খুতবাতু গাদীরে খুম (৫)
(خطبة غدير خم)
মূল: মাহাজ্জাহ-ডট-কম
অনুবাদক: নাঈম আল-জা’ফরী
(মিথ্যাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। তদ্রুপ সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায় কিন্তু বিলুপ্ত করা যায় না।)
ইবনে তাইমিয়া বলেছেন:
বিবৃতিটিতে এমন কিছুই নেই যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে এর (মাওলা শব্দ) উদ্দেশ্যমূলক অর্থ হল খিলাফত। কারণ মাওলা শব্দটি ওয়ালী শব্দের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
আল্লাহ বলেনঃ
إَِّنَما َولُِّيُكُمالّٰلُه َوَرُسْوُله َواَّلِذْيَنٰاَمُنْوا
নিশ্চয় তোমাদের বন্দু তো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ও ঈমানদাড়গণ। (সূরা আল মায়িদাহ: ৫৫)
َوإِْنَ تَظاَهَرا َعَلْيِهَ فإَِّن الّٰلَه ُهَو َمْوَلاُه َو ِجْبِرْيُل َو َصالُِح اْلُمْؤِمنِْيَن َواْلَمَلئَِكُةَ بْعَد ٰذلِ َك َظِهْيٌر
এবং তাঁর ব্যাপারে তোমরা জোঁট বাধ(এক অপরকে সাহয্য কর), তাবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাহয্যকারি (মওলা), এবং জিবরীল ও সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ এবং এরপর ফেরেশতাগণ [তাঁর] সহকারী রয়েছে। (সূরা তাহরীম : ৪)
আল্লাহ সোবহানাতায়লা ব্যাখ্যা করেছেন যে, রসূল (সাঃ) হলেন মুমিনদের ওলী (বন্ধু) এবং তদ্ররুপ তারাও তাঁর বন্ধু। একইভাবে আল্লাহ মুমিনদের বন্ধু এবং তারা তাঁর বন্ধু, একইভাবে মুমিনরাও একে অপরের বন্ধু, যেহেতু বন্ধুত্ব বিপরীত শত্রুতা এবং তা উভয় দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত।
তবে বন্ধুত্ব হলো এক ধরনের স্বদিচ্ছার রূপ, যদিও দুই বন্ধুর মধ্যে একজন মর্যাদার দিক দিয়ে অন্যজনের চেয়ে বড় হয়ও এবং অন্যেভাবে বলা যাায় বন্ধুত্ব হলো আনুগত্য ও উপাসনার রূপ। আল্লাহ যেভাবে মুমিনদের ভালোবাসেন এবং তারা তাঁকে ভালোবাসেন, এটাও একই রকম। তাই বন্ধুত্বের বিপরীত হলো শত্রুতা, যুদ্ধ এবং প্রতারণার। কাফেররা আল্লাহকে ভালোবাসে না বরং তাঁর ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে এবং তাঁকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করে।
আল্লাহ বলেনঃ
لَا تَتَّخِذُوْ فَأْذَنُوْا بِحَرْ بٍ مَّنَ الّٰلِهَ وَرُسْولِهٖ
অতঃপর যদি অনুরূপ না করতে পাড়, তবে নিশ্চত বিশ্বাস করে নাও, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে (তোমাদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধ। (সূরা বাকারা : ২৭৯)
আল্লাহ, মুমিনদের বন্ধু এবং মাওলা, তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফিরিয়ে দেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে আল্লাহ মুমিনদের বন্ধু ও তাদের মাওলা, এবং রাসূল তাদের বন্ধু ও তাদের মাওলা এবং আলী (ও) তাদের মাওলা হওয়ার অর্থ বন্ধুত্ব, সুসম্পর্ক ও সমর্থনকে বোঝায়।
মুমিনরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে এমন আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছে যাতে শত্রুতার সম্ভব নয়। তবে এই বিধান সকল মুমিনদের জন্য প্রযোজ্য। আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) মুমিনদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, যার অর্থ হলো এই যে, যারা অন্য মুমিনদেরকে তাদের বন্ধু ও মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তারাও তাঁকে (আলী) তাদের বন্ধু ও মিত্র হিসেবে মনে করেন।
এই হাদিসটি তাই আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) এর প্রতি আন্তরিক আনুগত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং নিশ্চিত করে যে তিনি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্বের যোগ্য। এটিই তাঁর (আলী) বিরুদ্ধে খাওয়ারিজ ও নওয়াসিব শত্রুদের দ্বারা যা কিছু বলা হয়েছে তা বাতিল করে দেয়।
আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) ছাড়া মুমিনদের আর কোনো মাওলা নেই বলে হাদীসে এমন কিছু উল্লেখ নেই। যখন নবী করীম (সাঃ)-এর অনেক মাওলা ছিল, অর্থাৎ, ধার্মিক মুমিনগণ – যার মধ্যে আশারায়ে মুবাশশারা (সুসংবাদপ্রাপ্ত) হযরত আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) অগ্রাধিকার প্রাপ্ত – তাহলে সেখানে এটা কিভাবে অনুমান করা সম্ভব তাহারা তাঁকে তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করেছিল? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে আসলাম, গিফার, মুযায়না, জুহায়না, কুরাইশ এবং আনসার গোত্রের আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) ব্যতীত কোন মাওলা ছিল না। (আল-বুখারী, কিতাব আল-মানাকিব, বাব যিকর আসলাম, ওয়া গিফার, দেখুন। মুযায়না, ওয়া জুহায়না, ওয়া আশজা, হাদিস নং ৩৩২১) আল্লাহ, তাদেরকে রাসূল (সাঃ) এর মাওলা বানিয়েছেন একই ভাবে তিনি মুমিনদেরকে তাঁর (আল্লাহ) মাওলা বানিয়েছেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) তাদের মাওলা।
সংক্ষেপে, ওয়ালী এবং মাওলার মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে, এবং এই বিশেষ্য পদ এবং ওয়ালী (গভর্নর) এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। উইলাইয়াহ (শত্রুতার বিপরীত) অর্থ বর্ণচ্ছটার এক প্রান্ত, এবং অন্য দিকে উইলাইয়াহ পদটি নেতৃত্বকে নির্দেশ করে। হাদীসে যে উইলাইয়াহের কথা বলা হয়েছে তা পূর্ববর্তী শব্দটিকে বোঝায়, পরবর্তীকে নয়। রাসুল (সাঃ) বলেননি যে, “আমি যে তার ওয়ালী (শাসক) আলী তার ওয়ালী।” (হাদীসে) শব্দটি যেমনটি ব্যবহৃত হয়েছে “আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা।”
মাওলা শব্দটি দ্বারা ওয়ালী (গভর্নর) বোঝাতে পারে না যেহেতু বন্ধুত্ব পারস্পরিক বন্ধনে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, মুমিনরা আল্লাহর বন্ধু এবং তিনি তাদের মাওলা (অভিভাবক)।
যেহেতু নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের (মুমিনদের) কাছে নিজেদের চেয়ে অধিকতর প্রিয়, ইহা শুধুমাত্র নবী (সাঃ) এর জন্য প্রজোয্য হবে কারণ এটি তাঁর নুবুওয়াতের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। যদি আমরা ধরেও নিই যে, তিনি (সাঃ) তাঁর অবর্তমানে একজন খলিফাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তার মানে এই নয় যে তিনি প্রত্যেক মুমিনের কাছে নিজের চেয়েও বেশি যোগ্য, যেভাবে নবী (সাঃ) এর স্ত্রীগণ তাঁর (আলী) স্ত্রী হতে পাড়বে না। এই যদি অর্থের উদ্দেশ্য হত তাহলে তিনি বলতেন, “আমি যার নিজের চেয়ে বেশি তার যোগ্য, আলী তার নিজের চেয়েও বেশি যোগ্য।” কিন্তু এটা কেউ বলেনি এবং কেউ এটি প্রচার করেনি এবং এর অর্থ অবশ্যই সর্ভৈব মিথ্যা। প্রত্যেক মুমিনের কাছে, নবীজি (সাঃ) নিজের চেয়ে বেশি যোগ্য হওয়া তার জীবন ও মৃত্যুতে একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়।
নবী (সাঃ) এর ওফাতের পরেই আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) এর খিলাফতের অস্তিত্বের আর্ভিরভাব হয়। নবীজি (সাঃ) এর জীবদ্দশায় এর অস্তিত্ব ছিল না। তাই হযরত আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু)-এর পক্ষে নবী (সাঃ) এর যুগে খলীফা হওয়া সম্ভব নয় এবং তাই তিনি প্রত্যেক মুমিনের কাছে নিজের চেয়ে বেশি যোগ্য হতে পারেন না, বরং খিলাফতের উদ্দেশ্য হলে তিনি কোনো মুমিনের মাওলা হতে পারতেন না। এই কারণগুলোর মধ্যেমে প্রমাণ হয় যে এখানে খিলাফত উদ্দেশ্য ছিল না। ব্যাপারটা হচ্ছে যে তিনি (আলী) প্রত্যেক মুমিনের বন্ধু তা নবী সঃ এর যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার বাস্তবায়ন নবী (সাঃ) এর ইন্তেকাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়নি, শুধুমাত্র খিলাফত যা নবী করীম সাঃ এর ওফাতের পরেই কার্যকর হয়। তাই, এ থেকে জানা যায় যে এটি (হাদীসে যা উল্লেখ করা হয়েছে) রাফেদদের উদ্দেশ্য ছিল তা কিন্তু না।
রসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায়, তাঁর ওফাতের পরে এমনকি আলীর মৃত্যুর পরেও সত্যই আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) প্রত্যেক মুমিনের মাওলা হয়েছেন। আজও বাতেনী ভাবে আলী (কঃ) প্রত্যেক মুমিনের “মাওলা” হয়ে আছেন যদিও তিনি জনগণের শাসনকর্তা নন। একইভাবে সকল ঈমানদার জীবিত ও মৃত একে অপরের বন্ধু। (মিনহাজ আল-সুন্নাহ, ৭/৩২২-৩২৫)
আমরা জানতে পেরেছি যে ‘মাওলা’ শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে। মহানবী (সাঃ)-এর জন্য আল্লাহ মুমিনদেরকে মাওলা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মাওলা শব্দটি কুরআন ও হাদিসে মধ্যে বিশেষ কোন অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয়নি। মাওলা অর্থ ওয়ালী থেকে ভিন্ন। যদি মাওলা শব্দটি খলিফাকে বোঝায়, তবে আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় মাওলা ছিলেন না; যাইহোক, যদি এটি বন্ধু এবং অভিবাবক বোঝায় তবে এটি নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায়ও প্রযোজ্য হবে এবং শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
চলবে