এখানে উল্লেখ্য যে, ক্ষেত্র বিশেষে আহলে সুন্নাতও ‘ইমাম’ এবং ‘ইমামত’ শব্দ দু’টি ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা অবশ্য এগুলো এ অর্থে ব্যবহার করেন যে, ‘ইমাম’ হলেন ধর্মীয় ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। আর ইমামত হচ্ছে ইমামের বিশেষ যোগ্যতা বা পদবী। ধর্মীয় বিষয়াদিতে অগাধ দক্ষতা ও পান্ডিত্যের অধিকারী ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল এবং সাহাবা কেরামের নির্দেশিত পথের দিশারী হন এবং ধর্মীয় জটিল বিষয়াদির সমাধান দিতে যিনি সক্ষম হন- তাঁকেই আহলে সুন্নাতের পরিভাষায় ‘ইমাম’ বলে। এহেন অর্থের ভিত্তিতে ‘ইমাম’ শব্দটি আপন অর্থে যথার্থ। এটা ‘নবী’, ‘সাহাবী’ অথবা ‘খলীফা’ কোনটার মর্যাদার সাথে আদর্শগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। তাই সেটার ব্যবহার এ অর্থে আপত্তিকরও নয়।
কিন্তু ‘ইমামত’ বা ‘ইমাম’ শব্দ দু’টু নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে গিয়ে শিয়া সম্প্রদায় যে সুন্নী মতাদর্শের গন্ডী থেকে বেরিয়ে বহুদূরে এক মারাত্মক ও ভ্রান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তাই, ইমামত সম্পর্কে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী নিম্নে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেলামঃ
‘ইমামত’ সম্পর্কে তাদের (মনগড়া ও ভ্রান্ত) আক্বীদা বা বিশ্বাসকে শিয়া ধর্মের মৌলিক বিষয় বলা যায়। তাদের মতে, যেভাবে আল্লাহ্র তরফ থেকে নবীগণ (আলায়হিমুস্ সালাম) প্রেরিত হতেন, অনুরূপভাবে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর ইমামদেরকেও নাকি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রেরণ করা হয়। তাঁর শিয়াদের আক্বীদা বা ধর্ম বিশ্বাসানুসারে, ওই ইমামগণও নাকি শরীয়তের বিধি-বিধান প্রবর্তন করতে পারেন। সর্বোপরি, তাঁরা নাকি ক্বোরআন করীমেরও যেকোন নির্দেশকে তাদের ইচ্ছানুসারে রহিত কিংবা অকার্যকর করতে পারেন। (না‘ঊযুবিল্লাহ্)
মোটকথা, শিয়াদের মতে, ইসলামী আক্বীদায় যেই অর্থ, যেই গুরুত্ব ও মর্যাদা একজন স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত প্রবর্তক নবী ও রসূলের রয়েছে, একই অর্থ, তাৎপর্য ও মর্যাদা তাদের ‘ইমামে মা’সূম’ (নিষ্পাপ ইমাম)-এরও রয়েছে। (সুম্মা না‘ঊযুবিল্লাহ্)
বলাবাহুল্য যে, এ অর্থেই শিয়ারা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও তাঁর বংশধরগণকে ‘ইমাম’ বলে থাকে, যা সম্পূর্ণ অনৈসলামিক ও কুফরী আক্বীদা বৈ আর কিছুই নয়। আরো উল্লেখ থাকে যে, শিয়ারা এমনি বাতিল ও ঈমান বিধ্বংসী ‘আক্বীদা’র (!) জন্ম দিয়েছে ‘গদীর-ই খোম’-এর ঘটনার অপব্যাখ্যা দিয়ে। সুতরাং শিয়াদের সাথে সুর মিলিয়ে যারা এ দেশে ওই দিবসটি উদ্যাপন করে তাদের স্বরূপ অতি সহজে উম্মোচিত ও স্পষ্ট।
================================================================================
ঐতিহাসিক বিদায় হজ্ব সমাপন করে আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা তৈয়্যবায় পুনরায় তাশরীফ নিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে ‘গদীর-ই খোম’ নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। এখানে হুযূর আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা কেরামের উদ্দেশ্যে যেসব ঐতিহাসিক বরকতময় নসীহত করেছিলেন তন্মধ্যে আহলে বায়ত, বিশেষ করে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে কৃত বিশেষ নসীহত ছিলো অন্যতম। বস্তুতঃ এ নসীহত ছিলো হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিশেষ মর্যাদার প্রতি সাহাবা কেরাম তথা বিশ্ববাসীকে সজাগ করা এবং তাঁর প্রতি ভালবাসাকে সর্বদা অটুট রাখার গুরুত্বকে বিশেষভাবে প্রকাশ করা, যেভাবে অন্যান্য স্থানে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব, হযরত ওমর ফারুক্ব, হযরত ওসমান এবং অন্যান্য সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)-এর মর্যাদার কথা এরশাদ ফরমায়েছেন। তাছাড়া, ওই নসীহতের পেছনে বিশেষ একটা প্রেক্ষাপটও রয়েছে। ওই নসীহত নিঃসন্দেহে এ জন্যই ছিলো না যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সেদিন ‘ইমাম’ হিসেবে ঘোষণা করবেন। কারণ, যেই প্রেক্ষাপটে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর প্রতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন এবং যেই বরকতময় শব্দগুলো তিনি এরশাদ ফরমায়েছেন- তার কোনটা থেকে হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)কে ‘ইমাম’ বলে ঘোষণা করার অর্থ প্রকাশ পায়না। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও মনগড়াভাবে, হঠকারিতা করে একটি সম্প্রদায় সেই ‘গদীর-ই খোম’-এর ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এমন সব ভ্রান্ত আক্বীদা বা বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, যেগুলোকে ইসলামের কোন মুহাদ্দিস বা ফক্বীহ্ কিংবা ইমামই গ্রহণ করেননি; বরং প্রত্যাখ্যানই করেছেন। কারণ, উক্ত সম্প্রদায়ের উক্ত অপব্যাখ্যা বস্তুতঃ ইসলামের মূলনীতিতে কুঠারাঘাত করেছে এবং ইসলামের ইস্পাত কঠিন ঐক্যে চির ধরিয়ে নতুন এক ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে তাদেরকে পথভ্রান্ত ও ঈমানহারা করার প্রয়াস পেয়েছে।
দুঃখের হলেও সত্য যে, বর্তমানে আমাদের দেশেও উক্ত সম্প্রদায়টি তাদের অন্ধ অনুসারীদের মাধ্যমে এদেশেও ওই ভ্রান্ত আক্বীদা প্রচারের প্রয়াস চালাচ্ছে। এ দেশের পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি-সংবাদ দিয়ে ‘গদীর-ই খোম’ দিবস পালন করে আসছে। তাই, ‘গদীর-ই খোম-এর সঠিক ঘটনা ও সেটার প্রেক্ষাপটও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এ লেখা।
সুতরাং আমি আমার এ পুস্তিকায় ঐতিহাসিক ‘গদীর-ই খোম’-এর সঠিক ঘটনা তুলে ধরে সেটার আসল তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেলাম, যাতে একদিকে সুন্নী মুসলমানগণ আসল ব্যাপার জানতে ও বুঝতে পারেন, আর অন্যদিকে চিহ্ণিত হয় ওই সম্প্রদায় ও তাদের দোসরদের আসল স্বরূপ।
ঘটনা
হযরত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন পথিমধ্যে ‘গদীর-ই খোম’ নামক স্থানে এসে যাত্রাবিরতি করলেন। এটা মক্কা ও মদীনা শরীফের মধ্যভাগে জোহ্ফার আশেপাশেই অবস্থিত। এখান থেকে তিন মাইল দূরে ঐ ‘গদীর’ (জলাশয় বিশেষ) অবস্থিত।
এখানে এসে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা কেরামের দিকে মনোনিবেশ করলেন। আর এরশাদ ফরমালেন-اَلَسْتُمْ تَعْلَمُوْنَ اَنِّىْ اَوْلى بِالْمُؤْمِنِىْنَ؟ (আলাস্তুম্ তা’লামূনা আন্নী আওলা-বিল্ মু’মিনী-ন) (তোমরা কি জাননা যে, আমি মুসলমানদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক নিকটে?) অন্য এক বর্ণনানুসারে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু’র হাত উপরের দিকে তুলে ধরে এ কথাটি তিন বার বলেছিলেন। তদুত্তরে, সবাই বললেন, ‘‘হ্যা, নিশ্চয় আপনি সমস্ত মুসলমানের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও নিকটে ও প্রিয়।’’
অতঃপর এরশাদ ফরমালেন, ‘‘আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি জিনিষ রেখে যাচ্ছি- তন্মধ্যে একটা অপরটা অপেক্ষা মহান। সে দু’টি হচ্ছে-১. ক্বোরআন করীম এবং ২. আমার আহলে বায়ত (পরিবার-পরিজন)। আমার পর ওই দু’টি সম্পর্কে এ মর্মে সতর্ক থাকবে যে, সে দু’টির সাথে কিরূপ আচরণ করছো? সে দু’টির প্রতি তোমাদের কর্তব্য কীভাবে পালন করছো? আমি চলে যাবার পর এ দু’টির একটা অপরটা থেকে পৃথক হবেনা; শেষ পর্যন্ত তোমরা ‘হাওয-ই কাওসার’-এর কিনারায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে।’’
অতঃপর এরশাদ ফরমালেন, ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা আমার ‘মাওলা’ (مولى) আর আমি হলাম সমস্ত মুসলমানের মাওলা (مولى)। তারপর বললেন, اَللهُمَّ مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ ‘আল্লা-হুম্মা মান্ কুন্তু মাওলা-হু ফা‘আলিয়্যুন মাওলা-হু’। (হে আল্লাহ! আমি যার ‘মাওলা’ আলীও তার ‘মাওলা’।) اَللهُمَّ وَالِ مَنْ وَالاَهُ ‘আল্লা-হুম্মা ওয়া-লে মান্ ওয়া-লা-হু হুয়া’ (হে আল্লাহ্! তুমিও তাকেই ভালবাসো, যে আলীকে ভালবাসে।) وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ ‘ওয়া-আদে মান্ ‘আ-দা-হু’ (এবং তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করো, যে তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে।) অন্য বর্ণনায় এটাও এরশাদ হয়েছে- وَانْصُرْ مَنْ نَصَرَهُ وَاخْذُلْ مَنْ خَذَلَهُ ‘ওয়ান্সুর মান নাসারাহু ওয়াখযুল মান আযাল্লাহু’। [হে আল্লাহ! তাকে সাহায্য করো, যে তাকে (আলীকে) সাহায্য করে। আর তাকে অপমানিত করো, যে আলীকে ছেড়ে দেয়।] আর যেদিকে আলী মনোনিবেশ করে, সত্যকেও সেদিকে নিশ্চিত করো।’’
এ ঘটনার পর সাহাবা কেরামের মধ্যে হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজ্হাহুর সাথে সাক্ষাৎ হলে, তাঁকে মুবারকবাদ দিয়ে বললেন-
هَنِيْئًا يَا اِبْنَ اَبِىْ طَالِبٍ اَصْحَبْتَ وَاَمْسَيْتَ مَوْلَى كُلِّ مُؤْمِنٍ وَمُؤْمِنَةٍ
‘হানী-আন্ ইয়া ইব্না আবী- তা-লিবিন আসবাহ্তা ওয়া আমসায়তা মাওলা- কুল্লি মু’মিনিন ওয়া মু’মিনাতিন।
অর্থাৎ ‘‘আবূ তালিব- তনয়কে ধন্যবাদ! আপনার সকাল ও সন্ধ্যাতো এমতাবস্থায় হচ্ছে যে, আপনি প্রত্যেক মু’মিন নরনারীর ‘মাওলা’।’’
এ হাদীসখানা ইমাম আহমদ হযরত বারা ইবনে আযিব এবং হযরত যায়দ ইবনে আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন, যেমন- মিশকাত শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। [মাদারিজুন্নবূয়ত ও আসাহ্হুস্ সিয়র ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।]
এখন দেখুন, এ হাদীসের প্রেক্ষাপট কি? মুহাদ্দেসীন কেরাম ও নির্ভরযোগ্য ইমামগণ এই হাদীসের মর্মার্থ কি বর্ণনা করেছেন? পক্ষান্তরে, কথিত সম্প্রদায়টি কিতাবে এ হাদীসের অপব্যাখ্যা করে তাদের জঘন্য আক্বীদার জন্ম দিয়েছে?
হাদীসের প্রেক্ষাপট
‘গদীর-ই খোম’-এর খোৎবায় (ভাষণ) হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিশেষ করে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে উক্ত হাদীস শরীফ এরশাদ করার প্রয়োজনীয়তাটা কি ছিলো? কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওই নসীহত করেছেন? এ প্রসঙ্গে ইবনে হাজর মক্কী (রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি) তাঁর ‘সাওয়াইক্বে মুহ্রিক্বাহ্’ নামক কিতাবে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন- হাফেয শাসমুদ্দীন জাযারী ইবনে ইসহাক্ব থেকে বর্ণনা করেন, যেসব লোক হযরত আলী (র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর সাথে ইয়ামেন গিয়েছিলেন তাঁদের থেকে কেউ কেউ হযরত আলী (র্কারামাল্লাহু)-এর কোন সিদ্ধান্তের কারণে তাঁর সাথে বিরোধ করেন। এ বিরোধিতা পরবর্তীতে শত্রুতায় পরিণত হয়েছিলো। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওফাত শরীফের পূর্বে উক্ত খোৎবা বা ভাষণে সেটার খন্ডন করে ওই শত্রুতার অবসান ঘটিয়েছিলেন। (কারণ, এর মাত্র দু’মাস পরই হুযূর আক্রাম এ পৃথিবী থেকে পর্দা করে অন্তরালে তশরীফ নিয়ে যান।) সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া-আলিহী ওয়া আস্হাবিহী ওয়াসাল্লাম।
ইমাম যাহাবী হাদীসের উক্ত প্রেক্ষাপটই বিশুদ্ধ বলে মন্তব্য পেশ করেন। কারণ, হযরত বোরায়দাহ্ রসূলে আক্রামের সামনে অভিযোগ করলে হুযূরের চেহারা আন্ওয়ারের রং পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ হুযূর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে খোদ্ হযরত বোরায়দাহ্ বলেছেন- হুযূর এরশাদ ফরমান-
يَا بُرَيْدَةُ اَلَسْتُ اَوْلى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ؟ قُلْتُ بَلى يَا رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ
‘এয়া বুরায়দাতু আলাস্তু আওলা- বিল্ মু’মিনী-না মিন্ আন্ফুসিহিম? ক্বুল্তু বালা- ইয়া রসূ-লাল্লাহ্! ক্বা-লা মান্ কুন্তু মাওলা-হু ফা‘আলিয়্যুন মাওলা-হু।’ অর্থাৎ (‘‘হে বোরায়দাহ! আমি কি মু’মিনদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও নিকটে নই?’’ আমি আরয করলাম, ‘‘হাঁ, হে আল্লাহর রসূল!’’ এরশাদ ফরমালেন, ‘‘আমি যার ‘মাওলা’ আলীও তার ‘মাওলা’।’’ আবূ দাঊদ সাজিস্তানী ও আবূ হাতিম রাযী প্রমুখ এই বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আপত্তি করলেও ইবনে হাজর মক্কী লিখেছেন যে, ষোলজন সাহাবী এই ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি)-এর এক বর্ণনায়, ত্রিশজন সাহাবী এটা বর্ণনা করেছেন, ‘‘আমি রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে তা এরশাদ করতে শুনেছি।’’
মূলতঃ হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজ্হাহুর ফযীলতের পক্ষে এ ঘটনাটাকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ বর্ণনা বিভিন্ন ‘সনদ’ (সূত্র) দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কিছু কিছু হচ্ছে ‘সহীহ’ (বিশুদ্ধ) আর কিছু কিছু ‘হাসান’ (গ্রহণযোগ্য) পর্যায়ের। এ কারণে এ বর্ণনা নিঃসন্দেহে ‘সহীহ’। তবে এ হাদীসখানা (مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ) ‘মান্ কুনতু মাওলা-হু ফা ‘আলিয়্যুন মাওলা-হু’ (অর্থাৎ আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা।) ‘খবর-ই ওয়াহিদ’ (خبر واحد)-এর ঊর্ধ্বে নয়। যেহেতু এ হাদীসের বিশুদ্ধতা নিয়ে হাদীসের কোন কোন ইমাম আপত্তিও উত্থাপন করেছেন, তবুও অন্যান্য সনদ সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে বিধায় সেটা বিশুদ্ধ হলেও ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হতে পারে না। যদিও কথিত সম্প্রদায়টি এ হাদীসকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের বলে প্রচার করে। বস্তুতঃ তাদের এ প্রচারণা ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। সর্বোপরি, এ প্রচারণা হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। এর অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, ইমাম বোখারী ওই ঘটনা বর্ণনাই করেননি। ইমাম মুসলিম অবশ্য তা বর্ণনা করেছেন; কিন্তু হুযূরের খোতবা বা ভাষণের যেই বচনগুলো তাতে এরশাদ হয়েছে (مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ) ‘মান্ কুন্তু মাওলা-হু ফা‘আলিয়্যুন মাওলা-হু’ সেগুলো দ্বারা বিরোধী সম্প্রদায়টির ওই উদ্দেশ্য হাসিল হয়না, যা তারা করতে চায়; বরং তা দ্বারা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফযীলতই প্রকাশ পায় মাত্র।
হাদীসের উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ
এ হাদীস শরীফ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর চূড়ান্ত কারামত ও ফযীলতকে প্রকাশ করে। এটা দ্বারা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে ভালবাসা রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। পক্ষান্তরে, তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ থেকে বিরত থাকার শিক্ষাই তাতে দেয়া হয়েছে। যেমন অন্য একটা বর্ণনায় এসেছে, ‘‘হযরত আলীর সাথে শুধু ওই ব্যক্তিই ভালবাসা রাখবে যে মু’মিন হবে। আর তাঁর প্রতি শত্রুতা সে-ই পোষণ করতে পারে, যে মুনাফিক্ব। তাছাড়া, হাদীসের ওই প্রেক্ষাপটও একথাই সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করে। এটাই হচ্ছে আহলে সুন্নাতের সর্বসম্মত অভিমত।
বিরোধী সম্প্রদায়টির ভুল ধারণা
উল্লেখ্য যে, ও বিরুদ্ধবাদী আর কেউ নয়, তা হচ্ছে- সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায় সুন্নী মতাদর্শ থেকে বহু আগেই সম্পূর্ণরূপে বিচ্যুত হয়েছে এবং ইসলামের ইতিহাসে ‘শিয়া’ সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে আছে। সম্প্রদায়টি উক্ত হাদীস ও ঘটনাকে এ মর্মে প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করাতে চায় যে, হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)ই ‘ইমাম’ এবং হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অব্যবহিত পরেই তিনি খলীফা তথা ‘ইমাম’। তারা এটা দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও হযরত ওমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা)-এর খিলাফতকে (তথাকথিত) অবৈধ বলে অপপ্রচার চালায়। (নাঊযুবিল্লাহ্!)
উল্লেখ্য, শিয়ারা তাদের পক্ষে নি¤œলিখিত যুক্তিগুলো উপস্থাপন করারও প্রয়াস পায়ঃ
এক. হাদীসটা (নাকি) ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের। (কারণ, শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, ‘ইমামত’-এর বিষয়টি শুধু ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ও সাব্যস্ত হতে পারে।)
দুই. তারা হুযূর পাকের এরশাদ (اَلَسْتُ اَوْلى بِكُمْ؟) ‘আলাস্তু আওলা বিকুম?’ অর্থাৎ আমি কি তোমাদের ‘আওলা’ নই?)-এর (اَولى) (মাওলা) পদটি এবং (مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ) ‘মান্ কুন্তু মাওলা-হু ফা‘আলিয়্যুন মাওলা-হু’ অর্থাৎ (আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা) (مَولى) এর (মাওলা) পদটি থেকে ‘ইমাম’ হবার অর্থ গ্রহণ করে হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকেই একমাত্র ইমাম বা ‘খলীফা’ বলে প্রমাণ করতে চায়।
জবাব
প্রথমতঃ শিয়াদের মতে ‘ইমাম’ সাব্যস্ত করার বিষয়টির জন্য ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের ‘রেওয়ায়ত’ (অর্থাৎ এমন বর্ণনা, যার বর্ণনাকারী প্রতিটি যুগে এতবেশী যে, তাদের মিথ্যার উপর ঐকমত্য অসম্ভব, যার ফলে বর্ণনাটিও এতই বিশুদ্ধ যে, তা দ্বারা পবিত্র ক্বোরআনের আয়াতকেও রহিত বলে ধরে নেয়া যায়) অপরিহার্য অথচ গদীর-ই খোমের ঘটনা বা বর্ণনাটি ওই পর্যায়ের নয়; যেমনটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর শিয়া সম্প্রদায় তাদের দাবীর সমর্থনে উক্ত বর্ণনাটিকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের বলে যেই ঘোষণা দেয় তা নিছক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। যেখানে উক্ত বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কারো কারো আপত্তি রয়েছে, সেখানে সেটা ‘মুতাওয়াতির’ হবে কোত্থেকে? বর্ণনার বিশুদ্ধতা ইমাম বোখারী (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি)-এর শর্তানুরূপ নয় বিধায় তিনি সেটা বর্ণনাই করেননি। ইমাম মুসলিমের বর্ণিত ও হাদীসের বচনগুলোর অর্থ শিয়াদের গৃহীত অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। তবুও হাদীস বিশুদ্ধ হলেও তা শিয়া সম্প্রদায়ের আক্বীদানুসারে, ‘ইমাম’ বানানোর পক্ষে দলীল হবার মতো নয়।
দ্বিতীয়তঃ مولى (মাওলা) শব্দটি একাধিক অর্থবোধক। যেমন-
১. (مُعْتَق) (মু’তাক্ব,) ২. (عَتِيْق) (আতীক্ব) অর্থাৎ আযাদকৃত, ৩. (نَاصِرْ) (নাসির বা সাহায্যকারী), ৪. (مَحْبُوْبْ) (মাহ্বূব বা প্রিয়) এবং ৫. (مُتَصَرِّفُ فِى الْاَمْرِ) (অর্থাৎ নিজ খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতায় নির্দেশদাতা বা নির্দেশ দেয়ার উপযোগী। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনটাই ‘ইমাম হওয়া’ কিংবা ‘খলিফা হওয়া’ (যথাক্রমে اِمَامَتْ ও خِلاَفَتْ ) -এর অর্থ এককও অনিবার্যরূপে প্রকাশ করে না।
তৃতীয়তঃ হ্যাঁ, কিছুক্ষণের জন্য যদি ‘ইমামত’ (ইমাম হওয়া) বা ‘আনুগত্যের উপযোগী হওয়া’-এর অর্থ কল্পনাও করা হয়, তবুও তো তার এ অর্থ নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায় না যে, ‘তাৎক্ষণিকভাবে, তখনই তিনি (হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) মু’মিনদের খলীফা ছিলেন, এমনকি যখন হুযূর-ই করীম তা এরশাদ ফরমাচ্ছিলেন তখনও।’ কারণ, তখনতো হুযূর আপন প্রকাশ্য হায়াতে মওজুদ ছিলেন। হ্যাঁ, তখন অর্থ এই হতে পারে যে, ‘তাঁর হাতে যখন বায়‘আত গ্রহণ করা হবে তখন থেকে তিনি ‘ইমামে হক্ব’ (যথার্থ ইমাম) হবেন, যেমনটি তিনি যথাসময়ে হয়েছিলেন। কাজেই, এটাকে ‘শায়খাঈন’ (হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও হযরত ওমর ফারূক্ব)-এর খিলাফত ও ইমামতের মোকাবেলায় হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পরপরই বিরতি ছাড়া হযরত আলী খলীফা হবার পক্ষে দলীলরূপে স্থির করা কোন মতেই শুদ্ধ হবেনা। (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)।
চতুর্থতঃ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- শিয়া সম্প্রদায় এই বর্ণনাকে এতই জোরেশোরে হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজ্হাহুল করীম)-এর ইমামতের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করায়, কিন্তু এটা দেখেনা যে, হুযূর আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পর যখন ‘খেলাফত’ ও ‘ইমামত’-এর বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিলো তখন না হযরত আলী (র্কারামাল্লাহু ওয়াজ্হাহু) নিজেই ওই বর্ণনাকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন, না হযরত আব্বাস, না বনূ হাশিম গোত্রের কেউ, না কোন একজন সাহাবীও।
বলা বাহুল্য, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পর ‘সক্বীফাহ্-ই বনী সা‘ইদাহ্’ নামক স্থানে খেলাফতের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। শীর্ষস্থানীয় ‘মুহাজেরীন’ ও ‘আনসার’ সাহাবীগণ তাতে অংশ গ্রহণ করেন। সর্বোপরি, তাতে ওইসব সাহাবীও শরীক হন, যাঁরা খোদ্ ‘গদীর-ই খোম’-এর ‘খোৎবা’ বা ভাষণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই খোৎবার পর সময়ও অতিবাহিত হয়েছিলো মাত্র দু’মাস। কিন্তু কেউ এ ঘটনা ও বর্ণনাকে ইমামতের দলীল হিসেবে পেশ করলেন না, বরং তাঁরা সেটাকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফযীলত নিদের্শক বলেই অভিহিত করেন।
পঞ্চমতঃ এ বর্ণনা সত্ত্বেও খোদ্ হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) বারংবার সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাউকেও ‘ইমাম’ বা ‘খলীফা’ নিয়োগ করেননি। কারো নামও ওই পদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেননি। খেলাফতের বিষয়টি উপস্থিত সাহাবা কেরামের পরামর্শনুসারেই হয়েছে। এ মর্মে অগণিত বর্ণনাই হযরত আলী র্কারামাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াজহাহু থেকে পাওয়া যায়। কয়েকটা উল্লেখ করা গেলোঃ
১. ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেছেন যে, বায্যায ‘হাসান’ পর্যায়ের ‘সনদ’ সহকারে, আর ইমাম আহমদ ‘মজবুত’ সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আলী র্কারামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজ্হাহু-এর নিকট লোকেরা তাঁকে খলীফা বানানোর দাবী জানালেন। তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহর রসূল যেভাবে ওই বিষয়টি তোমাদের মতামতের উপর ছেড়ে দিয়েছেন আমরাও অনুরূপভাবে সেটা তোমাদের মতামতের উপর ছেড়ে দিলাম।’’
বায্যায থেকে এমন একটি বর্ণনাও পাওয়া যায়, যার বর্ণনাকারীগণ হলেন বোখারী শরীফেরও বর্ণনাকারী। তাতে বর্ণিত হয় যে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘‘আল্লাহর রসূল কাউকেও খলীফা নিয়োগ করেননি।’’
২. দারু ক্বুতুনী, ইবনে আসাকির এবং ইমাম যাহাবী প্রমুখ হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজ্হাহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বসরা নগরীতে বর্ণনাটি করেছেন, ‘‘আল্লাহরই শপথ! আল্লাহর রসূল আমাদের জন্য কারো খিলাফতের ব্যাপারে অঙ্গীকার গ্রহণ করেননি। যদি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অঙ্গীকার নিতেন, তবে আমরা (তাকে বাদ দিয়ে) আমাদের ভাই বনী তাইয়্যেম ইবনে র্মুরাহ্কে এবং ওমর ইবনুল খাত্তাবকে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মিম্বর শরীফের উপর প্রতিনিধিত্ব (খিলাফত) করতে দিতামনা এবং (তাঁরা যদি বিরোধিতা করতেন, তবে) আমাদের এই হাতে তাঁদের সাথে মোকাবেলা করতাম।’’
৩. আবূ নু‘আয়ম বর্ণনা করেন, হযরত হাসান-আল-মুসান্নাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ (আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা) হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইমামতের প্রমাণ কিনা! তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহর শপথ! যদি ‘মাওলা’ শব্দ দ্বারা রসূলুল্লাহ্র উদ্দেশ্য ‘আমীর’ কিংবা ‘সুলতান’ (খলীফা) বানানোই হতো, তবে তিনি (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) তদপেক্ষা সুস্পষ্ট অর্থবোধক শব্দই ব্যবহার করতেন। কারণ, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন فَصِيْحُ الْبَيَانِ (‘ফসীহুল বয়ান’ বা অলংকার সমৃদ্ধ সুস্পষ্ট অর্থবোধক ও শব্দ প্রয়োগকারী)
আর যদি ইমামতের জন্য রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী র্কারামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজ্হাহুকে নিয়োগ করে দিতেন, আর হযরত আলী (র্কারামাল্লাহু)ও ওই সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও নীরব থাকতেন এবং রসূলুল্লাহর নির্দেশ বর্জিত হতে দেখে তাতে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকতেন, তবে সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহ্গার হযরত আলী (র্কারামাল্লাহু)-ই হতেন; নতুবা তাতে তাঁর কাপুরুষত্বই প্রমাণিত হতো। (না‘ঊযুবিল্লাহ্) এটাতো কোন অবস্থাতেই হতে পারেনা।’’
মোটকথা, উপরোক্ত বর্ণনা (রেওয়ায়ত) থেকে হযরত আলীকে ইমাম নিযুক্ত করার অর্থ গ্রহণ করা এবং সেটাকে এ মর্মে দলীল হিসেবে পেশ করা কোন মতেই বিশুদ্ধ নয়। তা না আভিধানিকভাবে শুদ্ধ, না ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ। যদি এটা শুদ্ধ হতো তবে সেটার পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে দেখে সাহাবা কেরাম অবশ্যই আপত্তি উত্থাপন করতেন এবং তাঁরা ওই বিশুদ্ধ অর্থই তা থেকে গ্রহণ করতেন ও সেটাকে প্রমাণ হিসেবে স্থির করতেন। অবশ্যই এটা করতেন- বনী হাশেম ও হযরত আলী নিজেই। আরো করতেন- হযরত আব্বাস। কিন্তু কেউতো তা করেননি। আর তাও এমনই মুহূর্তে করেননি, যখন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিলো। (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম)।
অতএব, ‘মাওলা’ (مولى) শব্দের অর্থ এখানে ‘সাহায্যকারী’ ও ‘প্রিয়’। বাস্তবিকপক্ষে, এ অর্থ গ্রহণ করলে কোন প্রকার অসুবিধারই সম্মুখীন হতে হয়না। (আস্সাওয়াইক্বুল মুহরিক্বাহ্, মাদারিজুন্নুবূয়ত ও আসাহ্হুসসিয়ার ইত্যাদি)
সুতরাং এ প্রসঙ্গে আহলে সুন্নাতের এই বিশুদ্ধ অভিমতকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে সত্য, সঠিক পথ ও মতটি গ্রহণে ব্রতী হবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। ‘গদীর-ই খোম’-এ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ভাষণ থেকে মনগড়া অর্থ গ্রহণ করে কিংবা অপব্যাখ্যা দিয়ে হযরত আলী (র্কারামাল্লাহু ওয়াজ্হাহু)-কে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরপর ‘ইমাম’ (খলীফা) বলে বিশ্বাস করা, বরং আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সেই ‘ইমামত’-কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নবূয়ত ও রিসালত অপেক্ষাও উত্তম বলা এমনকি তাদের কোন কোন বই-পুস্তকে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপরও সেই ‘ইমামত’-কে মেনে নেয়া জরুরী ছিলো বলে উল্লেখ করা ধৃষ্ঠতা দেখানো হয়েছে, যা শরীয়তের মধ্যে কুফরীর পর্যায়ে পড়ে। চরম ভ্রান্তি বৈ- কিছুই নয়। এমনটি করে থাকে শিয়া সম্প্রদায়