উসূলে ফিকহে আ’লা হজরতের যুগান্তকারী অবদান

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

উসূলে ফিকহে আ’লা হজরতের যুগান্তকারী অবদান

——————————————

পবিত্র হাদিস শরীফে সহীহ সনদে এসেছে যে, 

‎عن أبي هريرة رضي الله عنه عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أنه قال :

‎ إِنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا 

হজরত আবু হোরায়রা (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, হুজুর রাসূলুল্লাহ  ﷺ বলেছেন, “নিশ্চই আল্লাহ পাক প্রতি শতাব্দীর শেষে এই উম্মতের জন্য এমন কাউকে প্রেরন করেন, যিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে সংস্কার করেন।”(তথ্যসূত্র: সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং- ৪২৯১) 

উপরোক্ত হাদিসখানার বিশুদ্ধতা নিয়ে মোহাদ্দীসীনে কেরামগনের মধ্যে বিতর্ক নাই বললেই চলে। কাজেই একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তাআলা প্রতি 

শতাব্দীতে মোজাদ্দীদ বা দ্বীনের সংস্কারক পাঠান যিনি ইসলামকে সংস্কার করেন এবং দ্বীনকে পূনর্জীবন দান করেন। 

তারই ধারাবাহীকতায় তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর প্রদেশের বেরেলী শরীফে আগমন করেন চতুর্দশ হিজরী শতকের মোজাদ্দীদ ইমামে আহলে সুন্নাত মোজাদ্দিদে দ্বীনও মিল্লাত আ’লা হজরত ইমাম শাহ্ আহমাদ রেজা খান ফাজিলে বেরেলভী (রাহ:)(ওফাত ১৯২১ খ্রী:, ১৩৪০ হিজরী সন)। তাঁর যুগে ওয়াহাবী ও লা-মাজহাবী মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওলী-আউলিয়াগনের পদধুলি ধন্য, সুন্নী ও সুফিগনের ঐতিহ্যমন্ডিত ভারতীয় উপমহাদেশে সৌদী আরব থেকে আমদানীকৃত ওয়াহাবী মতবাদ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে।  আলা হজরত তাঁর ক্ষুরধার লিখনীর মাধ্যমে কুরআন-হাদিসের দলিল ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে ওয়াহাবী মতবাদকে খন্ডন করে বাতিল প্রমান করেন। মূলত: তাঁর প্রচেষ্টার কারনে ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়াহাবী মতবাদ ততটা বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। তিনি কাদিয়ানী, দাহরিয়া ও শিয়া মতবাদের অসাড়তাও প্রমান করেন। তরিকত ও তাসাউফের মূল শিক্ষাও তিনি মানুষের কাছে তুলে ধরেন। 

    তবে আমরা শুধুমাত্র তাঁর আকীদাগত সংস্কার নিয়েই বেশি আলোচনা করি যা খুবই দু:খজনক। অথচ জ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে এই মহামনীষীর বিচরন ছিল না। তাঁর তাজদীদের ক্ষেত্র অনেক সূদুরপ্রসারী। তেমনি উসুলে ফিকহেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। গত ১২০০ বছরে যে বিষয়ে সমাধান পাওয়া যায়নি তেমন একটি বিষয়ে সমাধান দিয়ে গেছেন আলা হজরত রাহ:। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ইলম এক জিনিস আর হিকমত অন্য জিনিস। ইলম হচ্ছে কোন কিছুর হুকুম  সম্পর্কে জানা, আর হিকমত হচ্ছে কোনকিছু সম্পর্কে জেনে শরীয়তে এই জিনিসের অন্তর্ভুক্তির অথবা নিষেধাজ্ঞার পেছনের কারন(মাকাসিদুস শারীয়াহ) থেকে শুরু করে এই কাজের আদ্যোপান্ত সব জানা এবং সেই জিনিস সমাজে প্রতিষ্ঠারও ব্যবস্থা করা। একজন আলিম ততক্ষন পর্যন্ত মুজাদ্দিদ হতে পারবেন না যতক্ষন না তিনি হিকমতওয়ালা হবেন।

 যেমনটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন,

‎وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا ۗ

এবং যাকে প্রজ্ঞা(হিকমত) দান করা হয়, সে প্রভুত কল্যাণ প্রাপ্ত হয়। (আল-কুরআন, ২:২৬৯)

আলা হজরত (রাহ:) ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ আলীমে দ্বীন যা তাঁকে চতুর্দশ হিজরী শতকের মুজাদ্দিদে পরিনত করে। আল্লাহ যাদের দ্বারা তাঁর দ্বীনকে পূনরুজ্জীবিত করেন তাঁদের পাঁচটি স্তর রয়েছে, ১.মুসলিহ ২.হাকিম ৩.মুজতাহিদ ৪.মুজাদ্দিদ এবং ৫. মুফহিম (প্রথমোক্ত এই চার স্তরের সকল গুণ যার মধ্যে সন্নিবেশিত হয়ে যায় তিনি হয়ে যান মুফহিম) আর  আলা হজরত  উসুলে ফিকহ (Principles of Islamic Law & Jurisprudence) এবং ফিকহের (Islamic Law & Jurisprudence) ক্ষেত্রে তাহকিক, তাখরিজ, তাত্ববিক যেকোন দৃষ্টিকোন থেকে যেই কাজ করেছেন  তা গত ৫-৬ শতাব্দীতে হয় নাই। 

আলোচনা করতে গেলে তা বিশাল লম্বা আলোচনা যা একটি ডক্টরেটের থিসিসেও পুরোপুরি আসবে না। তবে উসূলে ফিকহে তাঁর নির্দিষ্ট একটি বিশাল অবদানের কথাই শুধু আজ আলোচনা করব। উসুলে ফিকহে আহকামে খামছা, সাবআহ ও তিসআর একটি ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। এই আহকামে খামছা আসলে কি জিনিস? তা হচ্ছে ইসলামী শরীয়তের যত হুকুম আহকাম আছে সেগুলোকে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, মাকরুহ, মোবাহ ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা। কোন আমলটির হুকুম কি তার শ্রেণি বিভাগগুলোই হচ্ছে এই  আহকামে খামছা/সাবআহ/তিসআ। উসুলে ফিকহের বড় বড় কিতাবগুলোতে এই আলোচনা এসেছে। মুসাল্লামুস সুবুতের মত পুরাতন উসূলে ফিকহের কিতাবগুলোতে এগুলোকে পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা: ১.ওয়াজিব, ২.সু্ন্নাত বা মানদুব ৩.হারাম ৪.মাকরুহ এবং  ৫.মুবাহ। অত:পর  ফুসুলে বাদায়ি ও মিরকাতুল উসুলসহ মধ্যযুগের কিছু কিতাবে আরো দুটো স্তর যোগ করা হয়েছে, ১.ফরজ,২.ওয়াজিব ৩.সু্ন্নাত ৪.মুস্তাহাব ৫.হারাম ৬.মাকরুহ এবং ৭.মুবাহ। অত:পর উসুলে ফিকহের যখন আরো ডেভলপমেন্ট হলো তখন উসুলবিদগণ ৭ থেকে সেটাকে ৯ তে উন্নীত করেন। জায়েজ কাজগুলোর জন্য পাঁচটি স্তর: 

আদেশসূচক                 নিষেধসূচক

১.ফরজ                         ১.হারাম                         

২.ওয়াজিব                     ২.মাকরুহে তাহরিমি 

৩.সু্ন্নাতে মুআক্কাদা            X

৪.সু্ন্নাতে জায়েদা          ৩.মাকরুহে তানজিহী

৫.মুস্তাহাব বা নফল।           X

৬.মুবাহ                       ৪.মুবাহ 

ফরজের বিপরীতে হারাম, ওয়াজিবের বিপরীতে মাকরুহে তাহরিমী,  সুন্নাতে জায়েদার বিপরীতে  মাকরুহে তানজিহি। লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, এই নয় আহকামের মধ্যে আদেশসূচক ও নিষেধসূচক স্তরগুলোর একটি অপরটির বিপরীতে এসেছে। আর মুবাহ আদেশসূচক ও নিষেধসূচকের মধ্যে কমন হুকুম যাতে গোনাহও নেই সওয়াবও নেই। কিন্তু সুন্নাতে মুআক্কাদা ও নফল বা মুস্তাহাবের বিপরীতে নিষেধসূচক কোন হুকুমের স্তর পাওয়া যায় না। ইসলামের  ইতিহাস ঘাটলে আপনি এই ৯ স্তরের বেশি হুকুম পাবেন না। 

আমি যখন উসুলে ফিকহ ও ফিকহের কিতাবে এই বিষয়টি লক্ষ্য করলাম তখন আমার কাছে এটি খুব হয়রানের বিষয় মনে হলো। আদেশসূচক কাজের ৫টি স্তরই আছে অথচ এর বিপরীতে নিষেধসূচক কাজের স্তর মাত্র ৩টি যা অপূর্নাঙ্গ একটি বিষয়। কথা যখন হচ্ছে ইসলামি শরিয়ত নিয়ে সেখানে এই অপূর্নতা কিভাবে থাকে!

 নতুন পুরাতন কোন কিতাবে এই বিষয়ের একাডেমিক ডিসিপ্লিনারী সমাধান নেই। অবশেষে আমি আলা হজরত আজীমুল বারাকাত ইমাম আহমদ রেজা খান বেরেলভী (রাহ:) এঁর বিখ্যাত কিতাব “ফাতাওয়ায়ে রেজভিয়া”র ভূমিকা বা ১ম খন্ড হাতে নিলাম এবং উনার একটি ছোট রিসালা পেলাম “মাসসুল ইয়াদাইন ফিস সুন্নাতি ওয়াল মুসতাহাব্বি ওয়াল মাকরুহাইন” নামে, সেখানে দেখলাম যে তিনি বলছেন, “ আহ্কামে শরীয়তকে এই নয়টি মাত্র স্তরে সীমাবদ্ধ করে ফেললে তা পরিপূর্ন হয় না।আদেশসূচক ৫টি স্তরের বিপরীতে নিষেধসূচক ৫টি স্তর আসে না।” তাই তিনি আরো দুটো নতুন স্তরের হুকুম নিয়ে আসেন। এই নতুন দুটো স্তরের ধারনা ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন কিতাবাদিতে হয়ত উল্লেখ ছিল অগোছালোভাবে, কিন্তু কোন উসুলে  ফিকহের কিতাবে স্পষ্টভাবে আভিধানিক ডিসিপ্লিনারি টার্মিনোলোজি হিসেবে আসে নাই, যা তিনি নিয়ে আসেন এবং বলেন, 

আদেশসূচক                    নিষেধসূচক

১.ফরজ                           ১.হারাম                         

২.ওয়াজিব                       ২.মাকরুহে তাহরিমি 

৩.সু্ন্নাতে মুআক্কাদা          ৩.ইসাআত 

৪.সু্ন্নাতে জায়েদা              ৪.মাকরুহে তানজিহী

৫.মুস্তাহাব বা নফল।        ৫.খেলাফে আওলা 

৬.মুবাহ                           ৬.মুবাহ 

সুন্নাতে মুআক্কাদার বিপরীতে ইসাআত (মন্দ কাজ) এবং মুস্তাহাব বা নফলের বিপরীতে খেলাফে আওলা (দুটো ভাল আমলের মধ্যে অধিক পছন্দনীয় কাজের বিপরীত আমল করা) এই দুটো আভিধানিক শ্রেণিবিন্যাস এভাবেই ইসলামী আহকামে 

শরীয়তের স্তরগুলোকে আদেশ ও নিষেধসূচক কাজে উভয়পক্ষে সমান করে। এভাবেই আলা হজরত উসুলে ফিকহ শাস্ত্রেও তাঁর তাজদিদ বা সংস্কার কাজ  সম্পন্ন করেন।

(শায়খুল ইসলাম আল্লামা প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ তাহিরুল কাদেরি (মা জি আ)র লেকচার অবলম্বনে

সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী

প্রিন্সিপাল ও ম্যানেজিং ডাইরেক্টর

লিবারেল ইসলামিক স্কুল, ঢাকা (LISD), কে-১০, দক্ষিন বনশ্রী, খিলগাঁও, ঢাকা।

খতিব, শান্তিপুর জামে মসজিদ, দক্ষিন গোরান, ঢাকা।)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment