কেন আত্মহনন? মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির তানভীর
একজন মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন এর মধ্যে ব্যক্তিত্ব্যে সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতার মানসিক, মাদকাসক্তি, এনজাইটি, ডিপ্রেশন অথবা প্ররোচনা ইত্যাদি।
এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে। ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই হার নারীদের মধ্যে বেশি। সাধারণত কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। স্বল্পশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহের জন্য অনেকে আত্মহত্যা করে। এ ছাড়াও প্রেম-সম্পর্কিত জটিলতা, আর্থিক অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব আত্মহত্যার পেছনের অন্যতম কারণ।
গ্রামের সাবসেন্টারে কিংবা উপজেলা হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে অনেক চিকিৎসককে আত্মহত্যার রিপোর্ট লেখতে হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ নারী পুরুষ আত্মহত্যা করেন কীটনাশক পান করে। তাছাড়া গলায় দড়ি পেঁচিয়েও অনেককে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। এ দৃশ্য অত্যন্ত ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক। আত্মীয়স্বজনদের কান্না আহাজারি আর বিলাপে হাসপাতাল ভারী হয়ে উঠে। প্রতিবছর বাংলাদেশে এক লাখেরও অধিক নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেন। আর বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ পুরুষ ও নারী আত্মহত্যা করে, যা যে কোনো যুদ্ধে নিহতের চেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা করছেন।
আত্মহত্যার হার মধ্যবয়স্ক বা বয়স্কদের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ বছরের চেয়ে বেশি বয়স্ক ককেশিয়ান পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, যদিও যুবক যুবতীরা প্রায়ই আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এটি কিশোর কিশোরীদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাধারণ কারণ এবং অল্পবয়সী ছেলেদের মধ্যে দ্বিতীয়টি দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর কারণ বলে ধারণা করা হয়। উন্নত বিশ্বের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে এটা প্রায় ৩০% মৃত্যুর কারণ। উন্নয়নশীল বিশ্বে এর হার অনুরূপ, কিন্তু এটি অন্যান্য ধরনের আতঙ্ক থেকে যে মৃত্যু হয় তার চেয়ে এর হার বেশি । বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, আত্মহত্যা থেকে মৃত্যুর হার বয়স্ক মহিলাদের তুলনায় অল্পবয়সী নারীদের মধ্যে বেশি হারে দেখা যায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। কেউ মা-বাবার ওপর অভিমান করে, কেউবা পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করাতে আবার কারো কারো কারণ থাকে অজানা। তবে বেশির ভাগ আত্মহত্যা করেন ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার জন্য।
ডিপ্রেশন কী?
ডিপ্রেশন একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি যা একজন মানুষকে সবার অজান্তে তিলেতিলে শেষ করে দেয়।
মানুষের শারীরিক মানসিক কর্মক্ষমতা ও মারাত্মক কমিয়ে দেয় এই ডিপ্রেশন। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় তিনশ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন=১০ লাখ) ডিপ্রেশন এর রোগী রয়েছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৫ জনের ১ জন মানুষ কোনো না কোনো ধরনের ডিপ্রেশন বা এনজাইটি তে ভুগছেন।
অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কের অবনতি এই ডিপ্রেশন এর জন্য হয়ে থাকে, যা হয়তো থেকে যায় একেবারে অজানা। আবার উল্টোটি হয়। পারিবারিক বা সামাজিক টানাপোড়েন থেকেই অনেক সময় মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগেন।
শুরুতেই বলেছিলাম, ডিপ্রেশনের ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে আক্রান্ত রোগীরা নীরবে-নিভৃতে আত্মহত্যা করে বসেন। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বিশ্বের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ এই ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন বেশি দেখা যায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। অনেক ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন থেকে ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেশার হয়ে থাকে। ডিপ্রেশন শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর এমনকি সন্তানসম্ভবা মা কিংবা প্রসূতি মায়েদের ও ডিপ্রেশন দেখা দেয়, যা থেকে তারা আত্মহত্যা করে বসেন।
বাংলাদেশের শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো প্রকারের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন যাদের পরিবারের অনেকে হয়তো জানেন-ই না যে, তারা ডিপ্রেশনের রোগী, চিকিৎসা তো দূরের কথা। তবে আমার মতে সংখ্যাটা হয়তো আরও বেশি হবে কেননা এখনো আমাদের অনেকেই আছে ডিপ্রেশন কে কোন রোগই মনে করেন না। কিংবা ডিপ্রেশন নিয়ে সচেতন না।
বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ডিপ্রেশনের রোগী হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং এ ডিপ্রেশনকে কাটিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে আব্রাহাম লিংকন, চাঁদে ভ্রমণকারী এডুইন অলড্রিন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইস্টন চার্চিল, বিখ্যাত “হেরি পোর্টার” এর লিখিকা জে কে রওলিং, গ্রেমি এওয়ার্ড খেতাবপ্রাপ্ত গায়িকা শেরিল ক্রো, যুক্তরাষ্ট্রীয় সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রী টিপের গোর নাম উল্লেখযোগ্য।
মার্কিন নভোচারী অলড্রিনের দাদা-দাদি ও ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন যারা এ নিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং হেরি পোর্টারের লেখিকা রোলিং একসময় ডিপ্রেশনের জন্য মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবতেন। তবে তারা নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্ট সঙ্গে আলোচনা করেন।
ডিপ্রেশনের রোগীদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, তাদের সঙ্গে ডিপ্রেশন নিয়ে আলাপ করতে হবে, এবং তাদের চিকিৎসার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হিবে। ইদানীং অনেক মেডিকেল স্টুডেন্টকে ও ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যা খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ডিপ্রেশনের প্রধান কিছু লক্ষণ:
♦ সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকা
♦ উৎসাহ উদ্যম হারিয়ে ফেলা
♦ ঘুম কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ রুচি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ কাজকর্মে শক্তি না পাওয়া
♦ মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
♦ মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
♦ নিজেকে নিঃস্ব অপাঙক্তেয় মনে করা
♦ অযাচিত অপরাধবোধ
♦ আত্মহত্যার কথা বলা, ভাবা।
এই লক্ষণগুলো টানা দু’সপ্তাহের বেশি থাকলে আমরা তাকে মেজর ডিপ্রেশনের রোগী বলি, এবং তিনি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন বলা যায়।
চিকিৎসা:
সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকে নানান প্রকারের কার্যকরী এন্টিডিপ্রেশেন্ট ড্রাগ সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে একজন ডিপ্রেশনের রোগীকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সাধারণত এমিট্রিপটাইলিন, সিটালোপ্রাম, এস সিটালোপ্রাম, মিরটাজাপিন এন্টিডিপ্রেশন হিসেবে খুবই কার্যকরী।
সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ডিপ্রেশনের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই গত বছরের ৭ এপ্রিল (২০১৭) বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান করা ছিল-
“ডিপ্রেশন: লেট’স টক” অর্থাৎ “আসুন, ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা করি।”
তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া, দ্যা ডেইলি স্টার, বিভিন্ন আর্টিকেল থেকে নেওয়া।