ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী
……………………………….
গাউছে জমান, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৩৩৬ হিজরীর ১৯১৬ সালে বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হাজারা জিলার সিরিকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রখ্যাত অলি-ই কামিল কুতুবুল আউলিয়া আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। বংশ পরম্পরায় তিনি ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র ৩৭তম বংশধর।
হযরত তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র জন্মের ৬/৭ মাস পর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সিরিকোটে আগমন করেন। তখন তাঁকে শিরণী খাওয়ানোর সময় খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘طيب تم نهيں كهاتے تم هم بهى نهيں كهائنگے’ “তৈয়্যব তুমি না খেলে আমরাও খাব না” এ কথা শুনে তিনি শিরণী খেতে লাগলেন।
আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বয়স যখন প্রায় দু’বছর, তখন তাঁর আম্মাজান তাঁকে নিয়ে খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র খিদমতে উপস্থিত হন। সেখানে অবস্থানকালে খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সম্মুখে তিনি শিশুসূলভ অভ্যাসে মায়ের দুধপান করতে চাইলেন। তখন খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘تم بڑهاهوگيا دوده مت پيو ’ “ তুমি বড় হয়েছ, দুধপান কর না”। পরে তিনি আর মায়ের দুধ পান করেননি। শত চেষ্টা করেও তাঁকে আর দুধ পান করানো সম্ভব হয়নি।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন মূলত: আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র প্রতি তাঁর পীর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র আল্লাহ্ প্রদত্ত উপহার। কেননা তখন আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বয়স ছিল প্রায় ৬০ বছর। সাধারণত বৃদ্ধ বয়সের সন্তান দুর্বল হয় এবং বংশ পরম্পরা দীর্ঘ হয় না। তাই তা খণ্ডন পূর্বক আল্লামা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘পাক ছিজ’ উল্লেখ করে পুত্র ও নাতি উভয়ের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। কারণ ‘পাক’ শব্দের আরবী প্রতিশব্দ ‘তৈয়্যব’ ও ‘তাহির’ যেমনটি আল্লাহ্ ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর নিকট ইসহাক আলায়হিস্ সালামকে দান করার ক্ষেত্রে ইয়াকুব আলায়হিস্ সালাম-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি তাঁর পিতার তত্ত্বাবধানে ১১ বছর বয়সে কোরআন হিফজ করেন এবং তাফসীর, ফিক্বহ, নাহু, উসুল, সারুফ, মানতিক,আক্বাইদ, মা’রিফাত, হিকমাত, ত্বরিকতের শিক্ষা তার পিতা থেকে নেন। তিনি হরিপুরের দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়াতে পড়াশুনা করেন। তিনি তাফসীর ও হাদিসের বিশেষ শিক্ষা নেন মুহাদ্দিস-ই-আজম পাকিস্তান আল্লামা হযরত সরদার আহমেদ লাইলপুরী (রহ.) এবং আল্লামা হযরত হাফিজ আব্দুর রহমান (রহ.) ও আব্দুল হামিদ (রহ.) থেকে শিক্ষা নেন।
তিনি ছিলেন আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’আতের একনিষ্ঠ সেবক, হানাফী মাযহাবের অনুসারী, ক্বাদিরীয়া ত্বরীকার সফল প্রচারক, সুন্নত-ই রাসুলের জীবন্ত কায়া, যুগের মুজাদ্দিদ (সংস্কারক) এবং অসহায় মুসলিম জনতার দিশারী। ১৯৫৮ সালে তিনি পিতা হতে খিলাফতপ্রাপ্ত হন। এ যাবৎ যাঁরা আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হতে খিলাফত প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদের আমন্ত্রণে পিতার ইন্তেকালের পর ১৯৬১ সালে তিনি অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য এ বাংলাদেশে শুভাগমন করেন। অবশ্য ইতিপূর্বে ১৯৪২ সনে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম তাঁর আগমনের তথ্য পাওয়া যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে আগমন করেন এবং ১৯৮৬ অবধি এ দেশে এসে শরী‘আত-ত্বরীকতের দিক-নির্দেশনা প্রদান করে সুন্নীয়তের নেতৃত্ব দেন। অধিকন্তু তাঁর পিতা আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জীবদ্দশায় অসুস্থতা থাকার সময়ে কেবল তাঁকেই ইমামতির স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
আল্লামা তৈয়ব শাহ র. এর অবদান
আল্লামা তৈয়্যব শাহ রহ. সুন্নিয়তের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের শহর এবং দূরস্থিত অঞ্চলগুলোতে অবদান রাখেন। তিনি সুন্নিয়ত এবং ত্বরিকা-এ-আলিয়া কাদেরিয়ার বিস্তার করেন মধ্যপ্রাচ্যে, বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) রেঙ্গুনে। তিনি জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং আরো মসজিদ, মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। তিনি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এ অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন- বাংলাদেশে মোহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া, মাদ্রাসা-এ- তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া (হালিশহর), মাদ্রাসা-এ- তৈয়্যবিয়া হাফিজিয়া (কালুরঘাট), মাদ্রাসা-এ- তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া (চন্দঘোনা) ইত্যাদি, পাকিস্তানে মাদ্রাসা-এ- তৈয়্যবিয়া ও মায়ানমারে মাদ্রাসা-এ- আহলে সুন্নাত।
হুযুর কেবলা তৈয়্যব শাহ রহ. সুন্নিয়ত ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আরো মজলিশে গাউসিয়া সিরিকোটিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সুন্নি রাজনৈতিক সংগঠন ছাত্রসেনা’র এবং আরো অনেক ধর্মীয় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
হযরত তৈয়্যব শাহ রহ. বাংলাদেশে জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র পথিকৃৎ। তিনি খতমে গাউসিয়া’র বাস্তবায়ন করেন এবং প্রত্যেক সুন্নি মসজিদ ও খানকাতে প্রত্যেক মাসে খতমে গাউসিয়া পালন করার নির্দেশ দেন। তিনি আরো গেয়ারভী ও বারভী শরীফ বাস্তবায়ন করেন। তিনি বাস্তবায়ন করেছেন “ছবছে আওলা ও আ’লা” ও “মোস্তফা জানে রহমত” এবং তাঁর নির্দেশানুক্রমে প্রত্যেক সুন্নি মাদ্রাসায় প্রাত্যহিক সমাবেশে না’তে রাসুল (ﷺ) “ছবছে আওলা ও আ’লা” পরিবেশন করা হয়। তিনি মিলাদ এবং কিয়ামে সালাম “মোস্তফা জানে রহমত” বাস্তবায়ন করেছেন যা আজ ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত।
ইসলামী আদর্শের প্রচার-প্রসার ও সম্প্রসারণে পীরে কামেল গাউছে জামান হযরত আল্লামা তৈয়ব শাহ (রা) এর অনস্বীকার্য অবদান ইতিহাসে সমুজ্জল হয়ে আছে। কোরআন সুন্নাহর বিকৃতি তথা বিবিধ বিভ্রান্তির অপনোদন এবং ইসলামের মৌলিক তথ্যকে উপস্থাপনে তিনি যেমনিভাবে একজন সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে আধ্যাত্মিক সংস্কারক হিসেবে সনাতনী পীর-মুরিদী ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার, কূপমন্ডুকতা তথা বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি ও শরীয়াহ পরিপন্থী যাবতীয় অপকর্মের মূলোৎপাটনে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। পাশাপাশি একদিকে যেমন ইসলামের আদি সারল্যের পুনরুজ্জীবনের নামে তরিকত বিরোধী বিবিধ ষড়যন্ত্রেরও বিরুদ্ধে মুসলিম মিল্লাতকে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
অবশেষে প্রায় ৭৭ বছর বয়সে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন, ১৪১৩ হিজরির ১৫ যিলহজ্ব সোমবার সাড়ে নয়টার দিকে তাসবীহ পাঠ কালে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় চির বিশ্রাম গ্রহণ করেন তিনি। অতঃপর নিজ গ্রামে নামাযে জানাযার পর তাঁর পিতা আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযারের পার্শ্বে মসজিদের কার্নিসের নিচে তাঁকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।
আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অপরিমেয় প্রতিভাধর একজন সাধারণ বেশ-ভূষার অসাধারণ এ আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ সারা জীবন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বন্দনা করেছেন, ধর্মানূভুতি জাগরণের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে একাত্ম হবার পথ দেখিয়েছেন, মানবতা বা মনুষ্যত্ব বোধের পূর্ণ বিকাশের একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ মহানবীর জয়গান করেছেন। মূলত তিনি মুসলমানদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা সে-ই ইশক্বকে উদ্দীপ্ত করেন এবং রাসুল প্রেমের দহনে ঈমানী শক্তিতে মহীয়ান-গরীয়ান করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ মহান অলীর ফয়েজ ও বারাকাত দান করুন।
……………………….
ড. এ. এস. ইউসুফ জিলানী, ঢাকা।
তারিখ: ০৪/০৭/২০২৩ইং
……………………….