মুকতাদী সূরা ফাতেহা পড়বে না
কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইমামের পেছনে মুকতাদী সূরা ফাতেহা বা অন্য কোন সূরা পড়বে না। এর প্রমাণগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো :
জাহরী নামাযে ফাতেহা না পড়ার দলিল :
১.আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন
” وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون “
অর্থ: আর যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয়।
এ আয়াত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য তাফসীরে তাবারী (৯খ. ১০৩পৃ.) ও তাফসীরে ইবনে কাসীরে (২খ. ২৮পৃ.) এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে-
وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون ” يعني في الصلاة المفروضة
অর্থ : যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয় অর্থাৎ ফরজ নামাযে।
হযরত ইবনে মাসঊদ রা. এর মতও তাই। তাফসীরে তাবারীতে বলা হয়েছে:
صلى ابن مسعود، فسمع أناسا يقرءون مع الامام، فلما انصرف، قال: أما آن لكم أن تفقهوا ؟ أما آن لكم أن تعقلوا ؟ وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا كما أمركم الله
অর্থাৎ হযরত ইবনে মাসঊদ রা. নামায পড়ছিলেন, তখন কতিপয় লোককে ইমামের সঙ্গে কেরাত পড়তে শুনলেন। নামায শেষে তিনি বললেন : তোমাদের কি অনুধাবন করার সময় আসেনি, তোমাদের কি বোঝার সময় হয় নি? যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং নীরব থাকবে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন। (৯ খ. ১০৩ পৃ.)
যায়দ ইবনে আসলাম ও আবুল আলিয়া র. বলেছেন:
كانوا يقرأون خلف الإمام فنزلت : { وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون }
অর্থাৎ তাঁরা (সাহাবীগণ) ইমামের পেছনে কেরাত পড়তেন, তখন অবতীর্ণ হয়
وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল র. বলেছেন:
أجمع الناس على أن هذه الآية في الصلاة
অর্থাৎ এবিষয়ে সকলেই একমত যে, উক্ত আয়াত নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। (মাসাইলে আহমদ লি আবী দাউদ, পৃ. ৪৮)
ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. লিখেছেন,
في قول الله عز وجل: {وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا} . مع إجماع أهل العلم أن مراد الله من ذلك في الصلوات المكتوبة أوضح الدلائل على أن المأموم إذا جهر إمامه في الصلاة أنه لا يقرأ معه بشيء وأنه يستمع له وينصت. التمهيد ١١/٣٠-٣١
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার এ বাণী {وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا} দ্বারা সকল আলেমের ঐকমত্যে আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো ফরজ নামায, এতে একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, ইমাম যখন নামাযে জোরে কেরাত পড়বেন তখন মুকতাদীরা কিছুই পড়বে না, বরং কান পেতে শুনবে ও চুপ থাকবে।
ইমাম ইবনে তায়মিয়া র. বলেছেন,
فَإِنَّ لِلْعُلَمَاءِ فِيهِ ثَلَاثَةَ أَقْوَالٍ . قِيلَ : لَيْسَ لَهُ أَنْ يَقْرَأَ حَالَ جَهْرِ الْإِمَامِ إذَا كَانَ يَسْمَعُ لَا بِالْفَاتِحَةِ وَلَا غَيْرِهَا وَهَذَا قَوْلُ الْجُمْهُورِ مِنْ السَّلَفِ وَالْخَلَفِ وَهَذَا مَذْهَبُ مَالِكٍ وَأَحْمَد وَأَبِي حَنِيفَةَ وَغَيْرِهِمْ وَأَحَدُ قَوْلَيْ الشَّافِعِيِّ . وَقِيلَ : بَلْ يَجُوزُ الْأَمْرَانِ وَالْقِرَاءَةُ أَفْضَلُ . وَيُرْوَى هَذَا عَنْ الأوزاعي وَأَهْلِ الشَّامِ وَاللَّيْثِ بْنِ سَعْدٍ وَهُوَ اخْتِيَارُ طَائِفَةٍ مِنْ أَصْحَابِ أَحْمَد وَغَيْرِهِمْ . وَقِيلَ : بَلْ الْقِرَاءَةُ وَاجِبَةٌ وَهُوَ الْقَوْلُ الْآخَرُ لِلشَّافِعِيِّ . وَقَوْلُ الْجُمْهُورِ هُوَ الصَّحِيحُ فَإِنَّ اللَّهَ سُبْحَانَهُ قَالَ : { وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ } قَالَ أَحْمَد : أَجْمَعَ النَّاسُ عَلَى أَنَّهَا نَزَلَتْ فِي الصَّلَاةِ
অর্থাৎ এক্ষেত্রে আলেমগণের তিনটি মত রয়েছে। এক, কেউ কেউ বলেছেন, ইমাম যখন জোরে কেরাত পড়বেন আর মুকতাদী তা শুনবে তখন সে কোন কেরাতই পড়তে পারবে না। সূরা ফাতেহাও না, অন্য কোন সূরাও না। পূর্বসুরী ও পরবর্তী যুগের অধিকাংশ আলেমের মত এটাই। ইমাম মালেক র., ইমাম আহমাদ র. ও ইমাম আবূ হানীফা র. প্রমুখের মাযহাবও তাই। আর ইমাম শাফেয়ী র. এর দুটি মতের একটিও অনুরূপ। অতঃপর অন্য দুটি মত উল্লেখ করার পর ইবনে তায়মিয়া র. আরও বলেন, অধিকাংশ আলেমের মতটিই সঠিক। কারণ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন,
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থাৎ যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবন কর এবং নীরব থাক। তাহলে তোমাদের প্রতিও করুণা করা হবে। আর ইমাম আহমাদ বলেছেন, আয়াতটি সকলের মতে নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।
২. হযরত আবূ মূসা আশআরী রা. বলেছেন,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إذا قرأ الإمام فأنصتوا، فإذا كان عند القعدة فليكن أوّل ذكر أحدكم التشهد. أخرجه مسلم (৪০৪) في باب التشهد في الصلاة، وأحمد في المسند ৪/৪১৫ (১৯৯৬১)، وأبو داود (৯৭৩) وابن ماجه (৮৪৭) واللفظ له. كلهم من طريق سليمان التيمي عن قتاده عن يونس بن جبير (أبي غَلَّاب) عن حَطّان بن عبد الله الرقَّاشي عنه. وليس سليمان متفردا فيه بل تابعه عمر بن عامر وسعيد بن أبي عروبة عند الدارقطني والبيهقي، وأبو عبيدة مجّاعة بن الزبير العتابي الأزدي أحد الثقات عند أبي عوانة. وقال مسلم – لما سأله أبو بكر ابن أخت أبي النضر عن تفرد سليمان-: تريد أحفظ من سليمان؟
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন ইমাম কুরআন পড়বে, তোমরা তখন চুপ করে থাকবে। আর বৈঠকের সময় তাশাহহুদ-ই প্রথম পড়তে হবে।
মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪০৪; আবূ দাউদ, হাদীস নং ৯৭৩; ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৮৪৭; মুসনাদে আহমাদ, ৪খ, ৪১৫ পৃ, হাদীস নং ১৯৯৬১। ইমাম আহমদ, (দ্র. তামহীদ ১১/৩৪), ইমাম মুসলিম, ইবনুল মুনযির (দ্র. আল আওসাত, ৩/১০৫), ইমাম ইবনে জারীর তাবারী র. (দ্র. তাফসীরে তাবারী, ৯/১০৩) ও ইবনে হাযম জাহেরী (দ্র. আল মুহাল্লা, ২/২৭০) প্রমুখ এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। হাফেজ ইবনে তায়মিয়াও তার মাজমুউল ফাতাওয়ায় ইমাম মুসলিমের সহীহ বলাকে সমর্থন করেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী র. ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন, এটি সহীহ হাদীস। (দ্র. ২/২৪২)
কেউ কেউ মনে করেন, কাতাদার শিষ্যদের মধ্যে সুলায়মান তায়মী একাই হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন। কাতাদার অন্যান্য শিষ্যদের বর্ণনায় একথাগুলো নেই। এর জবাব দুভাবে দেওয়া যায়। এক. ইমাম মুসলিম যেভাবে জবাব দিয়েছেন। তার এক ছাত্র হাদীসটি বর্ণনায় সুলায়মানের নিঃসঙ্গতার প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, ‘তুমি কি সুলায়মানের চেয়ে বড় হাফেজে হাদীস চাও?’ অর্থাৎ সুলায়মান একজন শীর্ষ হাফেজে হাদীস। তার নিঃসঙ্গ বর্ণনা গ্রহণযোগ্য না হলে আর কার বর্ণনা গ্রহণযোগ্যতা পাবে? তার চেয়ে বড় হাফেজে হাদীস পাওয়া তো দুস্কর। দুই. সুলায়মান নিঃসঙ্গ নন। দারাকুতনী ও বায়হাকীর বর্ণনায় সাঈদ ইবনে আবূ আরূবা ও উমর ইবনে আমের: দুজনই কাতাদা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। (টীকা-১) এমনিভাবে আবূ আওয়ানার বর্ণনায় আবূ উবায়দা মুজ্জাআ ইবনুয যুবায়র (দ্র. ১৮/২০) কাতাদা থেকে সুলায়মানের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তিনজন সঙ্গী থাকতে সুলায়মানকে নিঃসঙ্গ ভাবা ঠিক নয়।
