একটা বাবার বাড়ি, একটা স্বামীর বাড়ি। মেয়েদের নিজের বাড়ি কোনটা? যদিও নারী পুরুষ সবার বাড়িই অস্থায়ী, আসল বাড়ি ওপারে। তবু মনে একটা কষ্টকর ভাব- ‘আমার কোনো বাড়ি নেই।’
আসলেই কি তাই?
আসলে কিন্তু তা নয়।
প্রথমত: বাবা যে বাড়িটা তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন ওই বাড়িতে দুইভাগের এক অংশ আমার আছে উত্তরাধিকার সুত্রে। অথচ না আমি ওখানে থাকছি আর না আমার প্রয়োজন আছে।
দ্বিতীয়ত: স্বামীর বাড়ি। স্বামী শুধু নামেই মালিক। ঘরটা কিন্তু আমার। একটা ঘর ততক্ষণ পর্যন্ত ঘর হয় না যতক্ষণ না একজন নারীর ছায়া পড়ে। এ তো গেল সাধারণ দৃষ্টিপাত। এবার দেখুন কুরআনের দৃষ্টিপাত।
কুরআনে যেখানেই আল্লাহ স্ত্রী আর ঘরের কথা বলেছেন, আল্লাহ বলেছেন স্ত্রীর ঘর।
ইউসুফ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে যখন আল্লাহ তাআলা আলোচনা করেছেন, তখন বলেছেন,
وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَن نَّفْسِهِ
যে নারীর ঘরে তিনি থাকতেন, সে তাকে ফুসলানোর চেষ্টা করলো। [ইউসুফ: ২৩]
আল্লাহ বলেননি যে শাসকের ঘরে তিনি থাকতেন তার স্ত্রী আসলে তো ইউসুফ আলাইহিস সালাম থাকতেন আযীযে মিশরের ঘরেই।
আবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের আল্লাহ বলছেন,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ
তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করো। সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হতো। [আহযাব : ৩৩]
বলা হয়নি স্বামীর গৃহে অথবা বাবার গৃহে অবস্থান করো।
আবার যখন স্বামী স্ত্রীর ঝগড়াঝাটি মান অভিমান হয়, এমনকি ব্যাপারটা তালাক পর্যন্ত গড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়; তখনও আল্লাহ বলছেন স্ত্রীর ঘর।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ رَبَّكُمْ ۖ لَا تُخْرِجُوهُنَّ مِن بُيُوتِهِنَّ
হে নবী, আপনারা যখন নারীদেরকে তালাক দেন, তখন তাদেরকে তাদের ইদ্দতের সময়ে তালাক দিবেন এবং ভালোভাবে ইদ্দতের হিশেব রাখবেন এবং আল্লাহকে ভয় করবেন, যিনি আপনাদের প্রতিপালক। তাদেরকে ‘তাদের ঘর’ থেকে বের করে দিবেন না। [তালাক: ১]
এমনকি যখন স্ত্রী পরকিয়া ব্যভিচারের মতো অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়, তখনও আল্লাহ স্বামীকে বলছেন না, তোমার ঘরে তাকে আবদ্ধ রাখো। বরং কারো সাথেই সম্পৃক্ত না করে ঘরের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো স্ত্রীর কাছ থেকেও ‘ঘরটা স্ত্রীর’ এই সম্মান কেড়ে নিয়েছেন। অশ্লীল কাজ করে ফেলার নিয়তের পরও আযিযে মিশরের স্ত্রীর ব্যাপারে ‘স্ত্রীর ঘর’ বলেছেন। যেহেতু সেই মহিলা কাজটা করেনি। কিন্তু যখন কেউ অশ্লীল কাজ করে ফেলে তখন আল্লাহর দেয়া ওই সম্মান হারিয়ে ফেলে।
আল্লাহ তখন ঘরকে কারো সাথেই সম্পৃক্ত না করে বলছেন,
وَاللَّاتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِن نِّسَائِكُمْ فَاسْتَشْهِدُوا عَلَيْهِنَّ أَرْبَعَةً مِّنكُمْ ۖ فَإِن شَهِدُوا فَأَمْسِكُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ حَتَّىٰ يَتَوَفَّاهُنَّ الْمَوْتُ أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا
তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা অশ্লীল কাজ করবে, তাদের সম্পর্কে তোমাদের মধ্য হতে চারজন সাক্ষী রাখো। তারা যদি [অশ্লীল কাজ সম্পর্কে] সাক্ষ্য দেয়, তবে তাদেরকে ঘরের ভেতর আবদ্ধ রাখ, যাবত না মৃত্যু তাদের তুলে নিয়ে যায় কিংবা আল্লাহ তাদের জন্যে কোনও পথ সৃষ্টি করে দেন।[নিসা : ১৫]
কিন্তু যতক্ষণ না স্ত্রী কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেলে এবং চারজন সাক্ষী পাওয়া যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ঘরকে স্ত্রীর ঘর বলেছেন। আর এমন ঘটনা ঘটলে তো স্বাভাবিক যে, নারী-পুরুষ কারো ক্ষেত্রে ঘটলেই সম্মান দেয়া সম্ভব হয় না।
এই ব্যাপার ছাড়া দেখা যাচ্ছে ঘরের মালিকানা স্বামীর থাকলেও আল্লাহ বলছেন ঘরটা স্ত্রীর ঘর। আল্লাহ প্রদত্ত এই সম্মানের পরও মনে হীনমন্যতা রাখা উচিত নয় যে, আমাদের কোনো ঘর নেই। আর কোনো পুরুষেরও উচিত নয়, ঝগড়া হলে সামান্য দোষে কথায় কথায় স্ত্রীকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলা, বাপের বাড়ি চলে যেতে বলা, ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা সূরা তালাকের আয়াতে তালাকের সময়ও অমনটা করতে সরাসরি নিষেধ করে দিচ্ছেন এবং বলছেন আল্লাহকে ভয় করুন।
সুতরাং স্ত্রীর ঘরটা স্ত্রীর জন্য প্রশান্তিময় করে তুলুন। ঝগড়া হলে রাগ হলে হযরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো আপনি বনবাসী হোন কিন্তু স্ত্রীকে সুকুনের সাথে তার ঘরে থাকতে দিন। তখন দেখবেন ব্যাপারটা হবে আলি হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার মতোই মিষ্টি! ওই যে হযরত আলি রাগ করে মসজিদে গিয়ে শুয়ে পড়লেন, আবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গিয়ে ঘটনা শুনে মেয়েকে বললেন না, কাপড় গোছাও আর চলে আসো। বরং জামাইকে খুঁজতে বের হলেন এবং দেখলেন জামাই বাবাজি মাটিতে শুয়ে আছেন। আদর করে বললেন, ‘ওহে আবু তুরাব! হে মাটির পিতা, উঠো উঠো!’ পরবর্তীতে এই উপাধিই হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সবচেয়ে প্রিয় ছিল। ‘আবু তুরাব -মাটির পিতা।’
কিন্তু যদি হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাগ করে হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বলতেন, বাপের বাড়ি চলে যাও। ঘর থেকে বের করে দিতেন, নবীজি কত কষ্ট পেতেন, ব্যাপারটা কত বিশ্রী হয়ে যেত!
ঘরের রানীকে ঘরেই রাখুন। ঘরটা তারই এটাই বরং জানিয়ে রাখুন। আবার বোনরাও জানবেন, স্বামী বলুক আর না বলুক, আল্লাহ তো বলছেন আপনার ঘর। অস্থায়ী এ ঘর নিয়ে মন খারাপ তবে কেনই বা হবে!
তারপরও কারো কথায় কষ্ট হলে বলবেন ফেরআউনের স্ত্রীর সেই দুআ : رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ
“হে আমার পালনকর্তা! আপনার কাছে জান্নাতে আমার জন্য একটি ঘর তৈরি করুন।”
ব্যস কষ্টের সিন্ধু তো দূর বিন্দুও থাকবে না আর।