মুহাম্মদ তাহমিদ রায়হান
যখন এ উপমহাদেশে ইসলামী সালতানাতের সূর্য অস্তমিত হতে যাচ্ছিল, অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছিলো তখনই আল্লাহর রহমতের একটি সূর্য উদিত হল। আবার সেই আকাশকে আলোকিত করলো, সকলের মনে নতুন করে সাহস জোগালো। অন্ধকার আকাশে আলো জালানো সেই সূর্য আর কেউ নন, তিঁনি হলেন ইমামে আহলে সুন্নাত, আযিমুল বরকত শাহ আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে ব্রেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৮৫৬-১৯২১ ঈসায়ী)। খোদা প্রদত্ত অসাধারন যোগ্যতা প্রজ্ঞা আর জ্ঞান দিয়ে তিনি উম্মতে মুহাম্মদীকে বাতিল অপশক্তি থেকে মুক্ত করেছিলেন। হক-বাতিল চিনিয়েছিলেন। সর্বোপরি বাতিল অপশক্তির জঘণ্য আকীদা ও বদ মতলতের জাল ছিন্ন করে তাদের মতবাদের মূলোৎপাটন করেছিলেন। এই মহান ব্যক্তিত্বের কর্ম তাঁকে যুগ যুগ ধরে আশেকে রাসূলদের মনে জাগিয়ে রেখেছে। অথচ পেঁচক কুষ্মণ্ডক ওহাবী গংরা যখন তার শান মানের এই জাজ্বল্যমানতা দেখে যখন সহ্য করতে পারছেনা তখন তাঁর নামে মিথ্যা বানোয়াট, অপবাদ রটনা করছে। তাদের অনেক অপবাদের মধ্যে একটি হল আ’লা হযরত ছিলেন শিয়াপন্থী (!)
আ’লা হযরত শিয়া পন্থী ছিলেন এমন চিন্তা কেমন গোলাবী ওহাবী গংরাই বলতে পারে। কারন মিথ্যা বানোয়াট কথা বলা তাদের মজ্জাগত বদ অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। আলা হযরত শিয়া এটা তো দূরের কথা উপরন্তু তিঁনি তো শিয়াদেরকে মুসলমান ঈমানদারই মনে করতেন না। তাদের সাথে বিবাহ, তাদের জবেহকৃত পশু ভক্ষণ, তাদের সাথে মেলামেশা ও তাদের ভ্রান্ত আকীদার খন্ডনে প্রায় তিনি প্রায় ২০ টি কিতাব রচনা করেছেন। শুধু লেখনী নয় তাদের সাথে মুনাজারা ও তাদের চেহারা দেখাকে পর্যন্ত বৈধ মনে করতেন না তিনি।
বাতিল ফিরকাসমূহের মধ্যে একটি ফিরকা হচ্ছে শিয়া। যারা বর্তমানে আমাদের দেশে বিদ্যমান। পূর্ববর্তী শিয়ারা দ্বীনের অবেক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করতো। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলপমগণ তাদের ভ্রান্ত আকীদার খন্ডনে মহাপ্রলয় এনে দিলো তাদের উপর। কালের আবর্তনে তারা তাদের পূর্ববর্তী ভ্রান্ত আকীদার দিকে পুনরায় ফিরে গিয়েছে। তাদের ধর্মীয় গবেষক, মূর্খরা ও নর বারী সকলেই কুরআন শরীফের অপূর্নাঙ্গতার আকীদা পোষণ করে। তারা বলে যে সাহাবীরা কুরআন থেকে বহু সুরা ও আয়াত ফেলে দিয়েছে। তারা আমিরুল মু’মেনীন সৈয়্যদুনা আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও সকল আইয়িম্মায়ে আতহার (নবী বংশের ইমাম গণ) কে পূর্ববর্তী সকল নবীগনের উপর শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন বলে বিশ্বাস করে (সালাওয়াতুল্লাহে তা’য়ালা ওয়া সালামুহু আলাইহিম)। এ দুটি কুফরি আকীদা থেকে বর্তমানে তাদের কেউ মুক্ত নয়। আল্লাহই সাহায্যকারী।
(আল মুসতানাদুল মু’তামাদ বিনায়ে নাজাতিল আবাদ কৃত আ’লা হযরত, আল মাজমাউল ইসলামি, মুবারকপুর, আজমগড় ভারত, পৃ. ২২৪)
প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন, উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে বুঝা যায় আ’লা হযরতের আকীদা শিয়াদের ব্যাপারে কেমন ছিল। বর্তমানকালে সকল শিয়াদেরকে তিনি কাফের মবে করতেন। সাথে সাথে তিনি তাদের কুফরি আকীদাগুলোকেও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। এরপরেও তাকে শিয়া বলে আখ্যায়িত করা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়।
আ’লা হযরত শিয়াদের খন্ডনে ২০ টি কিতাব রচনা করেছেন। যেমন-
⊕ শিয়া মতবাদের খন্ডনে-
———————————
১) رد الرفضة রাদ্দুল রাফাদ্বাহ, (১৩২০ হি.)
– শিয়া মতবাদ খন্ডনে।
২) الادلة الطاعة فى اذان الملاعنة আল আদ্বিল্লাতুত ত্বায়াহ ফি আযানিল মুলায়িনাহ (১৩০৬ হি.)
– শিয়াদের আযানের শব্দ পরিবর্তনের দাঁতভাঙ্গা জবাব।
৩) اعالى الافادة فى تعزية الهند و بيان الشهادة আ-য়ালিল ইফাদাহ ফি তাজিয়াতিল হিন্দ ওয়া বয়ানিশ শাহাদাহ (১৩২১ হি.)
– তাজিয়া ও শাহাদাতনামা পাঠের হুকুম
৪) جزاء للّله عدوة بابائه ختم النبوة জাযাউল্লাহি আদুওয়াহ বি-ইবায়িহি খতমিন নবুওয়্যাহ। (১৩১৭)
– কাদিয়ানীদের রদের সাথে শিয়াদের রদ।
⊕ শিয়াদের একটি দল তাফদ্বীলিয়াহ’র খন্ডনে-
——————————————————–
৫) الجرح الوالج فى بطن الخوارج আল জারহুল ওয়ালিজ ফি বতনিল খাওয়ারিজ (১৩০৫ হি.)
৬) الصمصام الحدر بعلى حمق العيار المفتري আস সামসামুল হাদর বি-আলা হুক্বমিল আইয়্যারিল মুফতারি (১৩০৪ হি.)
৭) الر ائحة العنبرية عن الجمرة الحيدريّة আর রায়িহাতুল আম্বারিয়্যাহ আনিল জামরাতিল হায়দারিয়্যাহ (১৩০০ হি.)
৮) لمعة الشمعة لهدى شيعة الشنعة লুমআতিল শামআ লিহুদা শিয়ায়িশ শানআ (১৩১২ হি.)
৯) شرح المطالب فى مبحث ايمان ابى طالب শরহুল মাতালিব ফি মাবহাসি ঈমানে আবি তালিব (১৩১২ হি.)
⊕ তিন খলিফার শানে-
———————————-
১০) غاية التحقيق فى امامة العلى والصديق গায়াতুত তাহক্বিক ফি ইমামাতিল আলি ওয়াস সিদ্দিক (১২৯৭ হি.)
– প্রথম খলিফা কে? দালিলিক আলোচনা
১১) اللام البهى فى تشبيه الصديق بالنبى আল লামুল বাহি ফি তাশবিহিস সিদ্দিক বিননাবি (১৩৯৭ হি.)
– হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র শান।
১২) الزلال الانق من بحر سبقة الاتقى আযযুলাল আনকা মিন বাহরি সুবকাতিল আতকা (আরবি) (১৩০০ হি.)
১৩) مطلع القمرين ينفى ابانة سبقة العمرين মাতলাউল ক্বামারাঈন ইয়ানফি ইবানাতা সাবকাতিল ওমারাঈন (১২৯৭ হি.)
১৪) وجه المشو القبجلوة اسمأ الصديق والفاروق ওয়াজহুল মাশবিল ক্বাবঝালুওয়াহ আসমাউস সিদ্দিক ওয়াল ফারুক (১৩৯৭ হি.)
১৫) جمع القران وبم عزوه عثمان জামউল কুরআন ওয়া বিমা আজ্জুহু ওসমান (১৩২২ হি.)
⊕ হযরত আমিরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র শানে-
————————————————————-
১৬) البشرى العاجلة من نخف آجلة আল বুশরাল আজিলাহ মান নাহাফা আজিলাহ (১৩০০ হি.)
১৭) عرش الاعزاز والاكرام لاول ملوك الاسلام আরশুল ইজাজ ওয়াল ইকরাম লি আওয়্যালি মুলুকিল ইসলাম (১৩১২ হি.)
১৮) زب الاهواء الواهيه فى باب الامير معاوية জুব্বুল আহওয়াঈল ওয়াহিয়্যাহ ফি বাবিল আমির মুয়াবিয়া (১৩১২ হি.)
১৯) اعلام الصحابه الموافقين للامير معاوية و ام المؤمنين ইলামুস সাহাবাতিল মুওয়াফিকীন লিল আমির মুয়াবিয়া ওয়া উম্মিল মু’মেনীন (১৩১২ হি.)
২০) الاحادث الرويه لمدح الامير معاوية আল আহাদিসুল রভিয়্যাহ লি মদহি আল আমির মুয়াবিয়া (১৩১৩ হি.)
প্রিয় পাঠক, বড়ই অদ্ভুত লাগে গোলাবী-দেওবন্দী ওহাবীদের প্রোপাগান্ডা দেখলে। যিনি শিয়াদের খন্ডনে ২০ টি কিতাব রচনা করে তাদের গোমারাহির আর কুফরীর মূলোৎপাটন করেছেন তিনি নাকি শিয়া ছিলেন (!)
তিঁনি যে শুধু শিয়াদের বিরূদ্ধে কিতাব লিখে তাদের ভ্রান্ত মতবাদ রদ করেছেন তা নয়, বরং তিঁনি সম্মুখ মুনাজারার মাধ্যমে শিয়াদের ভ্রান্ত মতবাদকে গুড়িয়ে দিয়েছেন। এ একটি মুনাজারার ঘটনা নিচে বিবৃত করলাম….
⊕ তাফদ্বীলিয়্যাহ ফেরকার সাথে মােনাযারা:
_____________________________________
১৩০০ হিজরি সনে বেরেলি, বদায়ুন, সানবাল
ও রামপুরের শিয়ারা মাসআলায়ে তাফদ্বীলিয়্যাহ’র উপর আলা হযরত আহমদ রেযা বেরেলভী (রাহিমাহুল্লাহ)’র সাথে মােনাযারা বা সম্মুখ তর্কের ঘােষণা দিলো। শিয়া মােনাযের হিসেবে তৎকালীন শিয়াদের বড় আলেম মৌলভি মুহাম্মদ হাসান
সানবাহলিকে ঠিক করা হলাে। এদিকে আ’লা হযরত (রাহিমাহুল্লাহ) গুরুতর অসুস্থাবস্থায় ডাক্তারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মােনাযারা গ্রহণ করলেন। তিঁনি ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞার জবাবে বলেন-
مناظرہ کرتے ہوئے مجہے مرجانا منظور ہے اور مناظرہ سے انکار کر کے مجہے بپنا مقصود نہیں-
“মােনাযারা করে যদি মরতে হয়, মরতে রাজি। মােনাযারা অস্বীকার করে বেঁচে থাকা? তা কখনাে হতে পারে না।”
শিয়ারা আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)’র কাছে লিখলাে, প্রশ্ন কি প্রথমে আমরা করবাে, না কি আপনি করবেন? তার জবাবে আ’লা হযরত (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) শিয়া মােনাযের মৌলভি মুহাম্মদ হাসান সানবাহলির কাছে তিনটি প্রশ্ন লিখে পাঠিয়ে দিলেন।
লােকটি শিয়া মতবাদী হলেও বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করতে পারলেন না। তিনি বললেন, কোনাে আলেম তাফদ্বীলিয়্যাহ [হযরত আলি (রাদ্বিয়ালাহু আনহু) কে অপর তিন
খলিফার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া] আক্বিদা রেখে তাঁর জবাব দেয়া সম্ভব নয়। পরিশেষে তিনি গাড়ী নিয়ে আলা হযরতের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করলেন। পরবর্তীতে সে মাওলানা সাহেবের লিখিত কিতাব “শরহে আক্বায়েদে নসফি”র ব্যাখ্যাগ্রন্থ “নাজমুল ফারায়েদে” উপর্যুক্ত আক্বিদার ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের পক্ষে অভিমত পেশ করেন। [হায়াতে আলা হযরত: আল্লামা আবদুল হাকিম শরফ কাদেরী, পৃ. ৭৭]
আলা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি যে কট্টর শিয়া বিরোধী ছিলেন তা জনৈক দেওবন্দী মৌলভীর ভাষ্যতেই স্পষ্ট হয়-
দেওবন্দী চিন্তাধারার সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আঞ্জুমানে সিপাহে সাহাবা’ পাকিস্তান এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা নওয়াব ঝঙ্গভী বলেন- হিন্দুস্থানে যে সব আলেম শিয়াদের প্রতি কুফরির ফতোয়া আরোপ করেছেন তন্মধ্যে ব্রেলভী চিন্তাধারার আ’লা হযরত মাওলানা আহমদ রেযা খান ব্রেলভী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
[মাওলানা হক নওয়াব জঙ্গভী কী জাদ্দও জাহেদ আওর উনকা নসবুল আইন, ১৯৯০ ইং, পৃ. ২১]
আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
☞ তথ্যসূত্রঃ
১. ষড়যন্ত্রের অন্তরালে অজানা ইতিহাস কৃতঃ
অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম রিজভী।
২. অপবাদের জবাব কৃত: অধ্যক্ষ আল্লামা
মুহাম্মদ জসিম উদ্দীন রেজভী।
৩. জীবন ও কারামত কৃতঃ মুহাম্মদ শামশুল
আলম নঈমী
৪. আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা: জীবন ও
অবদান কৃতঃ অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল
আলম রিজভী।
৫. উইকিপিডিয়া (ইংলিশ)
৬. উইকিপিয়া (বাংলা)
৭. Alahazrat.net