এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আপনাকে যেতে হবে ইতিহাসের এক নীরব কোণে। সমরকন্দের ভূমিতে ইমাম আবু মানসুর আল-মা‘তুরিদি (رحمه الله)’র চিন্তার জগতে।
কিছু মানুষ ইতিহাসে প্রবেশ করেব আলো জ্বালাতে, আর কিছু মানুষ প্রবেশ করেন অন্ধকার শনাক্ত করে তার মানচিত্র এঁকে দিতে। ইমাম আবু মানসুর আল-মা‘তুরিদি (رحمه الله) ছিলেন দ্বিতীয় সারির একজন। যিনি জানতেন আলো দেখানোর আগে মানুষকে অন্ধকার চিনতে শেখাতে হয়।
ইসলামের ইতিহাসে তার নাম খুব জোরে উচ্চারিত হয় না। কোন আবেগঘন কিচ্ছা নেই, নেই অলৌকিকতার গল্প। কিন্তু আপনি যদি মুসলিম চিন্তার গভীরে অনুসন্ধান করেন। যেমন তাওহিদ, কুদরত, তাক্বদির, আক্বল ও ওয়াহি’র সম্পর্ক। তবে দেখবেন অদৃশ্য এক স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। নাম লেখা নেই ফলকে, কিন্তু ছাদ টিকে আছে তার ওপর।
তৃতীয় হিজরি শতাব্দি। এক অদ্ভুত সময়। মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, কিন্তু বৌদ্ধিকভাবে বিভক্ত। গ্রিক দর্শনের অনুবাদ হচ্ছে অ্যারিস্টটল ঢুকে পড়ছে মসজিদে, যুক্তি বসছে মিম্বরে। একদল বলছে, যুক্তিই শেষ কথা। আরেক দল বলছে, যুক্তি হারাম; প্রশ্নই কুফর।
একদিকে মু‘তাযিলা সম্প্রদায়, যারা আল্লাহ ﷻ’র গুণাবলিকে কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলে বলছে: “আল্লাহ শোনেন না, দেখেন না। এসব মানবীয় কল্পনা।” আরেকদিকে হাশভিয়া, যারা বলছে, “আল্লাহ আসমানে বসে আছেন, আমাদের মতোই। শুধু একটু বড়।”
এই দুই প্রান্তের মাঝখানে পড়ে সাধারণ মুসলিম। ইমান রাখতে চায়, কিন্তু মাথা কাজ করে। প্রশ্ন আসে, সংশয় আসে।
এইখানেই ইতিহাসের মঞ্চে প্রবেশ করেন সমরকন্দের এক নীরব আলিম ইমাম মা‘তুরিদি।
ইমাম মা‘তুরিদি স্লোগান দেননি। কাউকে কাফির ঘোষণার হিড়িকেও নামেননি। তিনি যা করলেন, তা আরও কঠিন। চিন্তাকে শুদ্ধ করলেন। বললেন, “যুক্তি আল্লাহ ﷻ’র দান। আর আল্লাহ নিজের দান দিয়ে নিজের ওয়াহি ধ্বংস করেন না।”
তিনি দেখালেন, আক্বল (বুদ্ধি/যুক্তি) ও ওয়াহি শত্রু নয়। আক্বল পথ দেখায়, ওয়াহি গন্তব্য নির্ধারণ করে। আকল প্রশ্ন তোলে, ওয়াহি উত্তর দেয়।
মু‘তাযিলারা বলেছিল, ভাল-মন্দ পুরোপুরি আক্বল দিয়ে জানা যায়। ইমাম মা‘তুরিদি বললেন, “না। আক্বল নৈতিকতার বীজ চিনতে পারে, কিন্তু শরি’আহ্ ছাড়া সে পূর্ণ বৃক্ষ পায় না।”
হাশভিয়ারা বলেছিল, প্রশ্ন করো না। তিনি বললেন, যে ইমান প্রশ্ন সহ্য করতে পারে না, সে ঈমান টেকে না।
আল্লাহ ﷻ কি মিথ্যা বলতে পারেন?
এই প্রশ্ন আজ নতুন মনে হয়। কিন্তু ইতিহাসে তা বহুবার ইমান কাঁপিয়েছে।
ইমাম মা‘তুরিদি বললেন, এই প্রশ্নই ভুল। কারণ মিথ্যা কোনো ক্ষমতা নয়। এটা ত্রুটি। আর আল্লাহ ত্রুটিমুক্ত।
তিনি বললেন, আগুন কি ঠান্ডা হতে পারে? না। সেটা আগুনের সীমাবদ্ধতা নয়, বরং আগুনের পরিচয়। তেমনি, সত্য আল্লাহর পরিচয়। মিথ্যা তার অক্ষমতা নয়, বরং তার পবিত্রতা।
এই একটি যুক্তি দিয়ে তিনি শত প্রশ্নের শিকড় কেটে দেন।
একদল বলল, সব আল্লাহই করেন, মানুষ কিছুই না। আরেকদল বলল, মানুষই করে সব, আল্লাহ কেবল দর্শক।
ইমাম মা‘তুরিদি বললেন, দুটোই ভুল।
আল্লাহ সৃষ্টি করেন কর্মের ক্ষমতা। মানুষ বেছে নেয়। তাই সে দায়ী। যদি মানুষ পুতুল হতো, বিচার অর্থহীন হতো। আর যদি আল্লাহ ক্ষমতাহীন হতেন, তবে তিনি রব হতেন না।
এই ভারসাম্যটাই সুন্নি আকিদার মেরুদণ্ড।
তাকে আমরা চিনি না। কারণ তিনি আবেগ বিক্রি করেননি। দর্শন লিখেছেন, স্লোগান না। তিনি বাঁচাতে চেয়েছেন চিন্তা, দল নয়।
অথচ আজ তুরস্ক, মধ্য এশিয়া কিংবা দক্ষিণ এশিয়া। এই বিশাল ভূখণ্ডের সুন্নি আকিদার বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি মা‘তুরিদি। আপনি হানাফি হলে, আপনি জানুন বা না জানুন, আপনার ইমানের যুক্তিগত কাঠামোতে তিনি আছেন।
ইমাম মা‘তুরিদি আমাদের শেখান, ইমান মানে বুদ্ধি জমা রাখা নয়। ইমান মানে বুদ্ধিকে সঠিক জায়গায় ব্যবহার করা। আজ যখন নাস্তিকতা প্রশ্ন তোলে, আর ধর্মান্ধতা প্রশ্ন দমাতে চায়। ইমাম আমাদের শেখান, দুই প্রান্তই বিপজ্জনক।
তিনি কোনো কোলাহল তোলেননি। কিন্তু তার নীরবতা আজও কথা বলে। যে শুনতে জানে, তার জন্য এই নীরবতাই যথেষ্ট।





Users Today : 2629
Users Yesterday : 1060
This Month : 10264
This Year : 182135
Total Users : 297998
Views Today : 25163
Total views : 3546223