তলোয়ার ঘুরানো, তলোয়ার ভোতাঁ হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে আবার আসল অবস্থায় ফিরে আসা ইত্যাদি একটি হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সে হাদীছে গরু জবেহ করার কথা বলা হয়নি।
রসুলেপাক (ﷺ) আরেকবার স্বপ্নে দেখেছিলেন, একটি কূপ থেকে তিনি পানি তুলছেন। হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, রসুলে মকবুল (ﷺ) এরশাদ করেছেন, স্বপ্নে দেখলাম একটি কূপের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। পাশে রয়েছে একটি বালতি। আমি সেই বালতি দিয়ে কূপ থেকে পানি তুললাম, যতটুকু মর্জি হয়েছিলো আল্লাহ্্তায়ালার। এরপর ইবনে আবু কুহাফা এলো। সেও সেই কূপ থেকে এক বালতি পানি ওঠালো। এক বর্ণনায় আছে, হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এলেন। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, আবু বকর এসে আমার হাত থেকে বালতি নিয়ে নিলো আমাকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য। আবু বকরের পানি ওঠানো দেখে আমি বিস্মিত হইনি। এতো বড় বালতি দিয়ে পানি তুলতে তার কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে মাফ করলেন। তারপর ওমর এসে এমনভাবে কূপ থেকে পানি ওঠালো, যেনো তার মতো সামর্থ্যবান বীরপুরুষ আর কেউ নেই। সে এতো বেশী পানি ওঠালো যে, সকল মানুষ সেই পানি পান করে পরিতৃপ্ত হলো।
এই হাদীছে রসুলেপাক (ﷺ) হজরত ওমর (رضي الله عنه) এর প্রশংসায় আবকারী শব্দ প্রয়োগ করেছেন। শক্তিশালী, সম্মানী এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে আবকারী বলা হয়। এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত ওমর (رضي الله عنه) পানি ভর্তি বালতি টান দিলেন। তাতে এতোবেশী পানি উঠলো যে, সকল লোক সেই পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করলো। এমনকি হাউয ভর্তি হয়ে পানি উপচে পড়তে লাগলো। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার বলেন, উক্ত খলিফা সাহাবী দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে কীর্তি রেখে গেছেন, সৎকর্ম সম্পাদন করেছেন এবং মানুষের কল্যাণ সাধন করেছেন, তারই নিদর্শন ছিলো রসুলেপাক (ﷺ) এর স্বপ্নটি।
নবী করীম (ﷺ) দুনিয়া থেকে পর্দা করার পর হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) খলীফা হলেন। খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে সর্বপ্রথম তিনি মুর্তাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন। সমূলে উৎপাটিত হলো তারা। একজনকেও জীবিত রাখা হলো না। তারপর হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) খলীফা হলেন। তাঁর খেলাফতকালে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বর্ধিত হলো। আবু বকর আমাকে আরাম দেয়ার জন্য আমার হাত থেকে বালতি নিয়ে নিলো। এর ব্যাখ্যা এই যে, মুমিন ব্যক্তি, পার্থিব ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে অনাবিল ও স্থায়ী আরাম পান মৃত্যুতে। হজরত রসুলে মকবুল (ﷺ) এই দুনিয়ার ঝামেলা থেকে বিদায় নিলে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। বালতি নেয়ার অর্থ এটাই।
রসুলেপাক (ﷺ) স্বপ্নের বৃত্তান্তে বলেছিলেন আবু বকরের পানি তুলতে কষ্ট হচ্ছিলো একথার তাৎপর্য এই যে, হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা এর খেলাফত কাল হবে সংক্ষিপ্ত। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) এর ওফাতের পর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন মাত্র দু বৎসর কয়েক মাস। তারপরই হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) এর খেলাফত শুরু হয়। তাঁর খেলাফত কাল ছিলো দীর্ঘ। তাঁর দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়েছিলো বেশী। তাঁর আমলে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানাও বৃদ্ধি পেয়েছিলো। অনেক দেশ ও রাজ্য মুসলিম রাষ্ট্রের অধীনে এসেছিলো। প্রশাসনিক শৃংখলা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। তাঁর দুর্বলতা সম্পর্কে রসুলেপাক (ﷺ) এর অনুযোগ ছিলো না। বরং এতে তাঁর প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছিলো।
রসুলেপাক (ﷺ) আরেকখানা স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইমাম মুসলিম (رحمة الله) হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে যার বর্ণনা পেশ করেছেন। তিনি বলেন, আমি রসুলেপাক (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, ইবনে রাফে এর ঘর থেকে এনে ইবনে তাব নামক খেজুর ভর্তি একটি তশতরী সাহাবীগণের সামনে রাখা হলো। হজরত উকবা ইবনে রাফে একজন সাহাবী। তিনি হজরত আমর ইবনে আস (رضي الله عنه) এর খালাত ভাই ছিলেন। একদম টাটকা তরতাজা এক প্রকার খেজুরের নাম ইবনে তাব। মূলতঃ ইবনে তাব এক ব্যক্তির নাম। তার নামেই এ খেজুরের নামকরণ হয়েছে। হয়তো ওই লোকটির দ্বারাই প্রথমে এই জাতের খেজুরের চাষ হয়েছিলো। অথবা সে এই প্রকারের খেজুরকে খুব বেশী পছন্দ করতো। তার জন্যই হয়তোবা এর নাম হয়েছিলো তামারে ইবনে তাব অর্থাৎ ইবনে তাবের খেজুর।
যা হোক, উক্ত স্বপ্ন দেখার পর রসুলেপাক (ﷺ) সকালবেলা তাবীর করলেন, ইবনে তাব নামক ব্যক্তি দুনিয়া এবং আখেরাতে কল্যাণের অধিকারী হবে। কেনোনা সে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেকে আল্লাহ্ ও আল্লাহর রসুলের সামনে পেশ করেছে। খেজুর যেমন মিষ্টি, তাঁর ইসলাম গ্রহণও আল্লাহ্পাকের কাছে তেমন মিষ্টি হিসেবে গৃহীত হয়েছিলো।
রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র স্বভাব ছিলো, তিনি ফজরের নামাজ আদায়ান্তে সাহাবীগণের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন এবং বলতেন, কেউ আজ রাতে কোনো স্বপ্ন দেখে থাকলে বলো। কেউ স্বপ্নের কথা না বললে তিনি নিজের দেখা স্বপ্নের কথা বলতেন। একদিন সকালবেলা রসুলেপাক (ﷺ) সাহাবীগণকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আজ রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছো কি? সকলেই বললেন, না।
রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার নিকট দুজন লোক এসেছে। তারা দুজনেই আমার হাত ধরে আমাকে বাইতুল মুকাদ্দাসের পবিত্র ভূমির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখি দুজন লোক। একজন দাঁড়িয়ে। আর একজন বসে। দাঁড়ানো লোকটির হাতে একটি লোহার গুর্জ। সে গুর্জ দিয়ে উপবিষ্ট লোকটির গণ্ডদেশে আঘাত করছে। লোহার গুর্জটি উপবিষ্ট লোকটির গ্রীবাদেশ পর্যন্ত দেবে যাচ্ছে। গুর্জটি উঠিয়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গে তার গ্রীবা পূর্বাবস্থা ফিরে পাচ্ছে। পুুনরায় দাঁড়ানো লোকটি গুর্জ মারছে আবার উঠিয়ে নিচ্ছে। এভাবে বার বার তাকে আঘাত করছে। সঙ্গী দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এর রহস্য কী? তারা আমাকে বললো, এগিয়ে চলুন। আমি আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। কিছু দূর গিয়ে দেখি, এক লোক কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার পাশে আরেকটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। দণ্ডায়মান লোকটির হাতে রয়েছে পাথর। সে ওই পাথর দিয়ে শায়িত লোকটির মাথা পিষ্ট করে দিচ্ছে। পাথর দ্বারা মস্তকে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেতলে যায়। পাথরটি উঠিয়ে নিলে মাথা পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক সুস্থ হয়ে যায়। এভাবেই বার বার আঘাত করা হচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী?
তারা বললো, এগিয়ে চলুন। আমি অগ্রসর হলাম। দেখলাম, তন্দুরের চুলার মতো এক বিশাল গর্ত যার মুখ খুবই সংকীর্ণ। কিন্তু পেট অত্যন্ত বড়। তার ভিতরে কতিপয় নারী ও পুরুষ রয়েছে, যারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের নীচে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। গর্তের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে নারীপুরুষগুলো আগুনে জ্বলতে জ্বলতে শিখার সঙ্গে গর্তের মুখ বরাবর উঠে আসে। প্রায় বেরিয়ে পড়বে এমতাবস্থা হয়। আগুনের শিখা নিস্প্রভ হয়ে গেলে তারা আবার গর্তের ভিতরে চলে যায়।
আমি বললাম, এর রহস্য কী? তারা বললো, সামনে চলুন। আমি চলতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি রক্তের নহরের কিনারায় পৌঁছলাম। দেখি, সেই নহরের পানিতে কিছুসংখ্যক লোক সাঁতার কাটছে। তীরে কিছু লোক দাঁড়িয়ে। তাদের সামনে রয়েছে পাথর। নহরের লোকগুলো সাঁতার কাটতে কাটতে হয়রান হয়ে কিনারে ওঠার চেষ্টা করলে দাঁড়ানো লোকগুলো তাদের মুখে পাথর ছুঁড়ে মারে। তখন তারা সাঁতার কেটে কেটে নহরের মধ্যবর্তী স্থানের দিকে চলে যায়। পুনরায় নহর থেকে উপরে আসার চেষ্টা করে, আর সেই লোকগুলো পুনরায় পাথর মেরে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এর রসহ্য কী? তারা বললো, এগিয়ে চলুন। আবার হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর গিয়ে এক সবুজ বাগানে পৌঁছলাম। বাগানে বিরাট একটা গাছের গোড়ায় বসে রয়েছে একজন বৃদ্ধলোক। তাঁর পাশে কিছু ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ঘোরাফেরা করছে। সেই বৃক্ষের কাছাকাছি আরেকজনকে দেখতে পেলাম। লোকটি তার সামনে আগুন প্রজ্জ্বলিত করছে। আমার সঙ্গী দুজন আমাকে গাছের উপরে নিয়ে গেলো। সে গাছের মধ্যে একটি ঘর দেখলাম। এতসুন্দর ঘর আমি ইতোপূর্বে দেখিনি। ঘরটির ভিতরে নারী পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ, বাচ্চা সব ধরনের মানুষ রয়েছে। আমাকে সেই ঘরের উপরে আরেকটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। এই ঘরটি পূর্বের ঘরের চেয়ে বড় এবং সুন্দর। এখানেও দেখলাম, সবধরনের মানুষ আছে। আমি আমার সঙ্গী দুজনকে বললাম, আজ রাতে আমাকে তো বহু দূর ঘুরালে, এখন বৃত্তান্তগুলো বলো।
তারা বললো, বৃত্তান্ত শুনুন। প্রথম যাকে দেখেছেন, যার গণ্ড দেশে আঘাত করা হচ্ছে,সে মিথ্যাবাদী। দুনিয়াতে সে মিথ্যা রটনা করতো। তার এই শাস্তি কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। যার মাথা থেতলে দেয়া হচ্ছে, সে হলো ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজীদ শেখার সুযোগ দিয়েছেন, অথচ সে রাত্রিবেলা কোরআন তেলাওয়াত না করে গাফেল হয়ে শুয়ে থাকতো। রাত্রিবেলা নামাজের জন্য উঠতো না। সে দিনের বেলায় কোরআন মজীদ অধ্যয়ন করে, অথচ তার উপর আমল করে না। তার শাস্তিও কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। তন্দুরের চুলায় রয়েছে ব্যভিচারে লিপ্ত নারী ও পুরুষ। যাদেরকে রক্তের নহরে হাবুডুবু খেতে
দেখেছেন, তারা সুদখোর। আর যে বৃদ্ধ লোকটিকে প্রকাণ্ড বৃক্ষের নীচে বসে থাকতে দেখেছেন, তিনি হচ্ছেন হজরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ (عليه السلام)। আর যে বাচ্চাগুলোকে তাঁর আশে পাশে ছুটাছুটি করতে দেখেছেন, তারা তাঁর বংশধর। যে লোকটিকে আগুন প্রজ্জ্বলিত করতে দেখেছেন, তিনি হচ্ছেন জাহান্নামের দারোগা মালিক ফেরেশতা। যে ঘরটি আপনি প্রথম দেখেছেন, তা হচ্ছে সাধারণ মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত জান্নাতের কক্ষ। তার উপরের ঘরটি শহীদদের। আর আমরা দুজন জিব্রাইল এবং মিকাইল। তারপর তাঁরা বললেন, মাথা ওঠান। আমি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেঘখণ্ডের ন্যায় কী যেনো। এক বর্ণনায় আছে, মেঘের মতো শাদা জিনিস চোখে পড়লো। তারা বললেন, এটি হচ্ছে আপনার জন্য জান্নাতের নির্দিষ্ট স্থান। আমি বললাম, আপনারা আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আমার জায়গায় চলে যাই। তাঁরা বললেন, এখনও আপনার দুনিয়ার জীবন শেষ হয়নি। দুনিয়ার জীবন শেষ হলে আপনি এখানে আসবেন। হাদীছখানা বর্ণনা করেছেন ইমাম বোখারী।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]