প্রশ্ন : কেউ কেউ বলেন যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ নাকি একই নামায; তারা বলেন যে রমযানে রাতের শুরুভাগে এক নামায (তারাবীহ) আর শেষভাগে আরেক নামায (তাহাজ্জুদ) এটা কোনো দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। রমযানে তারাবীহ পড়লে তাহাজ্জুদ পড়া লাগে না। কথাটা কি সঠিক?
উত্তর : এটিই “রাফিউল ইয়াদাইনী”-দের প্রথম চাল, আর সে চালে ধরাশায়ী হয়ে কতিপয় সাধারণ জনতা তাদের এই মিথ্যে প্রচারকে সঠিক বিশ্বাস করে প্রথমে এই ভুলটিই করে বসে।
যেহেতু আট রাকাআত তারাবীহ সম্বলিত হাদিস কোনোভাবেই দেখানো সম্ভব নয় তাই তাহাজ্জুদের হাদীস দিয়ে তারাবীহর রাকাআত-সংখ্যা প্রমাণ করার জন্যে তাদের এই অনর্থক কসরত। আল্লাহ সহীহ সমঝ নসীব করুন।
কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ
ﻭَﻣِﻦَ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞِ ﻓَﺘَﻬَﺠَّﺪْ ﺑِﻪِ ﻧَﺎﻓِﻠَﺔً ﻟَّﻚَ ﻋَﺴَﻰٰ ﺃَﻥ ﻳَﺒْﻌَﺜَﻚَ ﺭَﺑُّﻚَ ﻣَﻘَﺎﻣًﺎ ﻣَّﺤْﻤُﻮﺩًﺍ
অর্থাৎ : এবং রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ ক্বায়েম করুন। এটা খাস আপনার জন্য অতিরিক্ত। এ কথা নিকটে যে, আপনাকে আপনার রব এমন স্থানে দণ্ডায়মান করবেন যেখানে সবাই আপনার প্রশংসা করবে।
[সূত্রঃ ক্বুরআ’নুল কারিম; সুরা বনী ইসরাইল মক্কী (১৭): আয়াত শরীফ ৭৯।]
অন্যত্রঃ
ﻗُﻢِ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞَ ﺇِﻟَّﺎ ﻗَﻠِﻴﻠًﺎ
অর্থাৎ : রাত জাগরণ করুন, রাতের কিছু অংশ ব্যতীত।
[সূত্রঃ ক্বুরআ’নুল কারিম; সুরা মুজাম্মিল মক্কী (৭৩): আয়াত শরীফ ২।]
তাহাজ্জুদের বিধান আল্লাহর কিতাব বা কিতাবুল্লাহর বিধান।
ইসলামের প্রথম যুগেই কুরআন মজীদের সূরায়ে মুযযাম্মিল অবতীর্ণ হয়, সূরায়ে মুযযাম্মিল রমযানের রোযা ফরয হওয়ার অনেক আগেই অবতীর্ণ হয়।
ইতিহাস সাক্ষী, রমযানের রোযা ফরয হয়েছে মক্বা থেকে মদিনায় হিজরতের পর। আর তখন সাইয়্যিদুল মুর্সালীন, ইমামুল আম্বিয়া, সাইয়্যিদুস সাক্বালাইন, হাবীবে কিবরিয়া, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ
ﻛﺘﺐ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻜﻢ ﺻﻴﺎﻣﻪ ﻭﺳﻨﻨﺖ ﻟﻜﻢ ﻓﻴﻪ ﻗﻴﺎﻣﻪ
অর্থাৎ : ‘আল্লাহ তাআলা এই মাসের রোযা তোমাদের উপর ফরয করেছেন এবং এই মাসে রাত জেগে নামায পড়াকে আমি সুন্নত করেছি।
অপর একটি হাদিসে ইরশাদ হয়েছেঃ
: ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺗَﺒَﺎﺭَﻙَ ﻭَﺗَﻌَﺎﻟَﻰ ﻓَﺮَﺽَ ﺻِﻴَﺎﻡَ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻭَﺳَﻨَﻨْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﻗِﻴَﺎﻣَﻪُ
অর্থাৎ : “তোমাদের উপর নিশ্চয় রমাদ্বনের রোজা আল্লাহ্ ফরজ করেছেন, আর আমি কিয়ামে রমজান (তারাবীহ) কে তোমাদের জন্যে সুন্নাত করেছি।
[সূত্রঃ ইবনে মাজাহ; সুনানে নাসাঈ ১, ৩৩৯।]
লক্ষ করুন,
এ হাদীসে যে “কিয়ামে রমযান”-কে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নত করেছেন বলেছেন, তা দ্বারা উদ্দেশ্য যদি তাহাজ্জুদই হয় তাহলে বাণীটিই অনর্থক সাব্যস্ত হবে।
কারণ তাহাজ্জুদের বিধান তো পুরো বছরের জন্য রোযা ফরজ হওয়ার আগে থেকেই আছে।
রোযা ফরয হওয়ার আগে কত রমযান গত হয়েছে তখন কি রমযানে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) তাহাজ্জুদ পড়তেন না?
আরো লক্ষ্য করুন,
তাহাজ্জুদের বিধান আল্লাহ রাববুল আলামীন সরাসরি কুরআন মজীদে অবতীর্ণ করেছেন। তাহলে এ ব্যাপারে হাদীসের এ বাণীটি-(আমি কিয়ামে রমযান অর্থাৎ তারাবীহকে সুন্নত করেছি) কিভাবে প্রযোজ্য হতে পারে?
কাজেই এটি এমন নামাযের ব্যাপারেই প্রযোজ্য হবে যার বিধান কুরআন মজীদের মাধ্যমে নয়; বরং হাদীসের মাধ্যমেই এসেছে। আর তা হল তারাবীহর নামায, যা রোযা ফরজ হওয়ার পরে “কিয়ামে রমযান” হিসেবে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) পড়া শুরু করেন।
তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ যে ভিন্ন ভিন্ন নামায তা আরো অনেক দলিল দ্বারা প্রমাণিত।
বিস্তারিত জানার জন্য শায়খুল হাদিস, ফকীহুন নফস, মুহাদ্দিসে দাওয়ান, হযরত মাওলানা আহমদ ইয়ার খান নাঈমী রহ. এঁর “জা’আল হক ওয়া জাহাকাল বাতীলা” দেখা যেতে পারে।
তাছাড়া এই “রাফিউল ইয়াদাইনী”-দেরকে আরেকটি কথা বলার আছে।
তারা ইমাম বুখারী রাহ.-এঁর অনুসরণের খুব দাবি করে থাকে।
ইমাম বুখারী রাহ. কিন্তু তারাবীহ ও তাহাজ্জুদকে ভিন্ন ভিন্ন নামাযই মনে করতেন। রাতের প্রথম ভাগে তারাবীহ পড়তেন আর শেষভাগে তাহাজ্জুদ পড়তেন।
তারাবীহর প্রতি রাকাআতে বিশ আয়াত করে পড়তেন এবং এভাবে তারাবীহতে কুরআন খতম করতেন। নির্ভরযোগ্য সনদে তারীখে বাগদাদে বিষয়টি (খ. ২, পৃ. ১২) বর্ণিত হয়েছে এবং মুকাদ্দামায়ে ফাতহুল বারীতে তা উদ্ধৃত আছে।
এই ঘটনা থেকে যেমন একথা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম বুখারী রাহ. অন্যান্য উলামায়ে সালাফের মতো তারাবীহকে তাহাজ্জুদ থেকে ভিন্ন নামায মনে করতেন সাথে সাথে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ইমাম বুখারী রাহ. তারাবীহ আট রাকাআত নহে (তিনি) বেশি (বিশ রাকাআত) পড়তেন। কারণ তারাবীহ আট রাকাআত পড়লে রমযান মাস ত্রিশ দিনের হলেও প্রতি রাকাআতে বিশ আয়াত করে পড়ে কুরআন খতম করা সম্ভব নয়।
মনে রাখবেন, “রাফিউল ইয়াদাইনী”-দের এ দাবির পিছনে কোনো দলীল নেই।
তাদের দাবী ক্বুরআ’নুল কারিমের বিধান ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এঁর সুন্নাত ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এঁর আমল বিরোধী প্রমাণিত হল।
তাই সহীহ হাদীস এবং উলামায়ে সালাফের তরিকা মতে রমযানে তারাবীহর প্রতি গুরুত্ব দিন, পূর্ণ বিশ রাকাআত পড়ুন এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ুন।
তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ সম্পূর্ণ ভিন্ন নামাজ
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।




Users Today : 63
Users Yesterday : 357
This Month : 63
This Year : 171934
Total Users : 287797
Views Today : 7508
Total views : 3415071