আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ইসলামী আকীদা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কতিপয় আকীদা, যা জেনে নেয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যন্ত জরুরীঃ
🔸উপরের দিককে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালাকে উপরওয়ালা বলা নিষিদ্ধ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা স্থান-কাল-সময় এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হতে পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা এগুলোরও সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ’র অস্তিত্বের জন্য কোন জায়গা বা আরশের প্রয়োজন নেই। কোন কিছু সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ তায়ালা যেমন কোন স্থানে অবস্থান ব্যতীত ছিলেন, এখনও তিনি আছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন”(সূরা ইখলাসঃ ২)। ইমাম তাহাবী রহঃ বলেন- ‘‘আল্লাহ তা‘য়ালার গুণে সৃষ্টি জগতের কেহ নেই। তিনি সীমা, পরিধি, অঙ্গপ্রতঙ্গ এবং উপাদান উপকরণ থেকে পবিত্র। সৃষ্টি জগতের ন্যায় ছয় দিকের কোন দিক তাকে বেষ্টন করতে পারে না।’’ (আক্বিদাতুত তাহাভী, ৪৪পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৩৮)

“যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তায়ালা কোথায়? ইমাম আবূ হানিফা রহ. এর উত্তরে বলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোন স্থানই ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমনকি ‘কোথায়’ বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিলো না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা।” (আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ.২০)

মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান, সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাঁর কোন দৃষ্টান্ত তথা উপমা নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা (সূরা আশ-শুরাঃ ১১)”। তিনি সবকিছু দেখেন, শুনেন, হুকুম করেন। এসবের জন্য তিনি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তখনো ছিলেন যখন আরশ কুরসি কোন কিছুই ছিল না। আল্লাহ আরশের নিয়ন্ত্রণকারী। আকার-আকৃতি, স্থান-কাল থেকে পবিত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি আখিরাতে মানুষকে দীদার দান করবেন, তেমনিভাবে দুনিয়াতে তাঁর এই দীদার শুধুমাত্র আমাদের নবীর জন্য নির্বাচিত করেছেন। ইমাম আবূ হানিফা রহঃ বলেন, “জান্নাতবাসীর জন্য কোন সাদৃশ্য, অবস্থা ও দিক ব্যতীত আল্লাহ তায়ালার দর্শন সত্য।” [কিতাবুল ওসিয়্যা, পৃ.৪, শরহে ফিকহুল আকবার, মোল্লা আলী কারী, পৃ.১৩৮]।

রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন লা মকানে অর্থাৎ কোনো স্থান ছাড়া। আমাদের মস্তিষ্ক বানানো হয়েছে আকার-আকৃতি ও সসীম বস্তুকে নিয়ে চিন্তার জন্য। কিন্তু আল্লাহ তো অসীম। তাই আল্লাহ কে আমরা নিজের সসীম মস্তিস্কে ধারন করতেই পারবো না (তাঁর সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত হতে পারবোনা)। এছাড়াও তিরমিজির সহিহ হাদিসের (৩২৭৬) ভাষ্য অনুযায়ী, আমাদের জ্ঞান সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়েই শেষ হয়ে যায়, এর বেশি আমরা জানতে পারি না অর্থাৎ আমাদের বুঝে আসবে না। তাই আমাদেরও উচিত এটা নিয়ে বেশি চিন্তা না করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করো। কিন্তু আল্লাহকে নিয়ে (অধিক) চিন্তা করো না (পথভ্রষ্ঠ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে) (কানজুল উম্মাল: ৫৭০৮)। আমাদের খেয়াল রাখা উচিৎ কোনক্রমেই যেন আমরা আল্লাহ’র জন্য স্থান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত না করি।

হযরত আলী রাঃ বলেন, “যখন কোন স্থান ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনি এখনও স্থান থেকে পবিত্র অবস্থায় আছেন। আল্লাহ তায়ালা নিজের কুদরত প্রকাশের জন্য আরশ সৃষ্টি করেছেন, নিজ সত্ত্বার স্থান হিসেবে নয়।” (আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, আবু মনসুর বাগদাদী, পৃ.৩৩৩)

বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম যাইনুল আবেদীন রাঃ বলেন, হে আল্লাহ, আপনি সেই সত্ত্বা, কোন স্থান যাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না। আপনি সেই সত্ত্বা যার কোন হদ বা সীমা নেই। সীমা থাকলে তো আপনি সসীম হয়ে যাবেন। (ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.৪, পৃ.৩৮০)