৩. হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا وَإِذَا قَالَ سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ فَقُولُوا رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ . رواه أبو داود والنسائي وابن ماجه وابن أبي شيبة من طريق أَبي خَالِدٍ عَنِ ابْنِ عَجْلاَنَ عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ عَنْ أَبِى صَالِحٍ عَنْه. وتابع أبا خالد محمد بن سعد الأشهلي أحد الثقات عند النسائي (٩٢٣) والدارقطني ١/٣٢٧ وتابعه أيضا محمد بن ميسر الصاغاني عند أحمد ٢/٣٧٦. وقد تعقب المنذري في تهذيب سنن أبي داود (৫৭৫) إعلال أبي داود بكلام طويل حاصله تصحيح هذه الزيادة والرد على من ضعّفه كأبي داود والدارقطني وإن مسلما صححها من حديث أبي موسى وأبي هريرة رضي الله عنهما.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইমাম নিয়োগ করার উদ্দেশ্য তাকে অনুসরণ করা । সুতরাং সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তখন তাকবীর বলবে। আর যখন কুরআন পড়বে, তখন তোমরা নীরব থাকবে। যখন সে سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলবে, তখন তোমরা রাব্বানা লাকাল হামদ বলবে।
আবূ দাউদ, হাদীস নং ৬০৪; নাসাঈ, হাদীস নং ৯২২-৯২৩; ইবনে মাজা, হাদীস নং ৮৪৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৮২০; মুসনাদে আহমদ, ২খ, ৩৭৬ পৃ; দারাকুতনী, ১খ, ৩২৭পৃ। ইমাম মুসলিম র. বলেছেন, هو عندي صحيح আমার দৃষ্টিতে এটি সহীহ। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪০৪।
ইমাম আবু দাউদের ধারণায় এ হাদীসে ‘যখন কেরাআত পড়া হয় তখন চুপ থাকবে’ কথাটি আবূ খালেদ আহমার একাই বর্ণনা করেছেন। তাই তিনি এটাকে আবূ খালেদের ভুল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু নাসাঈ শরীফের বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনে সা’দ নাহশালীও একই উস্তাদ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এটাকে আবূ খালেদের ভুল বলা ঠিক নয়। আবূ খালেদ ও নাহশালী দুজন তো বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। তারা দুজন ছাড়াও মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনে মুয়াছ্ছার একই উস্তাদ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি যঈফ।
উল্লেখ্য, এই হাদীসটির শুরুতে বলা হয়েছে, إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ ইমাম নির্ধারণের উদ্দেশ্য হলো তাকে অনুসরণ করা। এ বাক্যটি বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা রা. (হাদীস নং ৬৮৮) ও হযরত আনাস রা. (হাদীস নং ৩৭৮) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। এ বাক্যটি থেকেও প্রমাণিত হয় যে, মুকতাদী নীরব থাকবে। কেননা কুরআন পাঠকালে অনুসরণ কিভাবে করা হবে সে প্রসঙ্গে সূরা কিয়ামায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ (١٨) অর্থাৎ আমি যখন পাঠ করি আপনি তখন সেই পাঠের অনুসরণ করুন। এই ‘অনুসরণ’ শব্দটির ব্যাখ্যা বুখারী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে: استمع له وأنصت (হাদীস নং ৫) অর্থাৎ কুরআন পাঠকালে অনুসরণ করার অর্থ হলো কান পেতে শোনা এবং নীরব থাকা। সুতরাং কুরআন পড়ার সময় ইমামকে অনুসরণ করার অর্থও হবে তাই। এতটুকু কথা থেকে বিষয়টি বোঝা গেলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো স্পষ্ট করে এই দুই ও তিন নং হাদীসে বলে দিয়েছেন, ইমাম যখন কুরআন পড়বে তোমরা তখন চুপ করে থাকবে। যদি মুকতাদীর উপর সূরা ফাতেহা পড়া ফরজ হতো তবে তিনি এখানেই স্পষ্ট করে বলে দিতেন: ইমাম যখন কুরআন পড়বে, তখন তোমরাও পড়ো। কিন্তু এ কথা তো এ হাদীসের কোন সূত্রেই আসে নি।
স্মর্তব্য, হযরত আবূ হুরায়রা রা. বর্ণিত এই হাদীসটির উপর ইমাম নাসায়ী র. অনুচ্ছেদ শিরোনাম দিয়েছেন এভাবে : باب تأويل قوله عز و جل {وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون }
অর্থ: অনুচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী -যখন কুরআন পড়া হয় তখন মনোযোগের সাথে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়- এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। এই অনুচ্ছেদে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন এটি মূলত: উক্ত আয়াতেরই ব্যাখ্যা। হাদীসটিতে যে কথা বোঝানো হয়েছে, আয়াতটিতেও তাই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নামাযে ইমামের কুরআন পড়ার সময় মুকতাদীকে চুপ থাকতে হবে।
৪. হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ إِذَا قَالَ الْقَارِئُ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ. فَقَالَ مَنْ خَلْفَهُ آمِينَ . فَوَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ أَهْلِ السَّمَاءِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ . أخرجه مسلم في باب التسميع والتأمين (٤١٠) من طريق قُتَيْبَة بْنِ سَعِيدٍ عن يَعْقُوبَ- يَعْنِى ابْنَ عَبْدِ الرَّحْمَنِ – عَنْ سُهَيْلٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْه. وقريب منه ما رواه البخاري بلفظ إذا أمن القاري فأمنوا فإن الملائكة تؤمن (٦٤٠٢) وأخرجه ابن ماجه في باب الجهر بآمين من طريق سفيان عن الزهري عن سعيد بن المسيب وأبي سلمة بن عبد الرحمن عنه نحو رواية مسلم (٨٥٢)
অর্থ: কুরআন পাঠকারী (অর্থাৎ ইমাম) যখন বলে غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ এবং যারা তার পেছনে, তারা (মুকতাদীরা ) বলে আমীন, যার আমীন বলা আসমান বাসী ( ফেরেশতা) দের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪১০। ইমাম বুখারী র.ও স্বীয় সহীহ গ্রন্থে (হাদীস নং ৬৪০২) হাদীসটি এভাবে উল্লেখ করেছেন- কুরআন পাঠকারী যখন আমীন বলবে, তোমরাও তখন আমীন বলবে। কেননা ফেরেশতাগণও আমীন বলে থাকে। ইমাম ইবনে মাজা র.ও হাদীসটি মুসলিম শরীফের অনুরূপ উদ্ধৃত করেছেন। (দ্র, হাদীস নং ৮৫১-৮৫২)
মুসলিম শরীফের হাদীস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, জামাতের নামায সম্পর্কেই এ হাদীসটি বলা হয়েছে। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ইমামকেই কারী অর্থাৎ কুরআন পাঠকারী বলে অভিহিত করেছেন। বোঝা গেল, নামাযে কুরআন পাঠ করা ইমামেরই কর্তব্য। যদি ইমাম ও মুকতাদী সবার জন্য কুরআন পাঠের বিধান থাকতো তবে শুধু ইমামকে এ বিশেষণে উল্লেখ করা হতো না।
উল্লেখ্য যে, ফজর মাগরিব ও এশা: এই তিন নামাযে ইমামকে স্বরবে কিরাআত পড়তে হয়। স্বরবে কিরাআতের উদ্দেশ্যই তো হলো, ইমাম পড়বেন, আর অন্যরা শুনবেন। এখন যদি মুকতাদিকেও কিরাআত পড়তে হয়, তবে ইমামের স্বরব কিরাআতের কোন অর্থ হয় না। শ্রবণকারী না থাকলে ইমাম জোরে কিরাআত পড়বেন কেন, লাউডস্পিকার বা মাইকই বা ব্যবহার করবেন কেন?
