আমরা কেন দরুদ-সালাম ও আজানের পর দুআ পাঠ করি..!! এগুলো দেখে কেন রাসূলুল্লাহ ﷺ খুশি হন..!!
—
কোন উম্মত রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করলে কিংবা আজানের পর দুআ পাঠ করলে তিনি আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় এটা দেখতে পান, শুনতে পান এবং খুশি হন। কিন্তু তাঁর খুশি হওয়ার কারণ এই নয় যে, উম্মতের দুআর বরকতেই আল্লাহ তায়ালা উনাকে মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করবেন। কেননা এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ঐ মাকামটা একমাত্র আমাদের রাসূলের জন্যই নির্ধারিত। এটা হতে পারে যে, তিনি খুশি হন কারণ এতে তাঁর উম্মতের জন্য কল্যাণ রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ যদি তোমাদের কোন ভালো আমল দেখি তাহলে আমি আল্লাহর নিকট প্রশংসা করবো, আর তোমাদের মন্দ কাজ দেখলে আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবো। [ইমাম বাযযার রহঃ আল-মুসনাদঃ ৫/৩০৮ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ১৯২৫, জালালুদ্দিন সুয়ূতি রহঃ জামিউস সগীরঃ ১/২৮২ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৩৭৭০-৭১,
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৫৭ পৃষ্ঠা,…]
আমরা কেন দরুদ-সালাম ও আজানের পর দুআ পাঠ করি..!!
প্রথমত বলতে চাই, আমরা দরুদ ও সালাম পাঠ করি কেননা এটা স্বয়ং রবের নির্দেশ এবং নামাজের মধ্যে পাঠ না করলে তো নামাজই আদায় হবে না। আর আজানের পর দুআ পাঠ করা এটা মহান রবের প্রিয় হাবিবের নির্দেশ এবং এটা আমাদের জন্য তোহফা যেন এর মাধ্যমে কিয়ামতে দিবসে প্রিয় নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর শাফায়াত লাভ করতে পারি।
দ্বিতীয়ত, প্রিয় নবী ﷺ এঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করা হল তাঁর সাথে রুহানী সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম একটা মাধ্যম এবং তাঁর প্রতি ভালবাসার অন্যতম এক বহিঃপ্রকাশ।
তৃতীয়ত, আমরা তাঁর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করি যেন কিয়ামতের ময়দানে আমরা তাঁর নৈকট্য হাসিল করতে পারি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ কিয়ামতের দিন আমার নিকটতম ব্যক্তি হবে যে আমার প্রতি বেশি পরিমাণে দরূদ পাঠ করেছে। (সূনান আত তিরমিজি ৪৮৪)
চতুর্থত, আমরা দরুদ পাঠ করি যেন এর উসিলায় আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তা’আলা তার উপর দশটি রহমত নাযিল করবেন, তার দশটি শুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে এবং তাঁর জন্য দশটি মর্যাদা উন্নীত করা হবে। [সূনান নাসাঈ (ইফাঃ) ১৩০০]
পঞ্চমত, দরুদ না পড়লে দুআ কবুল হয় না।
একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ (মসজিদে) বসা অবস্থায় ছিলেন। সে সময় জনৈক লোক মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করল, তারপর বলল, “হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং আমার প্রতি দয়া কর”। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ হে নামাজী! তুমি তো তাড়াহুড়া করলে। যখন তুমি নামায শেষ করে বসবে সে সময় শুরুতে আল্লাহ’র যথোপযুক্ত প্রশংসা করবে এবং আমার উপর দরূদ (ও সালাম) প্রেরণ করবে, তারপর আল্লাহ’র নিকটে দু’আ করবে। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর অপর লোক এসে নামাজ আদায় করে প্রথমে আল্লাহ’র প্রশংসা করল, তারপর নবী ﷺ এঁর উপর দরূদ পেশ করল। নবী ﷺ তাকে বললেনঃ হে নামাযী! এবার দুআ কর কবুল করা হবে।
(সূনান আত তিরমিজী ৩৪৭৬)
এভাবে বলতে থাকলে দরুদ ও সালামের ফজিলত বলে শেষ করা যাবে বলে মনে হয় না। তবুও শুধুমাত্র সিহাহ সিত্তাহ থেকে আর কয়েকটি বলেই শেষ করছি।
নবী ﷺ বলেনঃ যখন কোন মুসলিম ব্যাক্তি আমার প্রতি দুরূদ পাঠ করে এবং যতক্ষণ সে আমার প্রতি দুরূদ পাঠরত থাকে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার জন্য দুআ করতে থাকেন। অতএব বান্দা চাইলে তার পরিমাণ (দরূদ পাঠ) কমাতেও পারে বা বাড়াতেও পারে। (সূনানে ইবনে মাজাহ ৯০৭)
আবূ তালহা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ﷺ একদিন (আমাদের কাছে) আগমন করলেন। তখন তাঁর চেহারায় প্রফুল্লতা দৃষ্টি গোচর হচ্ছিল। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমরা আপনার চেহারায় খুশী লক্ষ্য করছি, যা আগে কখনো দেখিনি। তিনি বললেন, “হাঁ। একজন ফিরিশতা (জিবরীল আলায়হিস সালাম) আমার কাছে এসে বললেন, ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ! আপনার রব আপনার উদ্দেশ্যে বলেছেন: ‘আপনাকে কি এই সংবাদ খুশি করে না যে, আপনার উম্মতের মধ্য থেকে যদি কোন ব্যক্তি আপনার উপর একবার সালাত (দরুদ) পাঠ করে আমি তাকে দশবার রহমত করব, আর কেউ যদি আপনাকে একবার সালাম পাঠায় আমি তার প্রতি দশবার সালাম পাঠাব।’ তিনি বলেন, “আমি বললাম, হ্যাঁ ।” [সুনান আদ-দারেমী ২৮১১, সুনান নাসাঈ ইফাঃ ১২৮৩, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৮]
তুফায়ল ইবন উবাই ইবন কা‘ব তার পিতা উবাই ইবন কা‘ব রাঃ বলেন, রাত্রির দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ ﷺ উঠে দাঁড়াতেন। বলতেনঃ হে লোক সকল, তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর, তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর, প্রথম শিংগা ধ্বনির সময় আসছে তাকে অনুসরণ করবে পরবর্তী শিংগা ধ্বনি। মৃত্যু তার সব ভয়াবহতা নিয়ে সমাগত, মৃত্যু তার সব কিছু নিয়ে সমাগত। উবাই রাঃ বললেনঃ আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ﷺ!, আমি আপনার উপর অধিক হারে দরূদ পাঠ করে থাকি। আমার সময়ের কতটুকু (আবশ্যক ইবাদতসমূহ আদায়ের পর) আপনার প্রতি দরূদ পাঠে ব্যয় করব?
তিনি বললেনঃ তোমার যতটুকু ইচ্ছা। আমি বললামঃ এক চতুর্থাংশ সময়? তিনি বললেনঃ তোমার ইচ্ছা। কিন্তু যদি আরো বাড়াও তবে ভাল। আমি বললামঃ অর্ধেক সময়? তিনি বললেনঃ তোমার যা ইচ্ছা; তবে আরো বৃদ্ধি করলে তা-ও ভাল। আমি বললামঃ দুই তৃতীয়াংশ সময়? তিনি বললেন, তোমার ইচ্ছা; তবে আরো বাড়ালে তাও ভাল। আমি বললামঃ আমার সবটুকু সময় আপনার উপর দরূদ পাঠে লাগাব? তিনি বললেনঃ তাহলে তো তা তোমার চিন্তামুক্তির জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে আর তোমার গুনাহ মাফ করা হবে। (সূনান আত তিরমিজী ২৪৫৭)
এখানেই থামলাম।
স্পষ্টত প্রমাণ হয়ে গেল আমরা নিজেদের স্বার্থেই দরুদ-সালাম পাঠ করি।
অথচ মামুনুল হক দেওবন্দী বলছে, মাকামে মাহমুদ একজন নবী পাবেন এবং তিনি আশা করেন যে, আমাদের নবী ঐ মাকামে মাহমুদের আসন পাবেন। অতঃপর বলছেন, উম্মতের দোয়া-দরুদের বরকতে এটা লাভ করবেন। এজন্যই নাকি উম্মতরা দুআ করলে রাসূলুল্লাহ ﷺ খুশি হন (নাউজুবিল্লাহ)
আমাদের নবী মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত হতে কি আমাদের দোয়া দরুদের মুখাপেক্ষী…! অথচ কুরআনে পাকের ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারাও ঐ নবীর উপর দরুদ পড়েন (প্রশংসা করেন, রহমত প্রেরণ করেন)…..আমরা দোয়া দরুদ না পড়লে কি ঐ স্থান অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া হবে…!
