ক্বোরআন ও হাদীসের আলোকে মিলাদ মাহফিলে ক্বিয়াম-
মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন
===
আল-কুরআনের বিষয়বস্তুর মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আদব রক্ষা করার প্রসঙ্গটি অতি গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সত্তা অত্যন্ত সম্মান,মর্যাদা ও ইজ্জতের অধিকারী। মিলাদ শরীফে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সালাম ও সম্মান প্রকাশার্থে কিয়ামের প্রচলন শুরু হয়। কিয়াম করে সম্মান প্রদর্শনের এ প্রথা অতি প্রাচীন কালের। কিয়াম শব্দের অর্থ দাঁড়ানো। মিলাদ ছাড়াও নামাজ কায়েম, জমজমের পানি পান ও অপরাপর ইবাদত বন্দেগী ও সামাজিক জীবন যাপনে সৌজন্যতাবোধ রক্ষায় আমাদের দাঁড়াতে হয়। শাব্দিকভাবে কিয়াম হলো দন্ডায়মান অবস্থার নাম। সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে এটি একটি ফরয বা অপরিহার্য রুকন। সালাতের ক্ষেত্র ছাড়াও কোন সম্মানিত ব্যক্তির আগমন নির্গমনে সম্মানার্থে দন্ডায়মান হবার প্রথা বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত আছে। আমাদের আলোচ্য মিলাদের মজলিশে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শানে ‘কিয়াম-ই তা’জীম’ বহুল আলোচিত বিষয়।
বলা আবশ্যক, বাংলাদেশ ছাড়াও উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান এবং তুরষ্ক, আফ্রিকা, মিশর, সোমালিয়া, সুদান ও অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে মিলাদের কিয়াম এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইসলামে কিয়ামের বিভিন্ন প্রকারভেদ, মাত্রা ও নীতিমালা রয়েছে। যেমন:
১. কিয়ামে তাকাব্বুর : অহংকার প্রদর্শনার্থে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা। যেমন: আজমী রাজা বাদশাহগণের সামনে লোকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এর দ্ধারা তারা নিজেদের গর্ব প্রকাশ করতো। ইসলাম এ ধরনের কিয়ামকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছে।- [হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ২য় জিলদ,পৃ:৫৫৪]
২. কিয়ামে শাফক্বত : কারো প্রতি আদর, ¯েœহ কিংবা ভালোবাসার তাগিদে এ ধরনের কিয়াম করা হয়। যেমন: রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের মেয়ে ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার আগমনে দাঁড়াতেন।- [মিশকাত শরীফ]
৩. কিয়ামে তা’জিমী: কারো প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এ কিয়াম করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন দুধমাতা হালিমার আগমনে দাঁড়িয়েছিলেন।
-[হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, আশি’‘আতুল লুমু‘আত]
এ ছাড়াও ইসলামী শরীয়তে কিয়ামকে তিনটি ধারায় বিভক্ত করা হয়েছে:
১. ফরয কিয়াম: ইবাদতের উদ্দেশ্যে আল্লাহপাকের সম্মানে বিনয় সহকারে আবশ্যিকভাবে দাঁড়ানোকে ফরয কিয়াম বলা হয়। যেমন- দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযে প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তিকে আল্লাহর সম্মানে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে হয়। নামাযে এ কিয়াম ফরয। রোগ ভোগের ওযর ব্যতিত এ কিয়াম তরক করা চলে না। পবিত্র কুরআনে এ দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে-‘ওয়াকু-মু লিল্লাহি ক্বা-নিতীন।’ অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর সম্মানে বিনয় সহকারে দাঁড়িয়ে যাও।
২. সুন্নত কিয়াম: ইবাদতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিয়াম করা সুন্নত সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন-রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মোবারক যিয়ারতে দাঁড়ানো সুন্নত।
[ফতোয়ায়ে আলমগীরি, ১ম খন্ড, কিতাবুল হজ্ব] অনুরুপভাবে, মু’মিন বান্দাদের কবর যিয়ারতের সময়, আবে যমযমের পানি পানের সময় কিংবা কোন ধর্মিয় ও সম্মানিত নেতার আগমনে দাঁড়ানো সুন্নত। [বুখারী ও মুসলিম শরীফ,বাবুল কিয়াম]
৩. মুবাহ কিয়াম: দুনিয়াবি প্রয়োজনে কিয়াম করা মুবাহ বা জায়েয। যেমন দাঁড়িয়ে কাজ করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,-‘যখন তোমরা নামায থেকে অবসর হবে -তখন জমীনে রিযিকের তালাশে ছড়িয়ে পডো।’ আলোচ্য আয়াতে ছড়িয়ে পড়ার জন্য দাঁড়ানো পূর্বশর্ত। কারণ দাঁড়ানো ছাড়া ছড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়। তাই দাঁড়ানোর নির্দেশটি হলো মুবাহ।
পবিত্র কোরআনে কিয়ামের কথা
কিয়াম আরবি শব্দ। এর অর্থ সোজা হয়ে দাঁড়ানো। আল্লাহ পাক কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে কিয়ামের বর্ননা দিয়ে বলেছেন:
১.
وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
ওয়াক্বূ-মূ লিল্লাহি কা-নিতীন অর্থাৎ: আল্লাহরআনুগত্য প্রকাশের জন্য দন্ডায়মান হও। [সূরা বাক্বারা, আয়াত-২৩৮] ২.
يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ
ইয়াযকুরুল্লাহা কিয়ামান ওয়াক্বু‘ঊদান ওয়া আ’লা জুনুবিকুম। অর্থাৎ তোমরা দাঁড়িয়ে, বসে এবং করটের উপর ভর করে আল্লাহর জিকির কর। [আল-ই ইমরান, আয়াত- ১৯১] ৩.
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا
ওয়াল্লাযীনা ইয়াবীতূনা লিরাব্বিহীম সুজ্জাদাঁও ওয়াকিয়ামা
অর্থাৎ এবং যারা রাত আতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সাজদাবনত ও দন্ডায়মান অবস্থায়। [সূরা ফুরক্বান, আয়াত-৬৪]
৪. আল্লাহ পাক বলেছেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي
الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ ۖ وَإِذَا قِيلَ انْشُزُوافَانْشُزُوا يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ
آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍۚ
হে ইমানদারগণ! যখন তোমাদেরকে বলা হয়-“মজলিসের মধ্যে জায়গা প্রশস্ত করে দাও”, তখন তোমরা জায়গা (ছেড়ে দিয়ে) প্রশস্ত করে দেবে। আর যখন বলা হয়-“দাঁড়িয়ে যাও-তখন দাঁড়িয়ে যাবে”।
[সূরা মুজাদালাহ, আয়াত: ১১]
শায়খ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দিন আলবানী কুরআনে বর্ণিত উপরোক্ত ‘কিয়াম’ দ্ধারা নামাজের কিয়ামকেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতি তাফসীরে জালালাঈন শরীফে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘মিনাল খাইরাত’ দ্বারা সর্ব প্রকার নেক কাজকে বুঝিয়েছেন এবং বলেছেন, কোন মজলিশ কিংবা যে কোন প্রকার নেক কাজের জন্য দাঁড়াতে বলা হলে দাঁড়ানো আবশ্যক। এ জন্য মিলাদ মাহফিলে ‘যিকরে বেলাদত’ বা হুজুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দুনিয়াতে আগমনের কথা শুনে সম্মানার্থে কিয়াম করা হয়। ফেকাহ ও ফতোয়া মোতাবেক এটি মোস্তাহাব। মুস্তাহাব হলেও একে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। সাহাবায়ে কেরামও নবীজীর প্রতি এরূপ সম্মান প্রদর্শনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও বদর যুদ্ধে অংশ নেয়া সাহাবীদেরকেও বিশেষভাবে সম্মান দিতেন।
একবার কতিপয় বদরী সাহাবী রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাযির হয়ে সালাম দিলেন এবং বসার সুযোগ না পেয়ে হুজুরের সম্মুখভাগে এবং আশেপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্যান্য সাহাবীরা বদরী সাহাবীদের সালামের জবাব দিলেন সত্য, কিন্তু তাঁদের বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারলেননা। হুজুরের আশেপাশে বসে থাকা অপরাপর সাহাবীরাও নিকটতম স্থান ত্যাগ করে দুরবর্তী স্থানে বসতে রাজী ছিলেন না। এ পরিস্থিতি হুজুরের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক মনে হলো। অত:পর নিকটে বসা সাহাবীদের নাম ধরে ধরে তিনি বদরী সাহাবীদের বসার জায়গা দেয়ার আহ্বান করলেন। সাহাবীরা রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আহ্বানে সাড়া দিলেন কিন্তু নিকটতম স্থান ত্যাগ করার জন্য মনে কষ্ট পেলেন। রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদের মনোবেদনা টের পেলেন এবং বদরী সাহাবীদের প্রতি এরূপ সম্মান প্রদর্শনের জন্য কোরআনের উপরোক্ত আয়াত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন,–“তোমরা তোমাদের নবীর নির্দেশে বদরী সাহাবীদের সম্মানে জায়গা ছেড়ে দিয়েছো -আল্লাহ তোমাদের জন্য বেহেশতে এর চেয়েও প্রশস্ত জায়গা করে দিবেন।”
আল্লামা সাভী মন্তব্য করেন-‘আয়াতখানা যদিও কতিপয় সাহাবীর শানে নাযিল হয়েছে, কিন্তু এটা দ্বারা সমস্ত উম্মতকেই শিক্ষা দেয়া হয়েছে। শানে নুযুল খাস হলেও হুকুম ছিল আ’ম বা ব্যাপক। সুতরাং ইলমের মজলিশ, যিকিরের মজলিশ, নামাযের জামাত, যুদ্ধক্ষেত্র ও অন্যান্য নেক কাজের সমস্ত মজলিশ অত্র আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। যে কোন উত্তম মজলিশে দাঁড়াতে বললে দাঁড়িয়ে যাবে।-এটাই কোরআনের নির্দেশ। কাজেই আয়াত দ্বারা প্রমানিত হয়, হুজুরের মিলাদ একটি উত্তম অনুষ্ঠান। উক্ত অনুষ্ঠানে হুজুরের প্রতি তা’যীম ও সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া’ই কোরআনের দাবী।
হাদীস শরীফে কিয়াম প্রসঙ্গ
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের পুর্বাপর অলৌকিক কাহিনী, তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত ও জীবন চরিত আলাপ-আলোচনা, তাঁর প্রতি আদব, তাঁর প্রশংসামূলক কবিতা, দুরুদ ও সালামের যুক্তিনির্ভর রেওয়ায়েত সাহাবীদের বরাতে বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। ইমাম আবু ঈসা আত তিরমিযি তাঁর কিতাব তিরমিযি শরীফে ‘মিলাদুন্নবী’ নামে একটি অধ্যায় আর “কিয়াম” নামে একটি পরিচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এসব হাদীস দ্ধারা বুঝা যায়, সম্মান প্রদর্শনের জন্য কিয়াম করা বা দন্ডায়মান হওয়ার দৃষ্টান্ত ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতির মধ্যেও আছে।
১. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাবুক যুদ্ধের সময় তওবা কবুলের ঘোষণা প্রসঙ্গে তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ দৌঁড়ে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানালেন। আল্লাহর কসম! মুহাজিরদের মধ্যে তিনি ব্যতিত আর কেউ আমাকে এরূপ দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন নি। আমি তালহার সম্মান প্রদর্শনের এমন বিরল দৃষ্টান্ত কোনদিন ভুলতে পারবো না।
[আল-আদাবুল মুফরাদ- সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ শরীফ]
উল্লেখ্য, ঘটনাটি স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতিতে তাঁর সম্মুখেই ঘটেছে। কিন্তু কিয়াম করে এরূপ সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে তিনি কোনরূপ আপত্তি করেননি।
২. উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর প্রিয় কণ্যা ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা পরষ্পরের প্রতি সম্মান ও অনুরাগ প্রকাশের ক্ষেত্রে কিয়াম করতেন। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা আরো বর্ণনা করেন, কথাবার্তায়, উঠাবসায় ফাতিমার চেয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যশীল আর কেউ ছিলেন না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁকে আসতে দেখতেন তখন তিনি তাঁকে খোশআমদেদ জানাতেন, তাঁর জন্য উঠে দাঁড়াতেন, তাঁকে চুম্বন করতেন। এমনকি হাত ধরে তাঁকে নিজের আসনে বসিয়ে দিতেন। অপর দিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিকট গমন করলে তিনিও তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতেন এবং উঠে গিয়ে তাঁকে চুম্বন করতেন। [বুখারী, হাদীছ নং ৩৩৫৪, তিরমিযি, হাদীছ নং ৩৮০৯, প্রাগুপ্ত, পৃ:৪২২]
৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করেন যে, মদিনার একটি ইহুদী সম্প্রদায়-বনূ কোরায়যা হুজুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মদিনা সনদ/চুক্তি ভঙ্গ করে খন্দকের যুদ্ধের সময় মদিনা আক্রমন করার অপরাধে মুসলিম বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে আতœসমর্পণের উদ্দেশ্যে যখন হযরত সা’আদ ইবনে মু’আয রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিচার মেনে নিতে রাজী হলো তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’আদকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালেন। হযরত সা’আদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যুদ্ধাহত হওয়া সত্বেও রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে তিনি যখন মসজিদে নববীর নিকটবর্ত্তি হলেন তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে উপস্থিত মদিনাবাসী আনসার সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন-‘ক্বু-মু ইলা সায়্যিদিকুম’ অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের নেতার সম্মানে দাঁড়িয়ে যাও”। [বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত-বাবুল কিয়াম,পৃ:৪০৩]
ইবনে হিশামের বর্ননামতে, নির্দেশটি যদিও আনসার সাহাবীদের প্রতি ছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আনসার-মুহাজীর নির্বিশেষে সকল সাহাবি সেদিন হযরত সাআ’দ কে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যান।
[সিরাতুন্নবী,৩য় খন্ড, পৃ:২৩০-২৩১]
৪. হযরত আবু হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে আমাদের মাঝে বসে পবিত্র হাদীস বর্ননা করতেন। যখন তিনি মজলিশ থেকে দাঁড়িয়ে যেতেন-তখন আমরাও তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতাম যে পর্যন্ত না তিনি কোন বিবির ঘরে প্রবেশ করতেন-সে পর্যন্ত আমরা তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে থাকতাম। [মিশকাত শরীফ: বাবুল কিয়াম]
হযরত মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষেèৗবী সাহেব এ হাদীস উদ্ধৃত করে লিখেছেন যে, সম্মান প্রদর্শনে কিয়াম যদি নিষিদ্ধ হতো তবে কোন অবস্থাতেই সাহাবায়ে কেরাম এমনটি করতেন না।
৫. ইমাম আবু দাউদ বর্ননা করেন যে- এক মজলিশে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বসা ছিলেন। তখন তাঁর দুগ্ধ বাবা আসলেন। তিনি তার জন্য চাদর মুবারক বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করলেন। অত:পর তাঁর দুধ মা আসলেন। তিনি তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাঁর জন্য চাদরের অন্য অংশ বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করলেন। [আবু দাউদ]
৬. হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার জন্য মসজিদে নববীতে একটি মিম্বর স্থাপন করলেন। এ মিম্বরে দাঁড়িয়ে হাসসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আল্লাহর হাবীবের শান-মান ও গৌরবময় জীবনী বর্ননা করতেন কিংবা মুশরিকদের প্রতিবাদ বা খন্ডন করতেন। আল্লাহর হাবীব হাসসানের বক্তৃতা শুনে বলতেন, যতক্ষণ সে শানমান বয়ান করে কিংবা মুশরিকদের প্রতিবাদ করে ততক্ষন হযরত জীবরাঈল আলায়হিস্ সালামের মাধ্যমে আল্লাহ তাকে সাহায্য করে থাকেন। [সহীহ আল বুখারী]
৭. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময়ে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত বা মিলাদ সংক্রান্ত বর্ননা কিয়াম অবস্থায় বর্ননা করেছেন। একদা তিনি মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে সমবেত সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন, বল, আমি কে? সাহাবায়ে কেরাম সমস্বরে বললেন, আপনি আল্লাহর রাসুল! রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো বাড়িয়ে বললেন, আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মোত্তালিব এবং আমি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেছি। [মিশকাত শরীফ, তিরমিজি শরীফ]
৮. হযরত হাসসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মসজিদে নববীতে স্থাপিত মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলতেন-
অর্থাৎ: রাসুলের সম্মানে দাঁড়ানো আমার উপর ফরয। আর ফরয তরককারী সঠিক পথের দাবীদার হতে পারে না। গুণী ও বিবেকবান ব্যক্তির উপর আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম! সে জামালে মোস্তফাকে দেখবে; অথচ তাঁর সম্মানে দাঁড়াবে না? [মুসলিম শরীফ]
পরিশেষে, মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন যেমন বৈধ ও সাওয়াবের কাজ, তেমনি ভক্তি সহকারে দাঁড়িয়ে নবী করীমকে সালাম দেওয়াও বৈধ ও সাওয়াবের কাজ। আল্লাহ্ বুঝা ও আমল করার তাওফীক দিন। আমিন।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক (অর্থনীতি), প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।





Users Today : 9
Users Yesterday : 357
This Month : 9
This Year : 171880
Total Users : 287743
Views Today : 1300
Total views : 3408863