*জান্নাতী দল তথা সুন্নী জামা’আত কারা?* [পোষ্ট-২৮]

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

লেখক: অধ্যক্ষ মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম নঈমী

সম্পাদনা: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

ইমামুল আম্বীয়া, সাইয়্যেদুল মুরসালীন, রহমতুল্লিল্ আলামীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈমান রক্ষা করার জন্যে এই সর্বোত্তম ব্যবস্থাপত্র বিবেচনা করেছেন (উপরোক্ত হাদীস শরীফে)। মুসলমান এই ব্যবস্থাপত্র (نسخہ) ব্যবহার করবেন, আপন নবী করীম (ﷺ)-এর আদেশের উপর আমল ও নিজেদের ঈমান-আকীদাহ হেফাজত করবেন। হুজূর আকদস (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর হাদীস পাকে জান্নাতী দলের নামকরণ করেছেন ‘আল-জামা’আত।’ বস্তুতঃ এ জামা’আতই সঠিক অর্থে হুজূর নবী করীম আলাইহিস্ সালামের অনুসরণকারী এবং তাঁরই তরীকার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই কারণেই এ জামা’আতের নাম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত।

এই শিরোনামাধীন এ পর্যন্ত যে কয়টি হাদীস উল্লেখিত হয়েছে তাতে পরিষ্কার সাব্যস্ত হয় যে, সিরাতুল মুস্তাকীম শুধু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতেরই মাযহাব। এতদ্ভিন্ন ইসলামের দাবিদার যে ৭২ ফির্কা রয়েছে, তারা সবাই জাহান্নামী। এই ৭২ ফির্কা বা দলগুলো ভ্রান্ত ও গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হওয়ার ব্যাপারে সালাফে সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাবৃন্দ) ও দ্বীনের ইমামকুলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। অবশ্য এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ (تفصیل) সম্বন্ধে মতভেদ আছে। তাফসীরে মাদারেক গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটা রেখা টানেন এবং বলেন, “এটাই সঠিক পথ, আল্লাহতায়ালার পথ। এটার অনুসরণ করো।” অতঃপর তিনি উক্ত সরল রেখাটির এপাশে ওপাশে ছয়টি করে বাঁকা রেখা টানেন এবং ইরশাদ করেন, “এগুলো শয়তানী পথ। প্রত্যেক পথে শয়তান অবস্থান করছে, আর (মানুষদেরকে) নিজের দিকে আহ্বান করছে। তোমরা তা থেকে সংযম এখতিয়ার করো।” অতঃপর তিনি পাঠ করেন নিম্নের আয়াতে করীমা:

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ.

অর্থ: এটাই আমার সঠিক পথ। সুতরাং তোমরা এই সঠিক পথের অনুসরণ করো। অন্যান্য পথের দিকে গমন কোরো না। তাহলে সে সব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর সঠিক পথ হতে বিপথগামী করে দেবে। [সূরাহ আল-আন‘আম; ১৫৩ আয়াত]

অতঃপর ‘তাফসীরে মাদারেক’ গ্রন্থপ্রণেতা বলেন, “এই ১২টি রাস্তার মধ্য হতে প্রতিটি রাস্তা থেকে ছয়টি করে রাস্তা বের হয়েছে। এভাবে ভ্রান্ত লোকদের ৭২ ফির্কা প্রকাশ পেয়েছে।”

মাওয়াকেফ শরীফ পুস্তকে এই সবিস্তার বিবরণ মওজূদ এভাবে –

ইসলামী ফির্কা ৮টি: (১) মু’তাযিলা; (২) শীয়া; (৩) খাওয়ারিজ; (৪) মুর্জিয়া; (৫) নাজ্জারীয়া; (৬) জাবারিয়া; (৭) মুশাব্বাহা; এবং (৮) নাজীয়া। এরপর পারস্পরিক মতভেদের কারণে শাখা-উপশাখার উৎপত্তি হতে লাগলো এ পর্যায়ে যে, এক-একটি ফির্কা হতে কয়েকটি করে ফির্কা উদ্গত হলো। যেমন – মু’তাযিলাদের ২০ ফির্কা, শীয়াদের ২২ ফির্কা, খারেজীদের ২০ ফির্কা, মুর্জিয়াদের ৫ ফির্কা, নাজ্জারীয়াদের ৩ ফির্কা এবং জাবারিয়া ও মুশাব্বাহাদের থেকে কোনো ফির্কা বের হয়নি। আর ফির্কায়ে নাজীয়া হলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। এভাবে সর্বসাকুল্যে ৭৩ ফির্কা হয়েছে। এর মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ছাড়া অবশিষ্ট সব দলই জাহান্নামী।” [মাওয়াকেফ শরীফ]

হযরতে শাইখে মুহাক্কেক্ক আবদুল হক্ক মুহাদ্দিসে দেহেলভী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘মাওয়াকেফ’ গ্রন্থের ভাষ্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কেননা হাদীসসমূহে সরল-সোজা রেখার ডান-বামে অনেক রেখা টানার কথা তো বলা হয়েছে, কিন্তু কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় নি (মানে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি)।

’তাফসীরে মাদারেক শরীফে’ উদ্ধৃত হাদীসে সরল রেখার দুই পাশে ছয়টি করে রেখার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা দ্বারা পথভ্রষ্টদের ১২টি ফির্কা হয়েছে মর্মে জানা যায়। এরপর ১২ ফির্কা হতে ৭২ ফির্কা কীভাবে বের হলো সে বিষয়ে হাদীস শরীফে বৃত্তান্ত নেই। ‘মাদারেক’ প্রণেতার ভাষ্য এই যে, ওই ১২ ফির্কার মধ্যে প্রতিটি থেকে ছয়টি করে ফের্কার উদ্ভব হয়েছে – এর সপক্ষে হাদীসের প্রমাণ যেমন নেই, তেমনি ইতিহাসেরও সাক্ষ্য নেই। তবে হ্যাঁ, গোমরাহ লোকদের ৭২ ফির্কা হওয়ার বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই হাদীসে ১২ সংখ্যার উদ্দেশ্য – সীমা নির্ধারণ করা নয়, বরং উপমা দেয়া এবং বোঝানোর খাতিরে। ‘মাওয়াকেফ’ গ্রন্থে প্রদত্ত বর্ণনার সমর্থন মোটামুটিভাবে হাদীসে পাওয়া যায়, আর সবিস্তার বর্ণনার কথা সমর্থিত হয় ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর আলোকে। এ কারণেই হযরত শাইখে মুহাক্কেক্কে দেহেলভী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘মাওয়াকেফ’-প্রণেতার বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

এই ৭২ ফেরকার সবাই ইসলামের দাবিদার; তারা সত্যতার দাবি করে থাকে; মুসলমানদের মতোই কার্যকলাপ সম্পাদন তথা আমল করে; আর নাজাত ও পারলৌকিক মুক্তির ঠিকাদার সাজে। অথচ এদেরকে হাদীসে – في النار – দোযখী আখ্যায়িত করা হয়েছে। নাজাত কেবল একটি ফির্কার জন্যেই খাস/সুনির্দিষ্ট। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্ট ইরশাদ করেছেন – إلا واحدة – অর্থাৎ নাজাত লাভকারী দল স্রেফ একটাই। তিনি এ নাজী ফির্কার মাপকাঠি বা মানদণ্ড সাব্যস্ত করেন – ما انا عليه واصحابي – অর্থাৎ “আমি ও আমার সাহাবা যে আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত” [তিরমিযী]। এটাই এ দলের স্বতন্ত্র-স্বকীয় মর্যাদা এবং এ দলই (ইসলামের) খাঁটি অনুসারী। এঁরাই সেসব মূলনীতি ও নিয়মকানুনের উপর কায়েম আছেন, যা সঠিক/বিশুদ্ধ ধর্ম ও সরল পথ, যার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন সরকারে দো-আলম (আলাইহিস্ সালাম) ও তাঁর সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment