সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশম হিজরি জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখে আরাফাতের বিশাল ময়দানে উপস্থিত প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার সাহাবীর সম্মুখে ইহজীবনের অন্তিম ভাষণ দান করেন, যা ‘বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ’ নামে পরিচিত।
তিনি ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন ‘মিনা’য় অবস্থানকালে সকালে সূর্য উপরে উঠলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সাদা-কালো মিশ্রিত বাহনে আরোহন করে (কংকর নিক্ষেপের পর) জামরায়ে আক্বাবায় অপর একটি ভাষণ দেন। বিদায় হজে¦র সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা শরীফ হতে মদীনা শরীফের দিকে যাত্রা করেন এবং ১৮ই যিলহজ¦ ‘গাদীরে খুম’ বা জলাশয়ের নিকটে পৌঁছে সেখানে যাত্রা বিরতি করেন। তিনি এখানে ভাষণ প্রদান করেন। এটাকে গদির এ খুমের ভাষণ বলা হয়।
‘গাদীরে খুম’ কী?
‘গাদীরে খুম’ যা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘জোহফা’ নামক স্থানের নিকটবর্তীতে অবস্থিত। ‘গাদীর’ অর্থ পুকুর বা জলাশয়, আর ‘খুম’ একটি জায়গার নাম। এখানে পৌঁছার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি খোৎবা প্রদান করেন। এটিকে বলা হয় ‘গাদীরে খুম’ এর খুৎবা। যাতে তিনি নবী পরিবারের উচ্চ মর্যাদা ব্যাখ্যা প্রদান পূর্বক হযরত আলীর হাত ধরে এরশাদ করেন, ‘আমি যার বন্ধু, আলীও তার বন্ধু’।( )
গাদীরে খুমের প্রেক্ষাপট
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনশ যোদ্ধার এক বাহিনী আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নেতৃত্বে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র পরিচালনাধীন সৈন্যবাহিনী ইয়েমেনে অত্যন্ত সফল হয়েছিলো এবং সেখানে সে দলটি বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গনীমতের মালামাল) লাভ করে। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু গণিমতের অংশ থেকে খুমুস (পাঁচভাগের এক অংশ) আলাদা করে রাখেন যার ভিতরে বিপুল পরিমাণ শণজাত (লিলেনের) কাপড়ও ছিলো। যা গোটা সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম ছিলো। সাহাবীদের ভেতর থেকে অনেকে সেই কাপড় থেকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তাদের কিছুটা ধার দেয়ার জন্য আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে অনুরোধ করেন। এর কারণ হলো দলটি সেখানে তিনমাস অবস্থান করছিলো এবং তাদের ব্যবহার্য কাপড়ও যথেষ্ট ছিলো না। কিন্তু আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তা দিতে অস্বীকার করেন এবং তা সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে তুলে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
ইবনু হিশামের বর্ণনায় আছে,
لَمّا أَقْبَلَ عَلِيّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ مِنْ الْيَمَنِ لِيَلْقَى رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَكّةَ، تَعَجّلَ إلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَاسْتَخْلَفَ عَلَى جُنْدِهِ الّذِينَ مَعَهُ رَجُلًا مِنْ أَصْحَابِهِ، فَعَمِدَ ذَلِكَ الرّجُلُ فَكَسَا كُلّ رَجُلٍ مِنْ الْقَوْمِ حُلّةً مِنْ الْبَزّ الّذِي كَانَ مَعَ عَلِيّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ.فَلَمّا دَنَا جَيْشُهُ خَرَجَ لِيَلْقَاهُمْ، فَإِذَا عَلَيْهِمْ الْحُلَلُ؛ قَالَ: وَيْلَك! مَا هَذَا؟ قَالَ:كَسَوْت الْقَوْمَ لِيَتَجَمّلُوا بِهِ إذَا قَدِمُوا فِي النّاسِ، قَالَ: وَيْلك! انْزِعْ قَبْلَ أَنْ تَنْتَهِيَ بِهِ إلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. قَالَ: فَانْتَزَعَ الْحُلَلَ مِنْ النّاسِ، فَرَدّهَا فِي الْبَزّ، قَالَ: وَأَظْهَرَ الْجَيْشَ شَكْوَاهُ لِمَا صُنِعَ بِهِمْ.
ইয়েমেন বিজয়ের পর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর বাহিনীর সহ-অধিনায়ককে সেখানকার দায়িত্ব হস্তান্তর করে মক্কার উদ্দেশ্যে চলে যান। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু চলে যাবার পর সেই সহ-অধিনায়ক সবদিক বিবেচনা করে সৈন্যদলকে লিলেনের কাপড় ধার দেবার সিদ্ধান্ত নেন। অল্পদিন পরে পুরো দলটিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে যোগ দেয়ার জন্য রওয়ানা করে। দলটির আগমনের খবর পেয়ে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মক্কা থেকে বেরিয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে আসেন। কাছে এসে তিনি দেখতে পান তাদের গায়ে সেই লিলেনের পোষাক। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন এবং তাদের নির্দেশ দেন তৎক্ষণাৎ সে পোষাক খুলে পুরাতন পোষাক পরার জন্য। আলীর নির্দেশ মান্য করলেও দলটির নেতাসহ সকলেই খুব ক্ষুব্ধ হয় এবং গোটা বাহিনীর মাঝে বড় ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হয়।( )
খবরটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়েও পৌঁছায়। শুনে তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيّ، قَالَ: اشْتَكَى النّاسُ عَلِيّا رِضْوَانُ اللهِ عَلَيْهِ، فَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِينَا خَطِيبًا، فَسَمِعْته يَقُولُ: أَيّهَا النّاسُ، لاتشكوا عليّا، فو الله إنّهُ لَأَخْشَنُ فِي ذَاتِ اللهِ، أَوْ فِي سَبِيلِ اللهِ، مِنْ أَنْ يُشْكَى.
“হে মানব সকল, আলীকে দোষারোপ কোরো না; কেননা সে আল্লাহর পথে (ন্যায়ের পক্ষে) এতোই বিবেকবান যে তাকে দোষারোপ করা চলে না।’ ( )
বুরায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত, তিনি বলেন,
بَعَثَ النَّبيُّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ عَلِيًّا إلى خَالِدٍ لِيَقْبِضَ الخُمُسَ، وكُنْتُ أُبْغِضُ عَلِيًّا، وقَدِ اغْتَسَلَ، فَقُلتُ لِخَالِدٍ: ألَا تَرَى إلى هذا! فَلَمَّا قَدِمْنَا علَى النَّبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ ذَكَرْتُ ذلكَ له، فَقالَ: يا بُرَيْدَةُ، أتُبْغِضُ عَلِيًّا؟ فَقُلتُ: نَعَمْ، قالَ: لا تُبْغِضْهُ؛ فإنَّ له في الخُمُسِ أكْثَرَ مِن ذلكَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে খুমুস (গনীমতের এক পঞ্চমাংশ) নিয়ে আসার জন্য খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে পাঠালেন। (রাবী, বুরায়দা বলেন, কোন কারণে) আমি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি নারাজ ছিলাম, আর তিনি গোসলও করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে আসলে আমি তাঁর কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলাম। তখন তিনি বললেন, হে বুরায়দা! তুমি কি আলীর প্রতি অসন্তুষ্ট? আমি উত্তর করলাম, জ্বী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তার উপর অসন্তুষ্ট থেকো না। কারন খুমুসের ভিতরে তার প্রাপ্য অধিকার এ অপেক্ষাও বেশি রয়েছে।( )
কিন্তু হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথা কিছু মানুষ হয়তো মেনে নেন। কিন্তু সাহাবী বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অনেকের ক্ষোভ এতে মিটে যায়নি। দোষারোপ চলতেই থাকলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জ শেষে মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ ফেরার পথে এ দলটি গাদির খুম নামের এক কুপের কাছে যাত্রাবিরতি করলো। সেখানে হযরত আলীর নামে আবার অভিযোগ তোলা হলো। এবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ক্ষুব্ধ হলেন ও লোকদের ডেকে আলী সম্পর্কে বললেন।
أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ قَالُوا بَلَى قَالَ أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِكُلِّ مُؤْمِنٍ مِنْ نَفْسِهِ قَالُوا بَلَى قَالَ فَأَخَذَ بِيَدِ عَلِيٍّ فَقَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ
‘আমি কি তোমাদের জীবনের চেয়ে আওলা’ (শ্রেয়তর, অধিকতর মূল্যবান) নই?’ আসহাবে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম যখন উত্তরে বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ, জি, (আপনি শ্রেয়তর)’, তখন তিনি বলেন, ‘তাহলে আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা।’ যাত্রার পরবর্তী পর্যায়ে গাদীরে খুমে বিশ্রামের জন্যে থামলে তিনি সবাইকে সমবেত করেন এবং হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র হাত ধরে ওই একই কথা (আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা) পুনর্ব্যক্ত করেন। অতঃপর এ দুআ যোগ করেন:
اللّٰهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ
‘হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পাষেণ করে।’ এরই ফলশ্রুতিতে হযরত আলী’র বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ প্রশমিত ও স্তব্ধ হয়ে যায়।”( )
অন্য আরেকটি কারণ: ইবনে ক্বাসীর তাঁর ‘আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায় কিতাবে লিখেন,
وَالْمَقْصُودُ أَنَّ عَلِيًّا لَمَّا كَثُرَ فِيهِ الْقِيلُ وَالْقَالُ مِنْ ذَلِكَ الْجَيْشِ ; بِسَبَبِ مَنْعِهِ إِيَّاهُمُ اسْتِعْمَالَ إِبِلِ الصَّدَقَةِ ، وَاسْتِرْجَاعِهِ مِنْهُمُ الْحُلَلَ الَّتِي أَطْلَقَهَا لَهُمْ نَائِبُهُ ، وَعَلِيٌّ مَعْذُورٌ فِيمَا فَعَلَ ، لَكِنِ اشْتُهِرَ الْكَلَامُ فِيهِ فِي الْحَجِيجِ ، فَلِذَلِكَ وَاللهُ أَعْلَمُ لَمَّا رَجَعَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ حَجَّتِهِ وَتَفَرَّغَ مِنْ مَنَاسِكِهِ وَرَجَعَ إِلَى الْمَدِينَةِ فَمَرَّ بِغَدِيرِ خُمٍّ ، قَامَ فِي النَّاسِ خَطِيبًا فَبَرَّأَ سَاحَةَ عَلِيٍّ ، وَرَفَعَ مِنْ قَدْرِهِ وَنَبَّهَ عَلَى فَضْلِهِ ; لِيُزِيلَ مَا وَقَرَ فِي نُفُوسِ كَثِيرٍ مِنَ النَّاسِ ، وَسَيَأْتِي هَذَا مُفَصَّلًا فِي مَوْضِعِهِ ، إِنْ شَاءَ اللَّهُ ، وَبِهِ الثِّقَةُ .
হযরত আলী’র অধীনস্থ সৈন্যরা বস্ত্রের পরিবর্তন নিয়েই কেবল ক্ষুব্ধ ছিলেন না, বরং তাঁরা সামগ্রিকভাবে গনীমতের মালামাল বণ্টন নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের বদৌলতে মুসলমানবৃন্দ অনেক উট লাভ করেন (গনীমত হিসেবে), কিন্তু তিনি সবাইকে সেগুলোর মালিকানা ও দখল নিতে বারণ করেন। আল-বায়হাক্বী বর্ণনা করেন হযরত আবূ সাঈদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে এ মর্মে যে, হযরত আলী তাঁদেরকে ওই উটগুলোতে চড়তেও নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি যখন মক্কার উদ্দেশ্যে ইয়েমেন ত্যাগ করেন, তখন তাঁর সহ-অধিনায়ক মানুষের দাবির মুখে আত্মসমর্পণ করেন এবং সৈন্যদেরকে উটগুলোতে চড়ার অনুমতি দেন। হযরত আলী এটা দেখার পর রাগান্বিত হন এবং সহ-অধিনায়ককে দোষারোপ করেন। ( )
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيّ، قَالَ: اشْتَكَى النّاسُ عَلِيّا رِضْوَانُ اللهِ عَلَيْهِ، فَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِينَا خَطِيبًا، فَسَمِعْته يَقُولُ: أَيّهَا النّاسُ، لاتشكوا عليّا، فو الله إنّهُ لَأَخْشَنُ فِي ذَاتِ اللهِ، أَوْ فِي سَبِيلِ اللهِ، مِنْ أَنْ يُشْكَى.
হযরত আবূ সাঈদ (রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু) বলেন: “আমরা মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে হযরত আলী হতে আমাদের প্রত্যক্ষকৃত কঠোরতা সম্পর্কে উল্লেখ করি। তিনি (উত্তরে) বলেন: ‘থামো…আল্লাহর কসম, আমি জেনেছি সে আল্লাহরই ওয়াস্তে (বা খাতিরে) ভালো কাজ করেছে’।”
حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا رَوْحُ بْنُ عُبَادَةَ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ سُوَيْدِ بْنِ مَنْجُوفٍ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ بَعَثَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلِيًّا إِلَى خَالِدٍ لِيَقْبِضَ الْخُمُسَ وَكُنْتُ أُبْغِضُ عَلِيًّا، وَقَدِ اغْتَسَلَ، فَقُلْتُ لِخَالِدٍ أَلاَ تَرَى إِلَى هَذَا فَلَمَّا قَدِمْنَا عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ ” يَا بُرَيْدَةُ أَتُبْغِضُ عَلِيًّا ”. فَقُلْتُ نَعَمْ. قَالَ ” لاَ تُبْغِضْهُ فَإِنَّ لَهُ فِي الْخُمُسِ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ ”.
