*জান্নাতী দল তথা সুন্নী জামা’আত কারা?* [পোষ্ট-২৯]

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

লেখক: অধ্যক্ষ মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম নঈমী

সম্পাদনা: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

উক্ত ৭২ ফির্কাধারীবর্গ দ্বীন-ইসলামের উসূল/মূলনীতি ও কাওয়ায়েদ/নিয়মপদ্ধতি বর্জন করে নিজেদের জন্যে আলাদা আলাদা পথ বেছে নেয়। সিরাতুল মুস্তাকীম হতে সরে বিপথে-কুপথে চলে যায়। কিন্তু এই ভ্রান্ত ফির্কাগুলো যেমন ইসলামের বড় দাবিদার সাজে, তেমনি তারা জোর গলায় বলে – ما انا عليه واصحابي – “আমি ও আমার সাহাবা যে আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত” মর্মে হাদীসটি “আমাদের বেলায়ই প্রযোজ্য।” আর তারা ধোঁকাবাজির জাল পেতে সাধারণ মুসলমান সমাজকে বিভ্রান্ত করছে ও সিরাতুল মুস্তাকীম হতে সরিয়ে দিচ্ছে।

এ কারণেই – ما انا عليه واصحابي – “আমি ও আমার সাহাবা যে আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত” মর্মে হাদীসটির প্রয়োগ-ক্ষেত্র কারা, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন, যাতে হক্ব/সত্য ও বাতিল/মিথ্যের মধ্যে পার্থক্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়। এ তো সর্বজন স্বীকার্য যে, বিনা দলিল-প্রমাণে কোনো দাবি গ্রহণ করা হয় না। কেবল দাবি করলেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। বরং এর জন্যে প্রয়োজন প্রামাণ্য দলিল পেশ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত যে একমাত্র নাজী (নাজাতপ্রাপ্ত) ফির্কা, এর সপক্ষে দলিল এই যে, এ পবিত্র দ্বীন আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে – نقل – তথা রওয়ায়াত/বর্ণনা-পরম্পরা যোগে। সবাই এর উপর নির্ভরশীল। শুধু আকল্ বা যুক্তিজ্ঞান এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। মুতাওয়াতির হাদীসসমূহ দ্বারা জানা গিয়েছে এবং মুবারক হাদীসসমূহ অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, সালফে সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মা) সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে’ তাবেঈন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীর এ’তেকাদ/আকীদা-বিশ্বাস ও মাযহাব/পথ এই ছিলো যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মাযহাব। অথচ ৭২টি বাতিল ফির্কার প্রচলন হয়েছে সর্বোত্তম প্রাথমিক যুগের পরে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে’ তাবেঈন ও সালফে সালেহীন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের কেউই উক্ত বাতিল ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের সাথে একমত ছিলেন না, এবং যখন এসব মন্দ ফির্কা আত্মপ্রকাশ করেছিলো তৎক্ষণাৎ তাঁরা সেগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেন, আর সম্পূর্ণভাবে দূরে সরে বিরোধিতা আরম্ভ করেন। ছয়খানা বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ ও এতদ্ভিন্ন সমস্ত হাদীসগ্রন্থ, যেগুলোর উপর ইসলামী হুকুম-আহকাম নির্ভর করে, সেগুলোর প্রণেতাবৃন্দ সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-এর আকায়েদ ছিলো আহলে সু্ন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকায়েদ। দ্বীনের স্বনামধন্য ইমামে আযম আবূ হানীফা ও সর্ব-ইমাম মালিক, শাফেঈ ও আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) প্রমুখও উপরোক্ত উসূল ও আকায়েদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতেরই আকায়েদ।

ইলমে উসূলে কালাম (কালাম-শাস্ত্র)-এর আশয়ারীয়া ও মাতুরিদীয়া ইমাম (রহিমাহুল্লাহ)-বৃন্দ সবাই যুক্তি ও রওয়ায়াত-পরম্পরা হিসেবে – نقلاً و عقلاً – উক্ত উসূল ও আকায়েদকে সমর্থন করেছেন, আর করেছেন ওগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও। এই উসূল ও আকায়েদের উপর কায়েম ছিলেন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম), তাবেঈন ও তাবে’ তাবেঈন এবং সালফে সালেহীন (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-মণ্ডলী; আর উক্ত – اصول و عقايد – ‘উসূল ও আকায়েদের’ উপরই ইজমা’ তথা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সালফে সালেহীনের। এই কারণেই এ সত্য মাযহাবের নামকরণ হয়েছে ’আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত।’ যদিও এই নামকরণ পরবর্তীকালের, তবুও এঁদের মাযহাব প্রাথমিক যুগের। পূর্ববর্তী যুগের তাসাউফ-তরীকতের সূফী/মাশায়েখবৃন্দ, মুহাক্কেক্ব উলামা ও সকল যাহেদ (زاهد – তপস্যাকারী), আবেদ (ইবাদতকারী) ও আউলিয়া যাঁদের বেলায়াতের শক্তি ও ক্ষমতা সর্বজনস্বীকৃত এবং তাকওয়া-পরহেজগারী সুনিশ্চিত, তাঁরা সবাই উক্ত মাযহাবে আহলে সুন্নাতভুক্ত ছিলেন। এ বিষয়টি তাঁদের কিতাবাদিতে পরিস্ফুট। সার কথা হলো, নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও আউলিয়া এজাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) সবাই উক্ত সুন্নী মাযহাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এ জন্যে – ما انا عليه واصحابي – “আমি ও আমার সাহাবা যে আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত” মর্মে হাদীসের প্রয়োগ ক্ষেত্র হলেন স্রেফ, আর স্রেফ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। যদি কারো মনে এ ব্যাপারে বিন্দু পরিমাণও সন্দেহ হয়, তাহলে হাদীস, তাফসীর, ফেক্বাহ, কালাম, তাসাউফ, জীবনী ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী সামনে আনুন। আল্লাহ পাকের সাহায্যক্রমে সমস্ত কিতাব ও গ্রন্থ এ কথাই প্রমাণ করবে যে – ما انا عليه واصحابي – হাদীসটি কেবল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতদ্ভিন্ন সমস্ত মাযহাব ও ফির্কা ভ্রান্ত ও বাতিল। [মাসিক আশরাফীয়া, মুবারকপুর, ভারত, ১ম খণ্ড, ৩য় সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৭৬ সাল]

(চলমান)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment