ঈদুল আজহার বহুমাত্রিক তাৎপর্য
মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আজহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। উৎসব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা। তাই ঈদ শুধু আনন্দের উৎস নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এলাকার লোকেরা ঈদের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সবার মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে- ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। এর ফলে ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়স্বজন- সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। ঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে। ঈদুল আজহায় যে কোরবানি দেওয়া হয়, তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কোরবানির রক্ত-মাংস কখনোই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। শুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়কে। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন।
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন প্রিয়তম বস্তু তথা তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করার জন্য। সেই অনুযায়ী তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয়পুত্রকে কোরবানি দিতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁকে আর শেষ পর্যন্ত পুত্রকে কোরবানি দিতে হয়নি। ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানি হয় একটি পশু। মহান আল্লাহর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। এই সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমাকে তুলে ধরাই ঈদুল আজহার পশু কোরবানির প্রধান মর্মবাণী।
সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, মুকিম (মুসাফির নয় এমন ব্যক্তি) ব্যক্তিই ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব (সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সেই পরিমাণ নগদ অর্থ) পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য জাকাতের নিসাবের মতো সম্পদের এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। বরং যে অবস্থায় সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়, ওই অবস্থায় কোরবানিও ওয়াজিব হবে।
কোরবানি আরবি শব্দ। কুরবানুন শব্দ থেকে কুরবুন নির্গত- যার অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন, ত্যাগ ইত্যাদি। কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২- এই তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবেহ করাই হলো কোরবানি। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করাই কোরবানির তাৎপর্য।
কোরবানির এ ফজিলত হাসিল করতে হলে প্রয়োজন সেই আবেগ, অনুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা ও ঐকান্তিকতা, যা নিয়ে কোরবানি করেছিলেন আল্লাহর খলিল হজরত ইব্রাহিম (আ.)। কেবল গোশত ও রক্তের নাম কোরবানি নয়; বরং আল্লাহর রাহে নিজের সম্পদের একটি অংশ বিলিয়ে দেওয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কোরবানি। গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালার কাছে গোশত ও রক্তের কোনো মূল্য নেই। মূল্য আছে কেবল তাকওয়া, পরহেজগারি ও ইখলাসের। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে কখনো জবেহকৃত পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছবে না, পৌঁছবে কেবল তাকওয়া। (সুরা হজ, আয়াত ৩)।
অতএব, আমাদের একান্ত কর্তব্য, খাঁটি নিয়ত সহকারে কোরবানি করা এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জন করা। নিজেদের আনন্দে অন্যদের শরিক করা ঈদুল আজহার শিক্ষা। কোরবানিকৃত পশুর গোশত তিন অংশে ভাগ করে এক অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ, দ্বিতীয় অংশ আত্মীয়স্বজনকে প্রদান এবং তৃতীয় অংশ সমাজের অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া ইসলামের বিধান। কোরবানিকৃত পশুর চামড়া অনাথ আশ্রম, এতিমখানা ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণের জন্য প্রদান করলে দ্বিবিধ সওয়াব হাসিল হয়। এক দুঃখী মানুষের সাহায্য দ্বিতীয় দ্বীনি শিক্ষার বিকাশ। প্রকৃতপক্ষে কোরবানিদাতা কেবল পশুর গলায় ছুরি চালায় না; বরং সে তো ছুরি চালায় সব প্রবৃত্তির গলায় আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে। এটিই কোরবানির মূল নিয়ামক ও প্রাণশক্তি। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কোরবানি করা হয়, তা হজরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর সুন্নাত নয়, এটা এক রসম তথা প্রথা মাত্র। এতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে; কিন্তু ওই তাকওয়া হাসিল হয় না, যা কোরবানির প্রাণশক্তি।
কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা আমাদের কাছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতিবছর উপস্থিত হয়। ঈদুল আজহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সব পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার ও রিপুর তাড়না বা শয়তানের অসওয়াসা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হব। তাই ঈদুল আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুকেই কোরবানি দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কোরবানির মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। আমরা চাই ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সব অনিশ্চয়তা-শঙ্কা দূর হোক। হিংসা, হানাহানি ও বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একসঙ্গে এক কাতারে পবিত্র ঈদুল আজহার আনন্দে শামিল হয়ে সবার মধ্যে সাম্য ও সহমর্মিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলতে হবে



Users Today : 11
Users Yesterday : 1258
This Month : 11936
This Year : 151413
Total Users : 267276
Views Today : 32
Total views : 3223397