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে (গনীমতের) খুমুস্ (তথা রাষ্ট্রীয় অংশ) আনতে হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র কাছে প্রেরণ করেন, আর আমি তাঁর প্রতি বৈরিতা রাখতাম। (ওই সময়) তিনি গোসল করেছিলেন। আমি হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদকে বলি: ‘আপনি কি এটা দেখতে পাচ্ছেন না?’ আমরা যখন হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হাজির হই, তখন বিষয়টি তাঁর কাছে পেশ করি। তিনি উত্তরে বলেন, “হে বোরায়দা, তুমি কি আলীর প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করো?” আমি উত্তরে বলি: ‘জি।’ তিনি বলেন: “বৈরিতা রেখো না, কেননা সে খুমুস্ হতে অধিকতর পাওয়ার হক্কদার।”( )
عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ غَزَوْتُ مَعَ عَلِيٍّ الْيَمَنَ فَرَأَيْتُ مِنْهُ جَفْوَةً فَلَمَّا قَدِمْتُ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرْتُ عَلِيًّا فَتَنَقَّصْتُهُ فَرَأَيْتُ وَجْهَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَغَيَّرُ فَقَالَ يَا بُرَيْدَةُ أَلَسْتُ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ قُلْتُ بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ.
হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, আমি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে ইয়েমেন অভিযানে যাই এবং তাঁর তরফ থেকে শীতলতা প্রত্যক্ষ করি; তাই আমি (ফেরার পরে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’এর কাছে এসে হযরত ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কথা উল্লেখ করে তাঁর সমালোচনা করি; এমতাবস্থায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র চেহারা মোবারক বদলে যেতে দেখি। আর তিনি বলেন: “ওহে বোরায়দা, আমি কি ঈমানদারদের তাদের নিজেদের চেয়েও কাছে নই?” আমি (উত্তরে) বলি: জি, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অতঃপর তিনি বলেন: “আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।” ( )
قَالَ حَدَّثَنِي بُرَيْدَةُ قَالَ بَعَثَنِي اَلْنَّبِيُّ صَلَّىَ اَللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَعَ عَلِيٍّ إِلَى الْيَمَنَ فَرَأيْتُ مِنْهُ جَفْوَةً فَلَمَّا رَجَعْتُ شَكَوْتُهُ إِلَىْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلْيْهِ وَسَلَّمَ فَرَفَعَ رَأسَهُ إِلَيَّ قَالَ يَا بُرَيْدَةُ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ
হযরত বোরায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে ইয়েমেন অভিযানে প্রেরণ করেন এবং আমি তাঁর (হযরত আলীর) তরফ থেকে শীতলতা লক্ষ্য করি; আমি যখন প্রত্যাবর্তন করি, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন শির মোবারক (তাঁর দিকে) উঠিয়ে বলেন: “আমি যার মওলা, এই আলী-ও তারই মওলা।” ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী?
উক্ত ভাষণের মাধ্যমে আহলে বাইতের প্রতি সকলের মোহাব্বতের সম্পর্ক রাখার তাকীদ ও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর দ্বারা হযরত বুরাইদা আসলামী’র মন থেকে হযরত আলী’র প্রতি যে ধারণা ছিল তা দূরিভূত হয়ে যায়। উক্ত খুতবার কোথাও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর হযরত আলীকে খলীফা নিযুক্ত করতে হবে এমন কোন কথা নেই। শুধু মোহাব্বতের তাকীদ করা হয়েছে। আর একমাত্র মোহাব্বতই কখনোই নেতৃত্বের হকদার হবার মানদণ্ড নয়।
শিয়াদের দাবি
শিয়াদের দাবি, গাদিরে খুমের ভাষণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তার মাঝে প্রথমটি ছিল ‘কুরআন ও আহলে বাইতের’ অনুসরণের আদেশ। দ্বিতীয়টি ছিল আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ‘অভিষেক’, অর্থাৎ হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মুসলিম জাতির মওলা (অবিভাবক) ঘোষণা করা। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফতের পর মুসলিম উম্মার খেলাফতের এক মাত্র উত্তারাধীকারি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাদের বিশ্বাস আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র আগের তিনজন মুসলিম খলীফাগণ অবৈধ এবং অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ)
‘মাওলা’ শব্দের অর্থ
শীয়াপন্থীরা দাবি করে যে ‘মওলা’ শব্দটি এখানে ‘মনিব’ (বা মালিক) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটির এই ভ্রান্ত অর্থ করে তারা দাবি করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী’কে তাঁরই উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন।
বস্তুতঃ ‘মওলা’ শব্দটি অন্যান্য বহু আরবী শব্দের মতোই একাধিক অর্থ বহন করে। আরবী ভাষায় অনেক শব্দেরই একাধিক অর্থ থাকে ঠিক তেমনি মাওলা শব্দটিরও একাধিক অর্থ আছে। আর এই বহু অর্থেরই সুযোগ গ্রহণ করেছে শিয়ারা অন্যায়ভাবে। যেমন ‘মাওলা’ এর অর্থ হতে পারে কর্তা, মালিক, মনিব, দাতা, বন্ধু, অভিভাবক, ভালোবাসার মানুষ, আযাদকৃত দাস, দাস, সহায়তাকারী, হাবীব, অনুসারী, প্রতিবেশি, চাচাত ভাই-বোন, মিত্র, শ্বশুরপক্ষীয় ইত্যাদি। মাওলা দিয়ে যেমন বন্ধু বুঝায় একই শব্দ দিয়ে এমনকি আল্লাহকেও বুঝায়। এখানে মাওলা শব্দের অর্থ ‘ভালোবাসার মানুষ’ হিসাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবহার করেছেন, যা শিয়ারা না মেনে ‘ইমাম’, ‘খলিফা’ কিংবা ‘ক্ষমতার উত্তরাধিকারী’ হিসাবে এর অর্থ করে।
মাওলা শব্দটি মহান আল্লাহ কুরআনে কয়েক স্থানে উল্লেখ করেছেন। যেমন সুরা বাকারার ২৮৫ নম্বর আয়াতে তিনি (আল্লাহ) নিজে মাওলা বা প্রভু হিসাবে ঊল্লেখ করেছেন।
হাদীসে ব্যবহৃত ‘মওলা’ শব্দটির অর্থ ‘মনিব’ হতে পারে না, বরঞ্চ বড় জোর ‘প্রিয়ভাজন বন্ধু’ হতে পারে। কোনোক্রমেই ইমামত ও খেলাফতের দিকে ইঙ্গিতই করে না। কেননা এখানে ’মুওয়ালাত’ (ভালোবাসা) এর বিপরীতে ‘মু’আদত’ তথা শত্রুতা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
ইমাম শাফেঈ রহমতুল্লাহে আলাইহি গাদীরে খুমের এই নির্দিষ্ট হাদীস প্রসঙ্গে বলেন, “এর দ্বারা ইসলামের (বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার) বন্ধনকে বোঝায়।” আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:
فَالْيَوْمَ لاَ يُؤْخَذُ مِنكُمْ فِدْيَةٌ وَلاَ مِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مَأْوَاكُمُ ٱلنَّارُ هِيَ مَوْلاَكُمْ وَبِئْسَ ٱلْمَصِيرُ
সুতরাং আজ না তোমাদের কাছ থেকে কোনো মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে এবং না প্রকাশ্য কাফিরদের কাছ থেকে। তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে (জাহান্নামের) আগুন। তা তোমাদের সাথী (মওলা) এবং কতোই মন্দ পরিণতি!
[আল-ক্বুরআন, ৫৭:১৫] আল্লাহতা’লা আরো এরশাদ ফরমান: ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ مَوْلَى ٱلَّذِينَ آمَنُواْ وَأَنَّ ٱلْكَافِرِينَ لاَ مَوْلَىٰ لَهُمْ
এটা এ জন্যে যে, মুসলমানদের অভিভাবক (মওলা) আল্লাহ এবং কাফিরদের কোনো অভিভাবক (মওলা) নেই।
[আল-ক্বুরআন, ৪৭:১১] আল্লাহতা’লা আরো এরশাদ ফরমান:
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللهُ وَرَسُولُهُ وَٱلَّذِينَ آمَنُواْ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ وَمَن يَتَوَلَّ اللهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ فَإِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ ٱلْغَالِبُونَ
নিশ্চয় তোমাদের বন্ধু তো (হলেন) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ও ঈমানদারগণ – যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহরই সামনে বিনত হয়। আর যেসব লোক আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদেরকে স্বীয় বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহরই দল বিজয়ী হয়। [আল-ক্বুরআন, ৫:৫৫-৫৬] আল্লাহতা’লা ক্বুরআন মজীদের অন্যত্র ঘোষণা করেন: يَوْمَ لاَ يُغْنِي مَوْلًى عَن مَّوْلًى شَيْئاً وَلاَ هُمْ يُنصَرُونَ
যেদিন (শেষ বিচার দিবস) কোনো বন্ধু (মওলা) কোনো বন্ধুর (মওলার) কোনো কাজে আসবে না এবং না তাদের সাহায্য করা হবে। [আল-ক্বুরআন, ৪৪:৪১] হাদীস শরীফেও ‘মওলা’ শব্দটিকে প্রিয়ভাজন বন্ধু হিসেবে বোঝানো হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم” قُرَيْشٌ وَالأَنْصَارُ وَجُهَيْنَةُ وَمُزَيْنَةُ وَأَسْلَمُ وَغِفَارُ وَأَشْجَعُ مَوَالِيَّ، لَيْسَ لَهُمْ مَوْلًى دُونَ اللهِ وَرَسُولِهِ ”.
“ক্বুরাইশ, আনসার, জুহাইনা, মুযাইনা, আসলাম, গিফার ও আশজাআ’ গোত্রগুলো হচ্ছে আমার প্রিয় ‘মাওয়ালী’ (প্রিয়ভাজন সহায়তাকারী); আর তাদের নেই কোনো মাওলা (রক্ষাকারী) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতিরেকে।”( )
শিয়াদের জন্য বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়াবলী
১. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি হযরত আলী’কে খলীফা মনোনীত করতে চাইতেন, তাহলে তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিতেন, “আমি আলীকে আমার ওফাত শরীফের পরে আমারই খলীফা মনোনীত করছি;” অথবা “আলী আমার উত্তরাধিকারী (হিসেবে) আমার বেসাল শরীফের পরে প্রথম মুসলিম খলীফা।” নিশ্চয় এবিষয়টাকে স্পষ্টভাবে খোলাসা করতেন।
২. গাদীরে খুমে প্রদত্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণকে হযরত আলী’র প্রথম খলীফাস্বরূপ মনোনীত হবার পক্ষে দলিল হিসেবে কোনো সাহাবীর কি কোন ব্যাখ্যা আছে?
৩. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বাস্তবেই স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, “আলী তাঁর উত্তরাধিকারী ও পরবর্তী খলীফা” কিন্তু সাহাবা কেরাম খেলাফত অস্বীকার করার অভিপ্রায়ে এসব হাদীসগুলো গোপন করেছেন?
৪. গাদীরে খুমের ঘটনাকে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রথম খলীফা হবার দলীল হিসেবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগে কেউ কি কখনো পেশ করেছেন?
৫. এমন কি আহলে বাইতের কোন সদস্য কি গাদীরে খুমের ভাষণকে খলীফা হবার দলীল হিসেবে কখনোও পেশ করেছিলেন?
৬.এমন কি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর যখন সাকীফায়ে বনী সা’আদে খিলাফত বিষয়ে মাশোয়ারা হচ্ছিল। তখন গাদীরে খুমে উপস্থিত সাহাবীগণও ছিলেন। ছিলেন আহলে বাইতের সদস্যগণও। কিন্তু কেউ কি গাদীরে খুমের ভাষণকে খিলাফতের দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন?
আমরা জানি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় বিদায়ী হজ্জ্বের সময় তাঁর শেষ খুতবাটি দিয়েছিলেন। এটা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানবৃন্দের সামনে, যাঁরা বিভিন্ন শহর হতে হজ্জ্ব করতে এসেছিলেন। যদি হযরত আলী’কে প্রথম খলীফা মনোনীত করতে চাইতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে মক্কা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলমানের উপস্থিতিতেই তিনি তা করতেন। তা ঘোষণা না করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ বা ব্যাখ্যাই নেই। গোটা উম্মাহ তাঁর শেষ ভাষণ শোনার জন্যে সেখানে ছিলেন উপস্থিত; তাই উত্তরাধিকারী নিয়োগ করার সেটাই ছিলো সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ও সুযোগ।
গাদির খুমের ঘটনাটি যখন ঘটেছে তখন সেখানে ছিলেন শুধুমাত্র মদীনাবাসী সাহাবীগণ। হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমান সাধারণ তাঁদের হজ্জ্ব সুসম্পন্ন করার পর নিজ নিজ শহরের দিকে ফিরে যান। মদীনাবাসীগণ মদীনায় ফেরেন; তায়েফবাসী ফিরে যান তায়েফ নগরীতে; ইয়েমেনবাসী প্রত্যাবর্তন করেন ইয়েমেন দেশে; কুফাবাসী ফেরত যান কুফায়; সিরিয়াবাসী ফেরেন সিরিয়ায়; আর মক্কাবাসী থেকে যান মক্কায়। এর সামান্য কিছুদিন আগে বিদায় হজ্জে তিনি মক্কা, মদীনা নির্বিশেষে সকল সাহাবীক কাছে পেয়েছেন। সে হিসাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার জন্য বিদায় হজ্জের ভাষণ ছিলো সেরা সময়, কিন্তু তিনি তখন এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। এই সময়ের আগে কিংবা পরে অসংখ্যবার মুহাজির ও আনসার শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিভিন্ন সময় বসেছেন এবং পরামর্শ করেছেন। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খলিফা হবার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে বলেননি।
কুরআন মজীদের অপব্যাখ্যা
শীয়াদের দাবি হলো, নিম্নোক্ত আয়াতটি হযরত আলী’র খেলাফত সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ হিসেবে গদীরে খুমে অবতীর্ণ হয়েছিলো।
يَـٰأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِ
হে রাসূল! পৌঁছিয়ে দিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনার প্রতি আপনারই রব্বের কাছ থেকে; এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর কোনো সংবাদ-ই পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে। [আল-ক্বুরআন ৫:৬৭] আসলে এটা শীয়াদের ভ্রান্ত আক্বীদারই অংশ বিশেষ। কেননা জমহুর মুফস্সিরগণের ইজমা হলো, এ আয়াতটি আহলে কিতাব (ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়)’কে উদ্দেশ করে অবতীর্ণ হয়েছিলো।
শীয়াদের দাবী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ শেষ করার অব্যবহিত পরেই আল-ক্বুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়: ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلإِسْلٰمَ دِيناً
আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে মনোনীত করলাম। [আল-ক্বুরআন, ৫:৩] আসলে এটাও শীয়াদের আরেকটা বানোয়াট কাহিনী। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আল-সুনান ও অন্যান্য হাদীসের কিতাবে বিবৃত হয়েছে যে, এ আয়াতটি শুক্রবার, আরাফাত দিবসে নাযিল হয়েছে। আরাফাত দিবসে সারগর্ভ ও মর্মস্পর্শী বিদায়ী ভাষণ শেষে আল্লাহর পক্ষ হ’তে আরাফাতের ময়দানে নাযিল হয় এক ঐতিহাসিক দলীল, ইসলামের পূর্ণতার সনদ, যা ইতিপূর্বে নাযিলকৃত কোন আসমানী ধর্মের জন্য নাযিল হয়নি।
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপরে আমার নে‘মতকে পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’। (মায়েদাহ-৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যবানে পাকে এই আয়াত শ্রবণ করে হযরত ওমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু আনহু কেঁদে উঠলেন। অতঃপর লোকদের প্রশ্নের জওয়াবে বললেন, ‘পূর্ণতার পরে তো কেবল ঘাটতিই এসে থাকে’।( )
বস্তুত: এই আয়াত আল্লাহর প্রিয় নবীর ইন্তিকালের আভাস, এ আয়াত নাযিলের মাত্র ৯১ দিন পর তিনি ওফাত লাভ করেন। এই আয়াত প্রসঙ্গে জনৈক ইহুদী পন্ডিত হযরত ওমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেন,
عَنْ قَيْسِ بْنِ مُسْلِمٍ، عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ، أَنَّ الْيَهُودَ، قَالُوا لِعُمَرَ: إِنَّكُمْ تَقْرَءُونَ آيَةً، لَوْ أُنْزِلَتْ فِينَا لَاتَّخَذْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ عِيدًا،
যদি এরূপ আয়াত আমাদের উপর নাযিল হ’ত, তাহ’লে আমরা ঐদিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে উদযাপন করতাম’।
জওয়াবে হযরত ওমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
قالَ عُمَرُ: قدْ عَرَفْنَا ذلكَ اليَومَ، والمَكانَ الذي نَزَلَتْ فيه علَى النبيِّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، وهو قَائِمٌ بعَرَفَةَ يَومَ جُمُعَةٍ. قالَ ابنُ عبَّاسٍ : فإنَّها نزَلت في يومِ عيدينِ ، في يومِ جمعةٍ ، ويومِ عرفةَ
ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ঐদিনে একটি নয়, বরং দু’টি ঈদ একসঙ্গে উদযাপন করেছিলাম।-(১) ঐদিন ছিল শুক্রবার, যা আমাদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন (২) ঐদিন ছিল ৯ই যিলহাজ্জ আরাফাহর দিন। যা হ’ল উম্মতের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে বার্ষিক ঈদের দিন’। [তিরমিযী হা/৩০৪৪, সনদ ছহীহ]
‘গদির- এ খুম’ এর অন্তরালে শিয়াদের উদ্দেশ্য কী?
মূলত শিয়াদের এ সকল প্রপাগা-া, অপব্যাখ্যা, ভিত্তিহীন দাবি তথা সব কিছুর মূল উদ্দেশ্য হল:
প্রথমত: সাইয়েদুনা আবু বকর সিদ্দীক, সাইয়েদুনা ফারুক আযম এবং সাইয়েদুনা ওসমান জুন্নুরাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমের খেলাফতকে অস্বীকার করা এবং এ দাবি করা যে, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরবর্তী খালিফা হিসেবে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে নিয়োগ প্রদান করেন; কিন্তু পূর্ববর্তীরা জোর করে তাঁর কাছ থেকে খেলাফতের আসন ছিনিয়ে নেন। (না‘ঊযুবিল্লাহ্)
দ্বিতীয়তঃ এর মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের প্রতি মোনাফেকী, আমানতের খেয়ানত, প্রতারণা, জোর-জুলুম ইত্যাদি ভিত্তিহীন অভিযোগ উপস্থাপন করা। কারণ তাদের দাবি হলো, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খেলাফতের বিষয়টি কোরআনুল কারীম এবং মুতাওয়াতির হাদিস দ্বারা প্রমাণিত; কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহতালার এবং তাঁর রাসূলের এই নির্দেশ অমান্য করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
তৃতীয়ত: অনুরূপভাবে তারা আহলে বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিও আমানতের খেয়ানতের অভিযোগ উপস্থাপন করছে; কারণ তাদের দাবী অনুসারে তাঁরাও এ সত্যকে গোপন করেছেন। সিদ্দিক্বে আকবর, ফারুক্বে আ’জম, ওসমান যুন্নুরাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমের খেলাফত গ্রহণকালীন সময়ে একবারের জন্যও মাওলা আলীর বিষয়টি উপস্থাপন করেন নি।
চতুর্থত: ভিত্তিহীন এই দাবির মাধ্যমে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়াতের প্রতি সন্দেহ ছুঁড়ে; দেয়া কেননা তিনি যা ওছিয়ত এবং নির্দেশ দিয়ে গেছেন তা পরবর্তীতে বাস্তবায়ন হয়নি। তাই তাঁর বক্তব্য ছিল নিজস্ব; আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল না। (নাউজুবিল্লাহ)
পঞ্চমত: তাদের এই ভিত্তিহীন দাবির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কুদরতকে অস্বীকার করা এবং (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহ তায়ালাকে তাঁর ওয়াদা বাস্তবায়নে অক্ষম হিসেবে আখ্যায়িত করা। কেননা আল্লাহ তায়ালা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হয়নি বা আল্লাহ তাআলা তার বাস্তবায়নে অক্ষম।
ষষ্ঠত: এর অন্তরালে আল্লাহতালার কুরআনকে অস্বীকার করা। কারণ তাদের দাবি হলো কোরআনের নস (সূরা/ আয়াত) দ্বারা হযরত আলীর খেলাফত প্রমাণিত এবং এ সম্পর্কে ‘সুরা বেলায়েত’ নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা নাযিল হয় কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দিক, ফারুক আযম এবং ওসমান যুন্নুরাইন তা কোরআন থেকে বাদ দিয়েছেন এবং সর্বসাধারণ থেকে গোপন করেছেন। শিয়াদের এগুলোর সব ক’টি আক্বীদা তাদের মনগড়া ও অতি জঘন্য ও ইসলাম বিধ্বংসী। তাই এ ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের আক্বীদাপোষণের বিকল্প পথ নেই।
আমরা একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, وصي(ওয়াসি) নামক এই ভ্রান্ত আকিদার মূল উদ্ভাবক হলো আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা ইয়াহুদী। যা ধীরে ধীরে শিয়া ও রাফেযীদের আকিদায় অনুপ্রবেশ করে এবং তাদের আকীদার মূল উৎস হিসেবে রূপ নেয়। বলা বাহুল্য যে, শিয়াদের যতগুলো ভ্রান্ত আকিদা আছে তার অধিকাংশের উৎপত্তি হয়েছে গাদিরে খুমকে কেন্দ্র করে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে বাতিল আকিদা থেকে হেফাজত করুক। আমিন।
টিকা:
– মিশকাত হা/৬০৮২
– ইবনে হিশাম: ৪/৬০৩
– ইবনে ইসহাক্ব কৃত ‘সীরাহ রাসূল-আল্লাহ’, ৬৫০ পৃষ্ঠা।
– সহিহ বুখারী ইঃ ফাঃ মাগাযী অধ্যায় হাদিস ৪০১২
– ইবনে ক্বাসীর কৃত ‘আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া ৫/১২৩৩
– ইবনে ক্বাসীর কৃত ‘আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া ৫/১২৩৩
– হাদীসে গাদীরে খুম বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারী পুস্তকে (৫ম খ-, বই নং ৫৯, হাদীস নং ৬৩৭
– মুসনদে ইমামে আহমদ ৫ম খ-, ৩৪৭ পৃষ্ঠা #২২৯৯৫, সুনানে নাসাঈ ৫ম খ-, ৪৫ পৃষ্ঠা #৮১৪৫; মুস্তাদরাকে হাকিম ৩য় খ-, ১১৯ পৃষ্ঠা #৪৫৭৮; আবূ নুয়াইম, ইবনে জারীর ও অন্যান্যরা
– সুনান আল-কুবরা’, ৫ম খ-, ১৩০ পৃষ্ঠা, #৮৪৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ’তেও অনুরূপ বর্ণনা বিদ্যমান (৬ষ্ঠ খ-, ৩৭৪ পৃষ্ঠা)
– সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খ-, বই নং ৫৬, হাদীস নং ৭১৫
– আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৬০; আল-বিদায়াহ ৫/২১৫।
লেখক; সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।