পবিত্র ক্বোরআন করীমের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বশ্রেষ্ঠ মু’জিযা হলো পবিত্র ইস্রা ও মি’রাজ। আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীনের মহান কুদরত ও তাঁর প্রিয় হাবীবের নবূয়্যত-রিসালতের সত্যতার স্বপক্ষে একটি বিরাট প্রমাণ এবং ঈমানদার ও জ্ঞানীদের জন্য হেদায়ত, নেয়ামত, রহমত ও শিক্ষা।
এ মহান বিরল সফরে আল্লাহ্ পাক তাঁর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এমন নিকটতম স্থানে সমাসীন করেছেন যে স্থানে (لم يصل اليه ملك مقرب ولا نبى مرسل) পৌঁছতে পারেননি কোনও নৈকট্যধন্য ফেরেশতা এবং কোন নবী-রাসূল আলায়হিমুস্ সালামও। যে সফরে আল্লাহ্ তা‘আালা তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সমগ্র বিশ্বের সকল নিদর্শনাদি ও রহস্যাদি অবলোকন করানোর মধ্য দিয়ে স্বীয় কুদরতের গোপন ভা-ার ও অজানা বিষয়াদি সম্পর্কে চাক্ষুস ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান দ্বারা ধন্য করেন।
ইস্রা ও মি’রাজ কি?
الاسراء (ইস্রা) শব্দটির অর্থ রাতে ভ্রমণ করানো। যা পবিত্র কাবা ঘর হতে ভূমধ্য সাগরের পূর্বতীর ফিলিস্তিনে অবস্থিত পবিত্র বাইতুল মাকদিস বা মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ। যার বর্ণনা পবিত্র ক্বোরআনুল করীমের সূরা ইসরা বা বনী ইসরাঈলের প্রথম আয়াতে ও অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদিসে বিবৃত হয়েছে।
المعراج (মি’রাজ) হলোঃ عروج (ওর”জ) শব্দ থেকে উৎকলিত যার অর্থ হলো- ঊর্ধ্বগমন, আর معراج (মি’রাজ)’র অর্থ হলো ঊর্ধ্বগমনের বাহন বা সিঁড়ি। আর তা হলোঃ বাইতুল মাকদেস থেকে সপ্ত আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শনপূর্বক ‘ক্বাবা ক্বাউসাইন আও আদনা’ (দুই ধনুক বা তার চেয়ে কম) দূরত্ব পরিমাণে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্য ও সাক্ষাৎ লাভ।
যার বর্ণনা পবিত্র ক্বোরআনুল করীমের সূরা ‘আন্ নাজম’ এর প্রথম থেকে আঠার (১-১৮) আয়াতসমূহে ও নির্ভুল গ্রহণযোগ্য শতাধিক হাদিসে বিস্তারিতভাবে বিদ্যমান। যা সমষ্ঠিগতভাবে মুতাওয়াতির (সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত) পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
ইসরা ও মি’রাজ কখন সংঘটিত হয়েছিলো?
এ বিষয়ে কারও মতবিরোধ নেই যে, ইস্রা ও মি’রাজ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র হিজরতের পূর্বে সংগঠিত হয়েছিলো। শুধু তারিখ ও বছর নির্ধারণের বিষয়ে সামান্য মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। তবে বিশ্ব মুসলিমের নিকট যে রাতই মি’রাজের রজনী হিসেবে পরিচিত। সেটি হলো ২৬ তারিখ দিবাগত রাত তথা ২৭ তারিখ রজব মাসে। আর যা ছিল নবূয়তের দশম বছর ৬২০ খ্রিস্টাব্দে।
ইস্রা ও মি’রাজ কেন সংঘটিত হয়েছিলো?
++++++++++++++++++++++++
ইস্রা ও মি’রাজ কেন সম্পাদিত হলো তা নিয়ে বিশ্বখ্যাত প-িত ব্যক্তিবর্গ ক্বোরআন-হাদিসের পাশাপাশি নানা তথ্য-তত্ত্ব ও হিকমত তুলে ধরেছেন। নিম্নে কয়েকটি বিবৃত হলোঃ
খোদায়ী নিদর্শনাদি দেখানোর জন্য:
আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা বনী ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে এরশাদ করেন لنريه من اياتنا (তাঁকে আমার নিদর্শনাদি দেখানোর জন্য) [বনী ইসরাঈল, আয়াত-১]
যাঁকে সৃষ্টি করা না হলে এ বিশ্ব জাহান সৃষ্টি করা হতো না বরং যাঁর ওসীলায় এ সমগ্র দুনিয়ার সৃষ্টি তাঁকে যদি এ সৃষ্টিজগত দেখানো না হয়, তাতে অপূর্ণতা থেকেই যাবে। কারণ তিনি হলেন এ সৃষ্টির প্রাণ, প্রাণহীন দেহের যেমন কোন মূল্য নেই অনুরূপ তাঁর নূরানী কদমের ছাঁয়া ব্যতিরেকে এ পৃথিবী প্রাণহীন। তাই বিশ্বজগতে প্রাণ সঞ্চালনের জন্য তাঁকে এ নিদর্শনাবলীর পরিদর্শন।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শ্রেষ্ঠত্ব ও সকল প্রকার মু’জিযার সমাহার:
আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যান্য নবীকে পৃথক পৃথক কতগুলো মু’জিযা দ্বারা সম্মানিত করেছিল, যেমন হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামকে তুর পাহাড়ে আল্লাহ্র সাথে কথোপকথন। হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালামকে চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরিস আলায়হিস্ সালামকে জান্নাতে প্রবেশ ইত্যাদি। সকল নবীকে পৃথক পৃথকভাবে যা দেয়া হয়েছে এককভাবে তা প্রিয়নবীকে মি’রাজ রজনীতে দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কথা, আসমানে, আরোহন, জান্নাত পরিদর্শনসহ আরও অনেক কিছু। যা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যাপক মু’জিযার প্রমাণ।
জান্নাত-জাহান্নামের প্রত্যক্ষদর্শী:
নবী-রাসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম তাঁদের উম্মতদেরকে দোযখের সংবাদ দিয়েছেন চাক্ষুষভাবে না দেখে, একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীর উপর নির্ভর ও বিশ্বাস করে। কিন্তু একমাত্র আমাদের নবীই স্বচক্ষে জান্নাত-জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করে উম্মতদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। তাই না দেখে বর্ণনা আর প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
আসমানের ফরিয়াদ কবুল:
আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যদিওবা সকল বিশ্বের জন্য রহমত এবং আসমানের জন্যও কিন্তু তাঁর অবস্থানস্থল হলো জমিন। তাই আসমানের তথা ঊর্ধ্ব আকাশের ফরিয়াদ ছিল তাঁকে এক নজর দেখার। আর আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এ ফরিয়াদ কবুল করেন মি’রাজ রজনীতে।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূরের দর্শন লাভে তৃপ্ত হবার জন্য ফেরেশতাদের ফরিয়াদ:
বিশ্বখ্যাত তাফসীরকারকগণ বলেন, ফেরেশতাদের হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে সিজদার মূল কারণ ছিল তাঁর কপালে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নুর মুবারক চমকাচ্ছিল। তাই যে নূরের সামান্য ঝলক দেখে ফেরেশতাগণ সিজদায় অবনত হন, সে নূরকে চোখ ভরে দেখে পরিতৃপ্ত হবার জন্য তাঁদের মাঝে আগ্রহ অধিকহারে বৃদ্ধি পায়। যেমনভাবে শুকনো পিপাসার্ত জমিনে সামান্য বৃষ্টির ফোঁটার মাঝে তৃষ্ণা আরও বৃদ্ধি পায় ঠিক সেভাবে। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তার প্রিয় নবীকে আরশ আজীমে দাওয়াত দিয়ে পথিমধ্যে ফেরেশতাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাঁদেরকে চোখ ও মন-প্রাণ ভরে প্রিয় নবীর দর্শন দানের মাধ্যমে পরিতৃপ্ত করেন।
জান্নাত ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন:
إِنَّ اللّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْداً عَلَيْهِ حَقّاً فِي التَّوْرَاةِ وَالإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللّهِ فَاسْتَبْشِرُواْ بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (التوبة১১১)
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা খরিদ করে নিয়েছেন মু’মিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে…. [সূরা তাওবা, আয়াত-১১১]
আল্লাহ্ তা‘আলা ক্রেতা, মু’মিনগণ বিক্রেতা, পণ্য দর্শন ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় সম্পাদন বৈধ নয়। তাই আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যকার সম্পাদিত এ চুক্তির একমাত্র ওয়াকীল হিসেবে প্রিয় নবীর মধ্যস্থতায় এ চুক্তি সম্পাদিত হয়। কারণ তিনি উম্মতদের পক্ষ থেকে তাদের ক্রয়কৃত বেহেশত পরিদর্শন করে নিয়েছেন।
ভূ-মন্ডল ও নবমন্ডল উভয়ে প্রিয় নবীর রাজত্ব ও কর্তৃত্বের প্রমাণ:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” لِي وَزِيرَانِ مِنْ أَهْلِ السَّمَاءِ ، وَوَزِيرَانِ مِنْ أَهْلِ الأَرْضِ ، فَأَمَّا وَزِيرَايَ مِنْ أَهْلِ السَّمَاءِ : فَجِبْرِيلُ ، وَمِيكَائِيلُ ، وَأَمَّا وَزِيرَايَ مِنْ أَهْلِ الأَرْضِ : فَأَبُو بَكْرٍ ، وَعُمَرَ ” .(الترمذي)
অর্থাৎ আমার আসমানে দু’জন এবং জমিনে দু’জন উজির আছেন, জমিনে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হযরত ওমর ফার”ক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আর আসমানে হযরত জিব্রাঈল ও মিকাঈল আলায়হিমাস্ সালাম। [তিরমিযী]
আসমানে উজির থাকা মানে তাঁর ক্ষমতা আসমানেও জারি হয়। তাই তিনি মি’রাজ রজনীতে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন ভূমি পরিদর্শন করে উভয় জগতকে ধন্য করেন এবং স্বীয় কর্তৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটান।
নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর প্রতিশ্র”তি পূরণ:
(আলমে আরওয়াহতে) আল্লাহ্ তা‘আলা নবী-রাসুলগণের কাছ থেকে ওয়াদা নিয়ে ছিলেন যে, যখন প্রিয় নবী তাঁদের নবুয়তকালে তাশরীফ আনবেন তখন তারা সকলে তাঁর উপর ঈমান আনবেন এবং তাঁকে সাহায্য করবেন।
[সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৮১]
কিন্তু তারা কেউ এ ওয়াদা পূরণ করতে পারেননি কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আগমনের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন (একমাত্র ঈসা আলায়হিস্ সালাম ছাড়া) তাই তাঁরা তাঁদের এ ওয়াদা পূরণ করেছেন বাইতুল মাকদিসে প্রিয়নবীর ইমামতিতে নামায আদায়ের মাধ্যমে তাঁর প্রতি ঈমান ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও ইসরা ও মি’রাজের অনেক হিকমত নিহিত রয়েছে।
ক্বোরআন-হাদিসের আলোকে প্রিয় নবীর ইস্রা ও মি’রাজ:
************************************************
পবিত্র ক্বোরআনের বহু আয়াতে বিশেষ করে সূরা ‘বনী ইসরাঈল’ ও সূরা ‘আন্ নাজম’ এ এবং বুখারী-মুসলিমসহ অসংখ্য হাদিসগ্রন্থে প্রিয় নবীর ইসরা ও মি’রাজ সম্পর্কে বর্ণনা আসে। নিম্নে তার সামান্য বর্ণনা তুলে ধরা হলোঃ
আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা বনী ইসরাঈলে এরশাদ করেন-
﴿ سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ﴾ الإسراء/১.
অর্থাৎ তিনি পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার চতুর্দিকে আমি বরকতময়তার বিস্তার করেছি, তাকে আমার নিদর্শন হতে প্রদর্শনের জন্য। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
[সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত-১]
অনুরূপ সূরা ‘নাজম’এ এরশাদ করেন-
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى * مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى * وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى * إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى * عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى * ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى * وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى * ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى * فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى * فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى * مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى * أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى * وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى * عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى * عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى * إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى * مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى * لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى
(سورة النجم: الآيات ১-৮)
অর্থাৎ ১. শপথ নক্ষত্রের যখন তা স্মমিত হয়। ২. তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নন, বিপথগামীও নন, ৩. এবং তিনি মনগড়া কথাও বলেন না, ৪. তা তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়, ৫. তাঁকে শিক্ষা দান করেন শক্তিশালী, ৬. প্রজ্ঞাসম্পন্ন, অতঃপর স্থির হন, ৭. তখন তিনি ঊর্ধ্ব দিগন্তে, ৮. অতঃপর তিনি তাঁর নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী, ৯. ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা তারও কম, ১০. তখন আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন, ১১. যা তিনি দেখেছেন তাঁর অন্তকরণ তা অস্বীকার করেননি, ১২. তিনি যা দেখেছেন, তোমরা কি সে বিষয়ে তাঁর সাথে বিতর্ক করবে? ১৩. নিশ্চয় তিনি তাঁকে আরেকবার দেখেছিলেন, ১৪. সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে, ১৫. যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মাওয়া, ১৬. যখন সিজদা যা দ্বারা আচ্ছাদিত হবার তা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল, ১৭. তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি, ১৮. তিনি তো তাঁর প্রতি পালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিলেন। [সূরা নাজম, আয়াত ১-১৮]
বাইতুল মাকদাসে নামাজ আদায় ও ইমামতি:
মুসলিম শরীফে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
جاء في صحيح مسلم عن أنس بن مالك أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: “أتيت بالبراق، وهو دابة أبيض طويل فوق الحمار ودون البغل، يضع حافره عند منتهى طرفه فركبته، حتى أتيت بيت المقدس قال: فربطته بالحلقة التي يربط به الأنبياء، قال ثم دخلت المسجد فصليت فيه ركعتين
অতঃপর আমাকে মসজিদের দরজার কাছে নিয়ে আসে, সেখানে লক্ষ্য করি, অদ্ভুত আকৃতির একটি প্রাণী, যাকে গাধাও বলা যায় না আবার তা ঘোড়ার মতও না। উর”তে বিশাল আকার দু’টি পাখা, যার মাধ্যমে সে পায়ে আঘাত করে। চোখের দৃষ্টিসীমার প্রান্তে গিয়ে তার সম্মুখ পা দু’টি মাটি স্পর্শ করে। এর নাম মুবারক। আগের যুগের নবীগণ এর উপরেই আরোহণ করতেন। আমাকে তার উপর আরোহণ করাল। জিবরিল আমিনের সাহচর্যে আমি আসমান-জমিনের বিচিত্র নিদর্শন দেখতে দেখতে বায়তুল মাকদিসে পৌঁছি। সেখানে অবতরণ করে জিবরিল দরজার আংটার সাথে বোরাক বাঁধেন, আল্লাহ্ পাক সেখানে সকল নবীদের একত্রিত করেন, জিব্রাঈল নবীজীকে আগে বাড়িয়ে দেন, নবীজি সকলকে নিয়ে জামাতে নামায আদায় করেন। [মুসলিম শরীফ]
নবীগণের সাথে সাক্ষাত:
বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى أَخْبَرَنَا هِشَامُ بْنُ يُوسُفَ أَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ عَنْ الزُّهْرِيِّ عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيَّبِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي رَأَيْتُ مُوسَى وَإِذَا هُوَ رَجُلٌ ضَرْبٌ رَجِلٌ كَأَنَّهُ مِنْ رِجَالِ شَنُوءَةَ وَرَأَيْتُ عِيسَى فَإِذَا هُوَ رَجُلٌ رَبْعَةٌ أَحْمَرُ كَأَنَّمَا خَرَجَ مِنْ دِيمَاسٍ وَأَنَا أَشْبَهُ وَلَدِ إِبْرَاهِيمَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِهِ ثُمَّ أُتِيتُ بِإِنَاءَيْنِ فِي أَحَدِهِمَا لَبَنٌ وَفِي الْآخَرِ خَمْرٌ فَقَالَ اشْرَبْ أَيَّهُمَا شِئْتَ فَأَخَذْتُ اللَّبَنَ فَشَرِبْتُهُ فَقِيلَ أَخَذْتَ الْفِطْرَةَ أَمَا إِنَّكَ لَوْ أَخَذْتَ الْخَمْرَ غَوَتْ أُمَّتُكَ
আমি লক্ষ্য করি, হযরত ইবরাহিম, মুসা ও ইসা আলায়হিমুস্ সালাম এর সাথে আরো অনেক নবীগণ একত্রিত হয়েছেন সেখানে। হযরত মুসা আলায়হ্সি সালাম এর আকৃতি একটি উপমাযোগ্য দেহের ন্যায়। শানুয়া বংশের পুর”ষদের মত অনেকটা। কোঁকড়ানো চুল, হালকা গড়ন, লম্বা শরীর। হযরত ঈসা আলায়হ্সি সালাম-এর আকৃতি মাঝারি গড়ন, ঝুলন্ত সোজা চুল, চেহারা সৌন্দর্য তিলকে ভর্তি। মনে হচ্ছিল তিনি গোসলখানা হতে বের হয়েছেন, পানি টপকাচ্ছে মাথা হতে, অথচ কোন পানি টপকাচ্ছিল না। প্রায় উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফির মত। হযরত ইব্রাহিমের আকৃতি আমার মত, আমি-ই তার সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। অতঃপর আমার সামনে দু’টি পেয়ালা, একটি মদের অপরটি দুধের পেশ করা হয়। আমাকে বলা হল, যেটা ইচ্ছে পান কর”ন, আমি দুধের পেয়ালা হাতে নেই এবং পান করি। আমাকে বলা হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যদি আপনি মদের পেয়ালা হাতে নিতেন, পান করতেন, আপনার উম্মত গোমরাহ্ হয়ে যেত। অপর একটি বর্ণনায় পানির তৃতীয় আরেকটি পেয়ালার উল্লেখ পাওয়া যায়। [ইবনে হিশাম, বোখারী, মুসলিম শরীফ]
বরকতময় স্থানে নামাজ আদায়:
নাসায়ী শরীফে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বাইতুল মাকদাস যাত্রাকালে তিনস্থানে যাত্রা বিরতি করেন এবং নামাজ আদায় করেন। তা দ্বারা আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দাদের বরকতময় স্মৃতি ও নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান ও বরকত হাসিলের বাস্তব প্রমাণ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال أتيت بدابة فوق الحمار ودون البغل خطوها عند منتهى طرفها فركبت ومعي جبريل عليه السلام فسرت فقال انزل فصل ففعلت فقال أتدري أين صليت صليت بطيبة وإليها المهاجر ثم قال انزل فصل فصليت فقال أتدري أين صليت صليت بطور سيناء حيث كلم الله عز وجل موسى عليه السلام ثم قال انزل فصل فنزلت فصليت فقال أتدري أين صليت صليت ببيت لحم حيث ولد عيسى عليه السلام ثم دخلت بيت المقدس فجمع لي الأنبياء عليهم السلام فقدمني جبريل حتى أممتهم )سنن النسائي كتاب الصلاة‘ رقم الحديث : ৪৫০)
অর্থাৎ প্রিয় নবী তাজেদারে মদিনা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বোরাকের উপর বায়তুল মাকদিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বাইতুল মাকদিসে যাত্রাকালে বোরাক থেকে নেমে দু’রাকাত নামায আদায় করতে অনুরোধ করলে আমি দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আপনি ইয়াসরিব তথা মদিনা মুনাওয়ারায় নামায আদায় করেছেন, যেখানে হিজরত করে আপনি আশ্রয় গ্রহণ করবেন। মদিনা হতে আবার যাত্রা করলেন। কিছুদূর অতিক্রম করার পর হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বোরাক থেকে অবতরণ করে নামাজ আদায় করতে আরজ করলে তিনি নামায আদায় করেন। হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম বললেন, এটা সিনাই পাহাড়, এখানে যে গাছ দেখছেন তার নিকট হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম আল্লাহর সাথে কথা বলতেন। আবার ভ্রমণ শুর” হলো। কিছূদূর পর জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম বললেন, বোরাক থেকে নেমে সালাত আদায় কর”ন। নবীজি তাই করলেন। হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম বললেন, আপনি হযরত শুয়ায়ব আলায়হিস্ সালাম’এর আবাস মাঠে সালাত আদায় করলেন। আবার যাত্রা শুর” করে কিছুদূর যাওয়ার পর হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম মাটিতে নেমে নামায পড়তে বললেন, তিনি নামায আদায় করেন। অতঃপর হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম বললেন, এ জায়গার নাম বাইতুলহম (বেথেলহাম), হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম এখানেই জন্মগ্রহণ করেন।
[নাসাঈ, কিতাবুস্ সালাত, হাদিস নং-৪৫০]
অতএব, স্মরণ রাখতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে, শবে মি’রাজ শুধুমাত্র কোনো আশ্চর্য বা কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, মি’রাজ আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল বাস্তব দৃষ্টান্ত, আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহান আল্লাহর সাক্ষাত লাভ, পূর্ববর্তী নবী-রাসূল, ফেরেশতাদের সঙ্গে মোলাকাত, বেহেশত-দোযখ স্বচক্ষে দর্শন, বায়তুল মুকাদ্দাস ও বায়তুল মা’মুরে নামায আদায়, উম্মতের জন্য সুপারিশ ও ফরিয়াদ করার কারণে এ শবে মি’রাজের রাতটি অতীব তাৎপর্যবহ এবং মহিমান্বিত।
বিশ্ব মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন জীবন ব্যবস্থা হিসেবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্ব পালনকর্তা আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পেয়েছিলেন মি’রাজ রজনীতে। এ জন্য এ রাতটি মুসলমানের জন্য অতীব গুর”ত্বপূর্ণ। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সব মু’জিযার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মু’জিযা হলো মি’রাজ। এ রাতে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসে নামাজে সব নবীর ইমাম হয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালিনের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ফলে এ রাতটি নিঃসন্দেহে তার শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবোজ্জ্বল নিদর্শন বহন করে।
হযরত আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে আছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, মি’রাজের রাতে আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার পর আল্লাহ্ আমাকে তিনটি বিশেষ উপহার প্রদান করেছেন, ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামায, ২. সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, ৩. যে মুসলিম আল্লাহর সাথে শরীক করবে না তার সকল কবিরা গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে। [সহীহ্ মুসলিম]