সুতরাং যারা আল্লাহ’র জন্য আরশকে অবস্থান হিসেবে সাব্যস্থ করে তারা পথভ্রষ্ট। স্থান-কাল-অবস্থান এগুলো সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা অনাদিকাল থেকে আছেন, অনন্তকাল থাকবেন। তিনি স্থান কাল থেকে পবিত্র, আল্লাহর কোন সৃষ্টি তাকে ধারণ করতে সক্ষম নয়। মহান রব তা‘য়ালা ইরশাদ করেন- “নিশ্চয়ই মহান রব সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।’’ (সূরা ফুস্সিলাতঃ ৫৪)

ইস্তিওয়াহ শব্দ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা কি বুঝিয়েছেন তা আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন, যার উপর এটা নাজিল করেছেন যাকে স্বয়ং তিনি নিজে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আর কাউকে এটা বুঝার ক্ষমতা দিয়ে থাকলে তিনিই ভালো জানেন। আমরা ইস্তিওয়াহ শব্দকে ব্যাখ্যা করতে যাব না, এটা দ্বারা আল্লাহ যা বুঝিয়েছেন তাঁর উপর ঈমান রাখব। কিন্তু কখনো এর দ্বারা আরশকে আল্লাহ’র জন্য অবস্থান হিসেবে সাব্যস্থ করতে পারবোনা। এক্ষেত্রে সেটা কুফরী হবে। কোন কোন ইমামের মত থেকে জানা যায় যে,

আল্লাহ তায়ালা আরশ সৃষ্টি করেছেন এবং এর উপরও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা আরশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, আরশ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে অনেক বড় এক সৃষ্টি। তিনি এটি উল্লেখ করে বুঝিয়েছেন যে, অন্যান্য ছোট সৃষ্টিও তাঁর ক্ষমতার অধীন।

🔸আহলুস সুন্নাহ এর আকীদা হল আল্লাহ তায়ালা আকার আকৃতি থেকেও পবিত্র। কুরআন হাদিসের কয়েক জায়গায় আল্লাহ’র হাত-পা শব্দগুলো এসেছে। সেই শব্দগুলো দ্বারা আল্লাহ যা বুঝিয়েছেন আমরা তার উপর ঈমান এনেছি। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ অনুধাবনে আমরা অক্ষম। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে কোনক্রমেই যেন আমরা আল্লাহ’র জন্য স্থান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত না করি। তিনি কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন। এটাই আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, “তাঁর কোন দৃষ্টান্ত তথা উপমা নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।”(সূরা আশ-শুরাঃ ১১)

ইমাম বায়হাকী রহঃ বলেন, “নিশ্চয় আমাদের ও সকল মুসলমানের জানা অত্যাবশ্যক যে, আমাদের প্রভু আকৃতি ও অবয়ব বিশিষ্ট নন। কেননা, “আকৃতি”, কেমন এর চাহিদা রাখে। অথচ কেমন প্রশ্নটি আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কোনো ক্ষেত্রে যদি আকৃতি প্রকাশের কথা আসে তা হবে তাঁর সিফাত বা গুণাবলী।” (কিতাবুল আসমা ওয়াল সিফাত)]

ইমাম তাহাবী (রহঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’য়ালাকে মানবীয় গুণাবলী হতে কোন গুণের দ্বারা গুণান্বিত করবে সে কাফির।” (ইমাম তাহাবী, আকিদাতুত তাহাভী, ৪১ পৃষ্ঠা, আকিদা নং ৩৪)

আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, দয়ালু, ইলমে গায়েবের অধিকারী, আরোগ্যতা দান করেন ইত্যাদি- এগুলো আল্লাহ’র সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য। কেউ আল্লাহ’কে এগুলো দান করেনি বরং তিনিই মানুষকে বিভিন্ন ক্ষমতা দেন, যা তাদের জন্য সত্ত্বাগত নয়, আল্লাহ প্রদত্ত; আল্লাহ’র ক্ষেত্রে এগুলো সত্ত্বাগত। কিন্তু স্থান-আকার-আকৃতি এগুলো শুধুমাত্র সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন,

“তিনি (ঈসা আলায়হিস সালাম) বলবেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে নিদর্শনসহ তোমাদের নিকট এসেছি, আমি তোমাদের জন্য মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফুঁক দেব, আল্লাহর হুকুমে পাখি হয়ে যাবে, আল্লাহ’র হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগী আরোগ্য করবো এবং মৃতকে জীবিত করবো এবং আমি তোমাদেরকে বলে দেব তোমাদের গৃহে তোমরা যা আহার কর এবং সঞ্চয় করে রাখ; নিশ্চয়ই এ কাজে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা মু’মিন হও।” (সূরা আলে ইমরান ৪৯)

আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “(হে সর্বসাধারণ!) আল্লাহর শান এ নয় যে, তোমাদেরকে অদৃশ্যের জ্ঞান দিয়ে দেবেন। তবে আল্লাহ নির্বাচিত করে নেন তার রাসূলগণের মধ্য থেকে যাঁকে চান। সুতরাং ঈমান আনো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর এবং যদি তোমরা ঈমান আনো এবং পরহেযগারী অবলম্বন করো, তবে তোমাদের জন্য মহা প্রতিদান রয়েছে।” (সূরা আলে ইমরানঃ ১৭৯)

🔸কুরআনে পাকের কিছু আয়াত এবং কিছু হাদিস শরীফ এমন রয়েছে যেগুলোর শুধু আক্ষরিক অর্থ নিয়ে বিশ্বাস করলে ঈমান থাকবে না। যেমন হাদিসে কুদসীতে রয়েছে, সকল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলছেন,

“যে ব্যক্তি আমার কোন অলি বা বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি, তা দ্বারাই কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ‘ইবাদাত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে কোন দ্বিধা করি-না, যতটা দ্বিধা করি মু’মিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি।” (সহীহ বুখারী ৬৫০২)

এর দ্বারা কি আমরা এটা বুঝব যে, আল্লাহ ও আল্লাহর অলি এক হয়ে গিয়েছে (নাউজুবিল্লাহ)!! নিশ্চয়ই নয়।

তাই এসব ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থ নেয়া যাবে না। যেহেতু আউলিয়াদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে সকল কাজ-কর্ম আল্লাহ তা’আলা’র সন্তুষ্টি মোতাবেক প্রকাশ পায় এজন্যে একথা বলা হয়েছে যে, আমিই যেন তার চোখ, কান, হাতও পা হয়ে যাই। আল্লাহ তায়ালা তো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে পবিত্র।

একইভাবে তাহাজ্জুদের ফযিলত বা শবে বরাতের ফযিলত সম্পর্কিত হাদিসে মুবারকার ক্ষেত্রেও আক্ষরিকভাবে শুধু বাহ্যিক অর্থ নিয়ে আল্লাহ’র জন্য স্থান সাব্যস্থ করা যাবে না, আল্লাহ তায়ালা অবতরণ করেন বলা যাবে না। কেউ কেউ হাদিসগুলোকে স্বীয় অবস্থানে রাখাকে সমীচীন মনে করে থাকেন, তাঁরা কোনো নির্দিষ্টতা আরোপ ব্যতিরেকে হাদিসগুলোকে বিশ্বাস করেন, কোনো প্রকার কাইফিয়্যাহ এবং সৃষ্টি (তাশবিহ্) এর সাথে কোনোরুপ সাদৃশ্যতা স্থাপন করা ছাড়াই আল্লাহর পবিত্রতা মহিমা ঘোষণা করেন। এই হাদিস শরিফের ব্যাপারে মুহাদ্দিসিনে ক্বিরামের মতামত থেকে জানা যায় এর ব্যাখ্যা এরুপ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে:

একটি মত হচ্ছে, অাল্লাহর বিশেষ করুণা বা অনুগ্রহ, নির্দেশ এবং ফেরেশতাকুল অবতরণ করেন; যেমন বলা হয়ে থাকে, বাদশাহ্ এই শহরটি নির্মাণ করেছেন, তিনি শহরটি নির্মাণের কার্যভার গ্রহণ করেছেন। বস্তুত শ্রমিকের দ্বারা কাজটি সম্পাদন করা হয়েছে বা হবে।

অপর মতটি হচ্ছে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রাতের সে সময়টিতে প্রার্থনাকারীদের জন্যে তাঁদের চাওয়াগুলোর আশু জবাব দানে তাঁর বিশেষ নরমতা, কোমলতা বা দয়াপরবশ হওয়ার বিষয়টিকে রুপকার্থে এখানে তাকিদ করেছেন যাতে বান্দা আল্লাহর বিশেষ করুণা লাভে ধন্য হন।

🔸রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ কুরআন পাঁচটি বিষয়সহ নাযিল হয়েছেঃ (১) হালাল (২) হারাম (৩) মুহ্‌কাম (৪) মুতাশাবিহ ও (৫) আমসাল (উপদেশপূর্ণ ঘটনা)। সুতরাং তোমরা হালালকে হালাল জানবে, হারামকে হারাম মনে করবে। মুহকামের উপর ‘আমল করবে, মুতাশাবিহের সাথে ঈমান পোষণ করবে। আর আমসাল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। [মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৮২]

মুতাশাবিহাত আয়াতের ক্ষেত্রে হুকুম হচ্ছে –

আম্মাজান আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এ আয়াত (সূরা আলে ইমরানঃ ৭) এর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে প্রশ্ন করা হলঃ (আয়াতটি)

“তিনিই আপনার উপর এমন কিতাব নাযিল করেছেন, যার কতিপয় আয়াত মৌলিক-সুস্পষ্ট অর্থবোধক (মুহকামাত), এগুলো হল কিতাবের মূল আর অন্যগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট নয় (মুতাশাবিহাত, রুপক); কিন্তু যাদের অন্তরে বক্রতা আছে, তারা গোলযোগ (ফিতনা) সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে উক্ত আয়াতগুলোর অনুসরণ করে যেগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। মূলত; এর সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহ’র-ই জানা আছে (আল্লাহ কাউকে জানালে শুধুমাত্র তিনি জানতে পারেন)। যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে যে, আমরা তার উপর ঈমান এনেছি, এ সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে, মূলতঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিরা ছাড়া কেউই নসীহত গ্রহণ করে না।”

(জবাবে) রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ তোমরা কুরআনের মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের অনুসারীদের দেখলে অনুধাবন করে নিবে যে, আল্লাহ তা’আলা এদেরই নামোল্লেখ করেছেন। কাজেই তোমরা তাদের পরিহার করবে। (সাবধান থাকবে) (সূনান তিরমিজী ২৯৯৪, সহীহ বুখারী ৪৫৪৭)

সূনান আত তিরমিজীর ২৯৯৩ এ রয়েছে, অধঃস্তন এক বর্ণনাকারীর বর্ণনায় আছেঃ তোমরা তাদের দেখলে চিনে রাখবে। তিনি দুই অথবা তিনবার এ কথা বলেছেন।

তাই আমরা অস্পষ্ট বা মুতাশাবিহাত আয়াতসমূহের পিছনে ছুটব না। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, “তাঁর কোন দৃষ্টান্ত তথা উপমা নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা (সূরা আশ-শুরাঃ ১১)”। স্থান-আকার-আকৃতি এগুলো শুধুমাত্র সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, স্রষ্টার নয়। ফলে অস্পষ্ট অর্থসমৃদ্ধ কিছু আয়াতকে অপব্যাখ্যা করে যারা আল্লাহ’র জন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, স্থান (আরশ) সাব্যস্থ করে, আমাদের উচিৎ তাদেরকে চিহ্নিত করে রাখা এবং তাদের থেকে দূরে থাকা যাতে আমাদের ঈমান আমল হেফাজতে থাকে।

🔸আল্লাহ তায়ালা স্থান-আকার-আকৃতি থেকে পবিত্র এবং আল্লাহ তায়ালা সত্ত্বাগতভাবে সব জায়গায় বিরাজমান নয় বরং আল্লাহ’র জ্ঞান ও কুদরত (ক্ষমতা) সর্বত্র উপস্থিত। সকল সৃষ্টি আল্লাহ’র অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।

ইমাম জুরজানী (রহঃ) বলেন- “মহান আল্লাহ কোনো দিকে বা স্থানে নন।’’ [শরহুল মাওয়াকিফ, ২/৫১-৫২পৃষ্ঠা, সাফর বিন আবদুর রাহমান আল-হাওলী, মিনহাজুল আশাইরাহ, ৭৯পৃষ্ঠা, (শামিলা)]

ইমাম কুরতুবী আন্দুলুসী রহঃ বলেন- ‘নিশ্চয়ই মহান রবের জ্ঞান সকল স্থানে উপস্থিত।’’ [হিদায়া ইলা বুলুগুল নিহায়া, ১/১২পৃষ্ঠা]

ইমাম যাহাবী রহঃ তার এক কিতাবে লিখেন- ‘‘যে ব্যক্তি বলবে মহান রব সত্ত্বাগতভাবে সর্বত্র তাহলে তা হবে কিতাবুল্লাহ, সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী উম্মতের আক্বিদার বিপরীত।’’ (কিতাবুল আরশ, ১৮২পৃষ্ঠা)

অনেকে বলতে পারেন মহান আল্লাহ তা‘য়ালা তো বলেছেন যে- ‘‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সাথেই আছেন।’’ (সূরা হাদীদ, ৪) প্রকৃতপক্ষে এখানে মহান রব তার জ্ঞান সকলের সাথে আছে তাই বুঝিয়েছেন। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ূতি রহঃ উল্লেখ করেন- ‘‘ইমাম বায়হাকী রহঃ তাঁর ‘আসমাউ ওয়াল সিফাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম সুফিয়ান সাওড়ী রহঃ কে এই আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আল্লাহর জ্ঞান তোমাদের সাথে আছে তা মহান রব বুঝিয়েছেন।’’ (আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৯পৃষ্ঠা, তাফসিরে রুহুল মা‘আনী, ২০/৩০৫পৃষ্ঠা, আসমাউ ওয়াল সিফাত, ২/৪৪৮পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৮৭০)

ইমাম সুয়ূতি রহঃ আরো উল্লেখ করেন- ‘‘ইমাম আবু হাতেম রহঃ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত।’’ (আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৯পৃষ্ঠা, আলূসী, তাফসিরে রুহুল মা‘আনী, ২০/৩০৫পৃষ্ঠা)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) বলেন -‘‘আল্লাহর কুদরত (ক্ষমতা) এবং জ্ঞান সর্বত্র উপস্থিত।’’ (ইমাম লালকায়ী, ই‘তিক্বাদে আহলে সুন্নাহ, ৩/৪০১পৃষ্ঠা)

‘‘তোমার কোন স্থানে যদি তিনজন থাক চতুর্থজন হিসেবে তিনি (মহান আল্লাহ) থাকেন।’’ (সূরা মুজাদালাহ, ৭) ইমাম ইবনু জারীর আত-তাবারী রহঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন- ‘‘তাঁর (আল্লাহর) ইলমের মাধ্যমে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করেন।’’ (জামি‘উল বায়ান ফী তা‘ভীলিল কুর‘আন, ২২/৪৬৮পৃষ্ঠা)

ইমাম সুয়ূতি রহঃ তাবেয়ী যাহ্হাক রহঃ হতে বর্ণনা করেছেন-‘‘তাঁর জ্ঞান তোমাদের (চতুর্থজন হিসেবে) সকলের সাথে আছে।’’ (আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৭৯পৃষ্ঠা)

ইমাম বায়হাকী রহঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন- ‘‘আমরা যে সব আয়াত লিপিবদ্ধ করেছি তা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, জাহমিয়্যাদের মধ্যে যারা মনে করে যে, আল্লাহ তা‘য়ালা সত্তাগতভাবে প্রত্যেক স্থানে বিদ্যমান রয়েছেন-তা অমূলক। ‘তিনি তোমাদের সাথেই থাকেন, তোমরা তোমরা যেখানেই থাকনা কেন’ (সূরা হাদিদ, ৪)- আল্লাহ তা‘য়ালার এ কথাটিতে তাঁর জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে; তাঁর সত্তাকে নয়।’’ (আল-ই‘তিকাদ, ১১৪ পৃষ্ঠা)

বিশিষ্ট মুফাসসির আবূ হাইয়ান আল-আন্দালুসী রহঃ এবং আল্লামা মাহমুদ আলূসী রহঃ এই আয়াতের তাফসিরে লিখেন- ‘‘এ আয়াতের উক্ত ব্যাখ্যায় ব্যাপারে উম্মাতের সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ (অর্থাৎ প্রত্যেক কিছুর সাথে সত্তাগতভাবে আল্লাহর বিদ্যমান থাকা) উদ্দেশ্য নয়।’’ (আল-বাহরুল মুহীত, ১০/১০১পৃষ্ঠা, রুহুল মা‘আনী, ১৪/১৬৮পৃষ্ঠা)

একদিন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ এঁর উস্তায ইমাম সা‘ঈদ ইবনু ‘আমির আদ-দুবাঈ রহঃ এঁর নিকট একবার জাহমিয়্যাদের কথা উঠলো। তখন তিনি বললেন- ‘‘তারা তো ইয়াহুদী-খৃস্টানদের চাইতেও নিকৃষ্ট কথা বলে।’’ (ইমাম বুখারী, খালকু আফ‘আলিল ইবাদ, ৩০পৃ, যাহাবী, আল-‘উলুয়ু, ১৫৮পৃষ্ঠা)

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ অধিক অবগত আছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভুলত্রুটিসমূহ ক্ষমা করুক, সকলকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করার তাওফিক দান করুক।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment