॥ এক ॥মহান হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। কেউ যদি হজ ফরজ হওয়ার বিষয় মানতে অস্বীকার করে সে কাফের হয়ে যায়। আলাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ‘সামর্থ্যবান লোকদের প্রতি আল্লাহর উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ আদায় করা ফরজ। আর কেউ যদি তা মানতে অস্বীকার করে তাহলে (জেনে নিক) আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি মুখাপেক্ষী নন’। (আল ইমরান : ৯৭)হজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার নবী করীম (সা.) জিজ্ঞাসিত হলেন, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান’। তারপর প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোন আমলটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। তারপর প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘মাবরুর হজ’-(বুখারী ও মুসলিম)। আর মাবরুর হজ হচ্ছে ঐ হজ, যা আদায় করার সময় হাজী সকল প্রকার গুনাহ বা নির্লজ্জতার কাজ থেকে বিরত থাকে। এ ধরনের মাবরুর হজ আদায় করতে পারলে আল্লাহ তা’আলা জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন। নবী করীম (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ আদায় করলো এমন অবস্থায় যে, কোন প্রকার কাম, প্রবৃত্তি চর্চা বা গুনাহর কাজে লিপ্ত থাকেনি, সে এমনভাবে হজ শেষে ফেরত আসবে যেমন নবজাতক শিশু মায়ের পেট থেকে (গুনাহমুক্ত অবস্থায়) ভূমিষ্ঠ হয়। -(বুখারী ও মুসলিম)আরেকটি হাদীসে তিনি এরশাদ করেছেনÑ … মাবরুর হজের প্রতিদান হচ্ছে একমাত্র জান্নাত। (বুখারী ও মুসলিম) এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি আল্লাহ তা’আলা জীবনে মাত্র একবার ফরজ করেছেন। এরপর পুনরায় করলে তা নফল হবে। যদি আল্লাহ প্রতিবছরই ফরজ করতেন, তাহলে সেটা আদায় করা নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন হয়ে যেতো। হিজরী ৬ষ্ঠ সনে মতান্তরে নবম অথবা দশম সনে হজ ফরজ হওয়ার আয়াত নাজিল হলে নবী করীম (সা.) এক খুৎবায় তার ঘোষণা দিতে গিয়ে বললেন, “হে জনতা, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি হজ ফরজ করে দিয়েছেন, তাই হজ আদায় করে নাও। একজন বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল, তা-কি প্রতিবছরই? তিনি উত্তর দিলেন না। লোকটি তিন তিন বার প্রশ্নটি করতে থাকলো। শেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি যদি বলতাম হ্যাঁ, তাহলে প্রতিবছরই ফরজ হয়ে যেতো। আর তোমরা তা পালন করতে পারতে না। অতঃপর তিনি বললেন, যেটা আমি বলি না, সেটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করো না। তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে বেশি বেশি প্রশ্ন করা, আর নবীদের সাথে মতবিরোধের কারণে। আমি তোমাদের যা করার নির্দেশ দেই, সাধ্যমতো তা করার চেষ্টা করো, আর যে বিষয় থেকে নিষেধ করি তা বর্জন করো।”-(বুখারী ও মুসলিম)হজ ফরজ হয়ে গেলে বিলম্ব না করে সাথে সাথেই আদায় করা উচিৎ। বিলম্ব করে কয়েক বছর পরে আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু বিলম্ব করার কারণে গুনাহগার হতে হবে। আর যদি বিলম্ব করার কারণে শেষ পর্যন্ত হজ আদায় পূর্বেই মৃত্যুবরণ করতে হয়, তার পরিণতি হবে অত্যন্ত করুণ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তির মক্কা শরীফ যাতায়াতের মতো সম্বল রয়েছে (অর্থাৎ হজ ফরজ হয়ে গেছে) কিন্তু গড়িমসি করে আদায় করেনি, সে যেন ইহুদী বা খ্রিস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করে- (তিরমিযী)। অর্থাৎ সে যেন মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার আশা না করে। ওমর (রা.) বলতেন, যাদের উপর হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও হজ আদায় করছে না, আমার ইচ্ছে করে, তাদের উপর (অমুসলিমদের ন্যায়) জিযিরা কর আরোপ করতে। কারণ এরা মুসলিম হতে পারে না, এরা মুসলিম হতে পারে না (বাক্যটির দুইবার উচ্চারিত হয়েছে)।আল্লাহ তা’আলা সবার উপর হজ ফরজ করেননি। যাদের সামর্থ্য রয়েছে, শুধু তাদের উপরই ফরজ করেছেন। সামর্থ্য দু’ধরনের, শারীরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে। হজের আহকামগুলো আদায় করার মতো শারীরিক ক্ষমতা থাকতে হবে। আর অর্থনৈতিকভাবে নিজের হজের সফর ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচপত্র বহন এবং হজ শেষে ফিরে আসা পর্যন্ত তার উপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের যাবতীয় মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মতো অর্থনৈতিক সঙ্গতি থাকলেই হজ করা ফরজ হবে।মহিলাদের ক্ষেত্রে হজের সফরে স্বামী অথবা মাহরাম সঙ্গী থাকা জরুরি। বিনা মাহরামে মহিলাদের হজের সফরে বের হওয়া ঠিক নয়। ইবনে আব্বাছ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘মাহরামের অনুপস্থিতিতে বেগানা নারী-পুরুষ যেন একান্তভাবে একত্রিত না হয়। কোন মহিলা যেন বিনা মাহরামে সফর না করে। তা শুনে একজন বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্ত্রী হজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে, আর আমি অমুক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়ে রেখেছি। তিনি বললেন, ‘তুমি গিয়ে তোমার স্ত্রীর সাথে হজ আদায় করো।’ (বুখারী ও মুসলিম)।হজের সফরের প্রয়োজনীয় সম্বল যোগাড় করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা হজের সম্বল যোগাড় করো। আর সর্বোত্তম সম্বল হচ্ছে তাকওয়া’-(বাকারা : ১৯৭)। তাই হজ করতে ইচ্ছুক সবাইকে প্রয়োজনীয় বস্তুগত প্রস্তুতির সাথে সাথে রূহানী প্রস্তুতিও গ্রহণ করা উচিত। আর রূহানী প্রস্তুতি শুরু হয় হজ সংক্রান্ত ইলম হাসিল করার মাধ্যমে। হজ একটি বিরাট ইবাদত। যাতে রয়েছে বহুবিধ মাসায়েল ও আহকাম। হজে রওয়ানা হওয়ার অনেক আগ থেকেই সেসব জানা, বুঝা এবং বার বার পড়া উচিত। অভিজ্ঞ আলেম থেকে এলম হাসিল করা উচিত। শুধু বই কিতাব পড়াই যথেষ্ট হবে না। ব্যবহারিক তালিমেরও প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন মসজিদে অনুষ্ঠিত এসব তা’লীমে যোগদান করা উচিত। এখন থেকেই গুনাহ থেকে তাওবা করে হজের জন্য প্রস্তুতি নেয়া উচিত।পবিত্র ভূমি মক্কা ও বাইতুল্লাহর ইতিহাস হজ যাত্রীদের মনে আবেগ ও অনুভূতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে আলোচনা করতে চাই তা হচ্ছে হজের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। হজ আদায়কালীন সময়ে পবিত্র ভূমিতে লুকিয়ে থাকা সেসব ঐতিহাসিক স্মৃতি ও তার সাথে জড়িত পুণ্য ব্যক্তিদের অবদানের কথা হৃদয়ে জাগরুক থাকলে হাজীর মনে সৃষ্টি হবে আল্লাহ প্রেমের অনুপম আবেগ। উজ্জীবিত হয়ে উঠবে ঈমানের স্ফুলিঙ্গ। পবিত্র ভূমিতে পা রাখার সাথে সাথেই আবেগভরে খেয়াল করা উচিত, এ কোন ভূমিতে এসেছি আমি! আমি কি সে পবিত্র ঘরকে স্বচক্ষেই দর্শন করছি, যার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে প্রতিটি দিন কমপক্ষে পাঁচ বার নামাজ আদায় করেছি। স্মরণ করতে হবে সে ঘরের ইতিহাস। ধু-ধু বালির এ মরুভূমিতে বাড়ি-ঘর তো দূরের কথা, ছিল না কোন জন মানুষের চিহ্ন। নবী ইবরাহীম (আ.) প্রিয় সহধর্মিণী পুণ্যময়ী নারী হাযেরাকে নিয়ে এলেন মক্কার এ জনমানবহীন ভূমিতে। সাথে রয়েছে দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল। তাদেরকে রেখে বিদায় হতে চললেন। হাযেরা বললেন, এ কি! আমাদেরকে এভাবে রেখে যাচ্ছেন। এটা কি আল্লাহরই নির্দেশে? তিনি বললেন, ‘অবশ্যই’।হাযেরা বললেন, ‘তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে বিপদের মধ্যে ফেলে দেবেন না’-(আল বেদায়া, ওয়ান্নেহায়া, ইব্ন কাছীর)। যেতে যেতে ইবরাহীম (আ.) প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ করছেন, হে প্রভু! আমি আমার পরিবার-পরিজনকে এমন একটি প্রান্তরে রেখে এলাম, যেথায় নেই কোন ফসলাদির চিহ্ন, আপনার পবিত্র ঘরের কাছে, এজন্য যে, তারা যেন তথায় সালাত কায়েম করে। হে প্রভু! লোকদের অন্তরে তাদের কাছে আসার জন্য প্রবল আবেগ ঢেলে দিন। আর তাদেরকে ফল-ফসলাদির রিযক প্রদান করুন, যাতে করে তারা আপনার শোকরগুজার হতে পারে।-(ইবরাহীম : ৩৭)স্মরণ করুন, মা হাযেরার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। মরু হাওয়ায় দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈলের শুকিয়ে যাওয়া কণ্ঠ সিক্ত করতে কিভাবে সংগ্রহ করবেন একটু পানি। নিম্নভূমিতে কচি শিশুকে রেখে আরোহণ করলেন সাফা পাহাড়ের চূড়ায়। চতুর্দিকে দৃষ্টি ফেরালেন, কোথাও নেই পানির কোন চিহ্ন। ছুটলেন আবার সামনের পাহাড়টিতে। মারওয়ার চূড়ায় উঠে চতুর্দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। না, কোথাও নেই পানি। আবার সাফাতে গিয়ে আরেকটু ভালো করে দেখার চেষ্টা। আবার মারওয়াতে, একে একে সাতবার দু’পাহাড়ের মধ্যে ছুটাছুটি করেও পানির সন্ধান না পেয়ে বিফল মনোরথে ছুটে এলেন কলিজার টুকরা সন্তানটির পাশে। এসেই দেখলেন কচি শিশুর সামনেই প্রবাহিত হচ্ছে যমযমের ফোয়ারা। সে যমজম থেকেই আজকে আমরা পানি পান করছি। মহিয়ষী সে মহিলার পুণ্যময় স্মৃতি সাফা- মারওয়ার মহান রাব্বুল আলামীন।স্মরণ করুন, বহুদিন পর নবী ইবরাহীম (আ.) এসেছেন পরিবারকে দেখতে। উদীয়মান কিশোর ইসমাঈল কত সুন্দর হয়ে বড় হয়ে উঠছেন। পিতার মনে কত আশা।
চেতনার আয়নায় হজ
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।