৫. হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال إذا قال الامام غير المغضوب عليهم ولا الضالين فقولوا آمين فانه من وافق قوله قول الملائكة غفر له ما تقدم من ذنبه. أخرجه البخاري (٧٨٢
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইমাম যখন غير المغضوب عليهم ولا الضالين বলবে, তোমরা তখন আমীন বলো। কেননা যার আমীন বলা ফেরেশতা আমীন বলার সঙ্গে মিলে যাবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৭৮২
এই হাদীস থেকেও বোঝা যায়, মুকতাদী সূরা ফাতেহা পাঠ করবে না। কারণ, এক, মুকতাদী সূরা ফাতেহা পাঠে ব্যস্ত থাকলে ইমাম কখন غير المغضوب عليهم ولا الضالينপড়ছেন তা খেয়াল রাখা সম্ভব হবে না। ফলে যথাসময়ে আমীন বলাও হয়ে উঠবে না। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে মুকতাদীকে ইমামের غير المغضوب عليهم ولا الضالين বলার প্রতি খেয়াল রাখতে বলবেন, অপরদিকে সূরা ফাতেহা পাঠের আদেশ দিয়ে তাকে ব্যস্ত করে রাখবেন, এমনটা হতে পারে না। দুই, যে মুকতাদী নামায শুরুর কিছুক্ষণ পর এসে শরীক হল, সে যদি সূরা ফাতেহা পাঠ শুরু করে দেয়, আর ইতিমধ্যেই ইমাম غير المغضوب عليهم ولا الضالين বলে ফেলেন, তবে সেই মুকতাদী কি করবে? যদি সে তার পড়াই চালু রাখে তাহলে ইমামের সঙ্গে তার আমীন বলা হলো না। অথচ এ হাদীসে তাকে ইমামের সঙ্গে আমীন বলতে বলা হয়েছে। আর যদি সে তার পড়া বন্ধ করে দিয়ে ইমামের সঙ্গে আমীন বলে, এরপর অবশিষ্ট অংশ পাঠ করে তবে তার আমীন ‘মোহর’ হবে না। অথচ আবূ দাউদ শরীফের হাদীসে (হাদীস নং ৯৩৮) বলা হয়েছে আমীন মোহরের ন্যায় ( مثل الطابع على الصحيفة )। জানা কথা, সিলমোহর শেষেই হয়ে থাকে। তাছাড়া আমীন শব্দটি কুরআনের আয়াত নয়। তাই সূরা ফাতেহার মাঝখানে আমীন বলার অর্থ – কুরআন নয় এমন কিছুকে কুরআনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া।
এসব কারণে অনেক মুহাদ্দিস এই হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, মুকতাদি ফাতেহা পড়বে না। ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. তাঁর তামহীদ গ্রন্থে বলেছেন,
وفي هذا الحديث دلالة على أن المأموم لا يقرأ خلف الإمام إذا جهر لا بأم القرآن ولا بغيرها لأن القراءة بها لو كانت عليهم لأمرهم إذا فرغوا من فاتحة الكتاب أن يؤمن كل واحد منهم بعد فراغه من قراءته لأن السنة فيمن قرأ بأم القرآن أن يؤمن عند فراغه منها ومعلوم أن المأمومين إذا اشتغلوا بالقراءة خلف الإمام لم يكادوا يسمعون فراغه من قراءة فاتحة الكتاب فكيف يؤمرون بالتأمين عند قول الإمام { ولا الضالين } ويؤمرون بالاشتغال عن استماع ذلك هذا ما لا يصح
অর্থাৎ এই হাদীসে একথার নির্দেশ রয়েছে যে, ইমাম যদি স্বশব্দে কেরাত পড়ে থাকেন তবে মুকতাদি তার পেছনে কেরাত পড়বে না। সূরা ফাতেহাও না, অন্য কোন সূরাও না। কারণ তাদের উপর যদি কেরাত পড়া আবশ্যক হতো, তাহলে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হতো, প্রত্যেকে যেন নিজ নিজ ফাতেহা পাঠ শেষে আমীন বলে। কেননা যে ব্যক্তিই সূরা ফাতেহা পাঠ করে তার জন্যই সুন্নত হলো সেটি পাঠ সমাপ্ত করে আমীন বলা। আর একথাও সকলের জানা যে, মুকতাদি যদি ইমামের পেছনে সূরা পাঠে ব্যস্ত থাকে তবে তার পক্ষে ইমামের ফাতেহা পাঠ কখন শেষ হলো সেদিকে খেয়াল রাখা খুবই দুস্কর। এমতাবস্থায় তাকে ইমাম সাহেবের ولا الضالين বলার সময় আমীন বলার নির্দেশ দেওয়া হবে, আবার ইমামের পাঠ থেকে অন্যমনস্ক থাকারও নির্দেশ দেওয়া হবে তা হতে পারে না। (তামহীদ, সুমাই এর ৩ নং হাদীস)
একইভাবে হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী রহ. তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে লিখেছেন,
ولما كان المأموم مأموراً بالإنصات لقراءة الإمام ، مأموراً بالتأمين على دعائه عند فراغ الفاتحة ؛ لم يكن عليهِ قراءة ؛ لأنه قد أنصت للقراءة ، وأمن على الدعاء ، فكأنه دعا ؛ كما قال كثير من السلف في قول الله تعالى لموسى وهارون : قَدْ أُجِيبَتْ دَعْوَتُكُمَا قالوا : كان موسى يدعو وهارون يؤمن ، فسماهما داعيين
অর্থাৎ মুকতাদিকে যখন ইমামের কেরাত মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলা হলো এবং ইমামের ফাতেহা পাঠ শেষে তার দোয়ার উপর আমীন বলতে নির্দেশ দেওয়া হলো, এতে প্রমাণিত হলো যে, মুকতাদির উপর কেরাত পড়ার দায়িত্ব নেই। কেননা সে যখন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করলো এবং তার দোয়ার উপর আমীন বললো, তখন ধরে নিতে হবে যে, সে নিজেও দোয়া করলো। যেমন পূর্বসূরিগণের অনেকেই বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামকে বলেছেন: তোমাদের দু’জনের দোয়াই কবুল করা হলো, তাঁরা বলেছেন, আসলে মূসা আ.ই দোয়া করেছিলেন, আর হারূন আ. আমীন আমীন বলেছিলেন। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা দুজনকেই দোয়াকারী আখ্যা দিয়েছেন। (৪/২২৭)
৬. হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,
…. أن رسول الله صلى الله عليه و سلم انصرف من صلاة جهر فيها بالقراءة فقال : هل قرأ معي منكم من أحد ؟ فقال رجل: أنا يا رسول الله قال: فقال : إني أقول ما لي أنازع القرآن ؟ فانتهى الناس عن القراءة مع رسول الله صلى الله عليه و سلم فيما جهر به من الصلاة حين سمعوا ذلك. أخرجه مالك في الموطا صـ ٢٩ والترمذي (٣١٢) وقال حديث حسن و أبو داود (٨٢٦) والنسائي (٩١٩) وابن ماجه (٨٤٨-٨٤٩) وأحمد في مسنده ٢/٢٨٤
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করলেন, যে নামাযে তিনি উচ্চস্বরে কেরাত পড়েছিলেন। অতঃপর বললেন, তোমাদের কেউ কি একটু পূর্বে আমার সঙ্গে কুরআন পড়েছে? তখন একজন বললেন, হ্যাঁ, আমি পড়েছি ইয়া রাসূলুল্লাহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাইতো বলছি আমার সঙ্গে কুরআন নিয়ে টানাটানি হচ্ছে কেন? লোকেরা যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একথা শুনলেন, সেদিন থেকে সেসব নামাযে কুরআন পড়া ছেড়ে দিলেন, যেসব নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চস্বরে কুরআন পড়তেন।
মুয়াত্তা মালেক, পৃ,২৯; তিরমিযী, হাদীস নং ৩১২, তিনি এটিকে হাসান বলেছেন। আবূ দাউদ, হাদীস নং ৮২৬; নাসায়ী, হাদীস নং ৯১৯; মুসনাদে আহমদ, ৪খ, ২৮৪পৃ; ইবনে মাজা, হাদীস নং ৮৪৮, ৮৪৯।
উল্লেখ্য, এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চস্বরে কুরআন পড়ছিলেন, তাতেই তাঁর কেরাতে সমস্যা হচ্ছিল। হযরত শায়খুল হিন্দ র. বলেছেন, ‘অনুচ্চস্বরে কুরআন পড়ার ক্ষেত্রে তো আরো বেশী সমস্যা হওয়ার কথা।’ তাই যেসব নামাযে ইমাম অনুচ্চস্বরে কেরাত পড়েন সেসব নামাযেও যে মুক্তাদীর কেরাত পড়া উচিত নয়, সেটা এ হাদীসেরই দাবী।