আমার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন,
‘‘অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে মাকামে মাহমুদে (যেখানে সব কিছুই আপনার প্রশংসা করবে) উন্নীত করবেন।’’ (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭৯)
উক্ত আয়াতের তাফসীরে, সহীহ বুখারীতে রয়েছে,
ইবনে ‘উমার (রাঃ) বলেন, নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। প্রত্যেক নবীর উম্মত স্বীয় নবীর অনুসরণ করবে। তারা বলবেঃ হে অমুক (নবী)! আপনি সুপারিশ করুন। হে অমুক (নবী)! আপনি সুপারিশ করুন। (কেউ সুপারিশ করতে চাইবেন না)। শেষ পর্যন্ত সুপারিশের দায়িত্ব নবী মুহাম্মাদ ﷺ এঁর উপর পড়বে। আর এ দিনেই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে “মাকামে মাহমূদ” এ পৌঁছাবেন।
(সহীহ বুখারী ৪৭১৮)
সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, আমাদের নবীকেই মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করা হবে আর উক্ত আয়াতে এটারই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু বক্তা আর অনুবাদকের অনুবাদ দেখে মনে হয় তারা এখনো নিশ্চিত না যে, এ আসন কাকে দেয়া হবে..? যেমন একজন অনুবাদ করেছে, “হয়ত বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।” একজন অনুবাদ করেছে, “হতে পারে তোমার প্রভু তোমাকে উন্নীত করবেন এক সুপ্রশংসিত অবস্থায়।” আর মামুনুল হক সাহেবের আশার কথা তো বললামই। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত আহমদ রেজা খাঁ রহঃ অনুবাদ করেছেন, (যার বাংলা অনুবাদ) “একথা সন্নিকটে যে কিংবা অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে এমন স্থানে দন্ডায়মান করবেন যেখানে সকলেই আপনার প্রশংসা করবে।”
হ্যা, আমাদের নবীকে উক্ত স্থানের প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও আমরা আযানের পর এই দুআ-
اللهم رب هذه الدعوة التامة و الصلوة القائمة ات سيدنا محمدن الوسيلة و الفضيلة و الدرجة الرفيعة و ابعثه مقاما محمودن الذى وعدته و ارزقنا شفاعته يوم القيامة انك لا تخلف الميعاد
পড়ি যেন আমরা এর দ্বারা শাফায়াত লাভ করতে পারি, এজন্য নয় যে, যেন ঐ মাকামে মাহমুদ আমাদের নবীকে না দিয়ে অন্য কাউকে যেন দিয়ে দেয়া না হয়।
জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি আযান শোনার পর এ দু‘আ পড়বে, ‘‘হে আল্লাহ্! এ পরিপূর্ণ আহবানের এবং প্রতিষ্ঠিত সালাতের রব, মুহাম্মাদ ﷺ-কে ওয়াসীলা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান কর, প্রতিষ্ঠিত কর তাঁকে মাকামে মাহমূদে, যার ওয়াদা তুমি করেছ’’ ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য আমার শাফা‘আত অবধারিত হয়ে যাবে।
(সহীহ বুখারী ৪৭১৯)
আমাদেরকে দরুদ পড়ার হুকুম দেয়া হয়েছে, তাও আমাদের নিজেদের লাভের জন্য, গুনাহ মাফের জন্য, কিয়ামত দিবসে ঐ নবীর নৈকট্য হাসিলের জন্য। সকল উম্মতই যদি এই দোয়া পড়া বন্ধ করে দেয় তাহলে মাকামে মাহমুদ কি অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া হবে…! যিনি এখনো আমরা গুনাহগারদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করছেন, সেই নবীর উম্মত আশা করছে তাদের দোয়ার বরকতেই ঐ নবীকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছিয়ে দিবেন…! বাহ!!
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান রহঃ বলেন,
দেখনি হে হাশর মে ইজ্জত রাসূলুল্লাহ কি
কবর মে লেহরায়ে গে তা হাশর চশমে নুর কে
জল্ওয়া ফরমা হোগি জব তাল’আত রাসুলুল্লাহ কি।
সুরজ উল্টে পাও পাল্টে চাঁদ ইশারে ছে হো চাক
আন্ধে নজদী দেখলে কুদরত রাসূলুল্লাহ কি।
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম।