হিজরি, আশুরা, কারবালা : আমার ভাবনা
——————————–
মাশুক আহমেদ
প্রেমাস্পদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল স্মৃতিকেই প্রেমিক স্মরণ করবে। এই স্মরণ মানেই প্রেমের বিকাশ। উপলক্ষ, প্রেম নিবেদনের। রোমন্থনে মুর্ছা যাওয়ার, কিছুক্ষণের জন্য। সেই পবিত্র স্মৃতিগুলো কোনটা আনন্দের। কোনটা বিষাদের। সেই তো প্রকৃত প্রেমিক যে একক বুকের জমিনেই আনন্দ ও বিষাদকে একই সাথে স্থান করে দিতে পারে। প্রেমিকের নয়নেই তো বয়ে যায় আনন্দাশ্রু।
এই কিছু কিছু স্মৃতিগুলোই জমাট হয়ে প্রেম যমুনার জোয়ার ঘটায়। তাই একটা স্মৃতিকে ধারণ করতে যেয়ে প্রেমাস্পদের অন্য কোন একটা ক্ষুদ্র স্মৃতিকে বিস্মৃতির বেড়াজালে শৃংখলিত করা কাম্য নয়।
যে স্মৃতিগুলো পবিত্র সেই স্মৃতিগুলো কোনটা আনন্দের, কোনটা বিষাদের হলেও একই সাথে স্মরণীয় রাখার প্রশ্নে কোনটাই একটির সাথে আরেকটা কোনভাবেই সাংঘর্ষিক নয়।
কবি ফররুখ বলছেন – “আয়েশী রাতের বাঁকা রেখা নয়, ওঠেছে মহররমের চাঁদ “
মুহররম যেন আমাদের সকল চেতনাকে একটি বৃহৎ একক চেতনায় পরিণত করেছে।
মোসলমানের আনন্দ। মোসলমানের অশ্রু। এই আনন্দাশ্রুর উৎসমূলে গেলে অবলোকিত হবে সেটা ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। এই আনন্দ ও অশ্রুর সমীভূত সন্নিপাতের মধ্যেই বিশ্বাসের বিপ্লব। প্রেমের বিজয়।
সত্যবাণী প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মহাকালের সেই মহানতম সত্তা নিজ মাতৃভূমি ত্যাগের বিষাদগম্ভীর মুহুর্তে অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে বারংবার পেছনে তাঁকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন হে আমার জন্মভূমি আমি তোমাকে ভালবাসী…. আমাদের অন্তর দিয়ে এই পবিত্র আবেগকে স্পর্শ করতে হবে।
অন্যদিকে প্রেমাস্পদের প্রাণের শহর যখন তাঁর শুভাগমনে গেয়ে ওঠলো- তালা আল বাদরু আলাইনা..
সেই প্রেমানন্দও তো আমাদের হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে দিতে হবে।
তিনি সেই শহরে পৌচ্ছালেন রবীউল আউয়াল মাসে। কিন্তু তাঁর হিযরতের প্রস্তুতির সূচনা হয়েছিলো মূলত জিলহাজ্জের শেষের দিকে। এবং হিযরতের পরিক্রমায় প্রথম কাফেলা পৌচ্ছেছিলো মুহররম মাসেই।
হিযরতের পথে সেই গারে সূরের স্মৃতি, সেই একটু একটু করে হেটে চলা। সেই কবুতর, দুইজনের দ্বিতীয়জনের সেই এক রাতের ইবাদত….. সেই সফরের প্রত্যেক পবিত্র নিশ্বাসে নিশ্বাসে যে কথা আছে সেই কথার আওয়াজ আমাকে তো শ্রুতিগত করতেই হবে।
বিষয়টি সবচেয়ে ভালোমতো উপলদ্ধি করেছেন তাঁর সাথীদল। বিশেষ করে, জ্ঞানের শহরের দরোজা অভিধায় অভিষিক্ত রহস্যপূরুষ আলী রা.। যখন সাতন্ত্রতার প্রশ্ন আসলো যে, প্রত্যেক জাতিসত্তার একটি নিজস্ব সাল গণনার ঐতিহ্য রয়েছে তখন তিনি, সেই আবু তালিব পুত্র মহাত্মা আলী হিযরতের স্মৃতিকেই স্মরনীয় রাখার মর্ম বিকশিত করলেন।
তাই আবু মুসা আশায়ারী রা. কর্তৃক আবেদনের প্রেক্ষিতেই সায়্যিদুনা আলী রা. এর অভিমতে খলিফাতুল মুসলিমীন সায়্যিদুনা উমর রা.মোসলমানদের সতন্ত্র বর্ষ গণনার একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত জানালেন। হিযরতের স্মৃতিমাখা হয়ে সনের নাম হলো হিযরী সন। হিযরী সন তাই শুধু একটি দিন পঞ্জিকা নয়। একটি চেতনা। একটি ইতিহাস।
যেন সব থমকে ছিলো, যখন ঈমানের শহরে স্বয়ং ‘ঈমান’ শুভাগমন করলেন তখন সেই ক্ষণ থেকেই যেন আনুষ্ঠানিক জীবন সফর শুরু হলো ইসলামের। হিযরতকে প্রতিটি দিন স্মরণীয় রাখার জন্য মোসলমানের সময়ের ঘড়ির নাম দিয়ে দেওয়া হলো হিযরী।
মহাকালের মহাজন, প্রাণের স্পন্দন যখন প্রেম নগরীতে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন যেন প্রাণ পেল ইসলাম। যুগে যুগে স্পন্দিত হলো মোসলমান। এ যেন, পরোয়ারদিগারের মহাঅভিপ্রায়। নিজ নিজ সত্তাকে ঋদ্ধ করতে হবে এই সম্পৃক্ততার, এই অভিপ্রায়ের মর্ম মনন উদ্ধারে।
সৃজনে প্রথম ও শেষান্তে শুভাগমনকারী সেই অতুলনীয় সত্তার স্তব স্তুতিতে মুখরিত মহাকাল। অবিশ্রান্তভাবে শান্তিবারতা শান্তি খুজে পাক তাঁর পাক কদমে। তিনি জানিয়েছেন এই মুহররম মাসের দশম দিনের নবীগণের নানা স্মৃতিকথা। ইতিহাস।
ইতিহাস বিস্মৃতির জন্য বর্নিত হয়না। অহেতুক সংঘটিত হয়না। থাকে বারীতায়ালার হিকমাহ। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ঐতিহাসিক ভুল করা কি সঠিক চিন্তা? যেই বিষয়গুলো জাতিসত্তার। জাতিগত সাতন্ত্রতার সেগুলো উপেক্ষা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নির্সন্দেহে।
যেমন আশুরার দিনে কারবালার রক্তমাখা আওয়াজ আন্দোলিত করে দেয় আমাদের ভেতর-বাহির। চির বিষন্ন, বিমর্ষ করে যেন বন্ধ করে দেয় জীবনের কপাট।
কিন্তু মুমীনের যে এই আনন্দ বিষাদের মাঝেই ত্যাগের উৎসব। জিলহাজ্জেই হয়ে গেলো ইবরাহীমী কুরবানীর স্মারক, কুরবানীর ঈদ। এই কুরবানী। এই ঈদ। পাশাপাশী। সাংঘর্ষিক নয়।
যেমন হুসাইনী শাহাদাতের মাঝেই ইমানের বিজয় দেখতে পেয়েছেন বিদ্রোহী নজরুল। বলেছেন- ‘ হোসাইনি শহিদি ঈদ মহিয়ান’, মর্মবোধ প্রকাশে বলেছেন- ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা..
এই আত্মত্যাগের মাঝেই জীবন তার স্পন্দন খুঁজে পায়। ইকবাল বলেছেন- ” ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ “
হে প্রিয় উম্মাহ! তোমার মূমুর্ষতাকে জাগাতে হবে চেতনার বহ্নিশিখায়। তোমার প্রজন্মকে জানিয়ে দিতে হবে সকল স্মৃতিমাখা ইতিহাস। জানাতে হবে হিজরতের আনন্দাশ্রুর স্মৃতি। মাদীনা শহরে মুনীবের প্রত্যাবর্তন স্মৃতি। আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাত ওয়াস সালামের ঐতিহাসিক পটভূমি। কলিজা জখম করা কারবালার স্মৃতিমাখা করুণ কাহিনী।
জানাতে হবে। স্মরণ করতে। চির স্মরনীয় রাখতে হবে সবগুলোকেই। সাংঘর্ষিকতার অভিযোগকে উপেক্ষা করেই।
মুমীনের আনন্দ। মুমীনের বিরহ। মিশে একাকার হোক মুহররমে। খুঁজে পাক, আনন্দের মাঝেই মহাত্যাগের মর্মদীক্ষা। খুঁজে পাক, শাহাদাতের মাঝেই শহিদি ঈদের চেতনা। এরকম একটি বৈপ্লবিক শুরু ছাড়া তো বিপ্লব আসবেনা…
বিপ্লব প্রেমের।
বিপ্লব সত্যের।
বিপ্লব ন্যায়ের।
বিপ্লব ঈমানের।
বিপ্লব চেতনার।
বিপ্লব ত্যাগের।
যেমন মরমী কবি, নাবীপ্রেমিক শায়খ মানযূর আহমাদ বলেছেন – “ত্যাগ দিয়ে শুরু হয় মু’মীনের যত সব। মুহররম তাই আজ, ঈমানের উৎসব”…